somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অ-জানি দেশের না-জানি কী :: ভ্রমণ ও ফটো ব্লগ

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঘড়ির একঘেয়ে টিক টিক টিক, রুটিনে-বাঁধা পানসে সময় পেরিয়ে অবশেষে এলো রোদ ঝলমলে বড়দিনের ছুটি! মেয়ের বাবা যখন শুধালো কোথায় যাবার সাধ, আমি সাত-পাঁচ ভেবে জবাব দিলাম, 'অ-জানি দেশের না-জানি কী' দেখতে চাই! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ঠিক হল, প্রবাল দ্বীপে নিঝুম, নির্ঝঞ্ঝাট প্রহর কাটাবো সকলে মিলে। ভ্রমণকে রোমহর্ষক মাত্রা দিতে মেয়ের বাবা খুঁজে পেতে "বাচ্চা" হাঙরে-ঘেরা নিঝুল প্রবাল এক দ্বীপকে বেছে নিলেন। আমি আর মেয়ে সাগ্রহে সম্মতি দিলাম! সানন্দ সময় কাটলো দোকানে দোকানে ডুবুরীর পোষাক-সামগ্রী কেনাকাটায়!

আকাশযানে বিলাসিতার নানাবিধ উপকরণের ছড়াছড়ি। ছায়াছবির বিশালায়তন ক্যাটালগ। আনমনা নব ঘুরাতে ঘুরাতে স্টিভেন স্পিলবার্গের চোয়ালে (Jaws, 1975) দিলাম আঙুল দাবিয়ে। রূপালী পর্দায় যা দেখলাম, তাতে তো গায়ের লোম যা ছিলো, সব দাঁড়িয়ে গেল! নিঝুল দ্বীপে অবসর কাটাতে আসা পরিবারবর্গের হাঙরের আহারোৎসবে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-ধৌম্য হবার প্লট নিয়ে বানানো মুভি।

গায়ের লোম দাঁড়াতেই আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আকাশযান তখন শূন্যে ধাবমান। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলাম, "ও হরি, পার কর আমারে! নিঝুম দ্বীপের সাগরজলে আমি চুল ভেজাব না! পাদপদ্মও ভেজাব না।" মেয়ের বাবা চোখ কটমট করে তাকালেন! আমি মহানন্দে ওঁর "নয়নবাণ" সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমার সিদ্ধান্তে অনড় রইলাম। গনগনে চাহনি স্তিমিত হল।



মালদ্বীপের মাটিতে পা পড়তেই ছোটাছুটি করে খোঁজ নিয়ে বোধগম্য হল (বরঞ্চ বলি, বোধগম্য হয়েছে এমন ভাব করতে হল - এই সরল সমীকরণ আঁচ করতে না পারার তো কারণ নেই কোন) যে, ছুটির মৌসুমে সব পান্থনিবাস লোকে লোকারণ্য। তায়, শেষবেলা প্রোগ্র্যাম বদলাতে মরার উপর খাড়ার ঘা লেইট-ফী গুনতে হবে! কী আর করা! আমি যে নিরুপায়! হাঙরের আহার হবার সাধ কর্পূরের মত উবে গেছে তখন। ফল যা দাঁড়াল, ঢেঁই-পিঁপড়া কিংবা গণনেত্রী-স্টাইলে মাটি কামড়ে ধরে, মেয়ের বাবার কাটা ঘায়ে রাঁধুনী মশলা ছিটিয়ে আর প্রায় দ্বিগুন লেইট-ফী মাখিয়ে অবশেষে হাঙরহীন এক প্রবাল দ্বীপে, তিন তারার এক পান্থনিবাসে ঠাঁই মিললো আমাদের। ফিহালহোহী আইল্যান্ডে।










সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে আসতেই নজরে এল, ঘরে সর্বসাকুল্যে একটা মোটে শোবার বিছানা। রুম ম্যানেজমেন্টকে খবর দিতেই জলপরীর মত এক ফরাসী রূপসী ভ্রু-পল্লবে ঢেউ খেলিয়ে বললেন, তিন-নক্ষত্রের আদমসুরত মার্কা পান্থনিবাসে শোবার বিছানা একটা বৈ আশা করাটাই বাতুলতা। নিবাসে বেড়াতে আসা পর্যটকদের বিধির লিখন ভানুর সেই বিয়ের নেমন্তন্নে আসা অতিথি'র মত, যত ক্রয়মূল্যের উপহারসামগ্রী কিনেছো, ঠিক তত মার্কা আদর-আপ্যায়ন-ভোজন মিলবে।

সর্বসাকুল্যে পাঁচ রাত, ছয় দিনের কারাবাস ছিলো আমাদের। ঐ ক'টা দিন যতবার গেছি রুম ম্যানেজমেন্টের খোঁজে, ততবারই ফরাসী জলপরী ভ্রু নাচিয়ে জানিয়েছে, আদমসুরত মার্কা পান্থনিবাসে সাবান, শ্যাম্পু, কিংবা তোয়ালে'র খোঁজ করাটা দন্ডনীয় অপরাধ।

বড়দিনের আগের রাতে দ্বীপের অতিথিদের নিয়ে মহাভোজের আয়োজন। প্রায় বারশো দ্বীপের সমষ্টি, মালদ্বীপ; যার জনমানবশূন্য দ্বীপগুলোর অন্যতম এই 'ফিহালহোহী'। স্থানীয় বসতি গড়ে ওঠেনি এখানে। চাঁদোয়ার নিচে থরে থরে সাজানো ব্যঞ্জন। রন্ধনশিল্পের শৈল্পিক দিকটাকে ভোজোৎসবের প্রাণ-ভোমরা নির্ধারণের সচেতন প্রয়াস। আমাকে টানলো খুব। আরও ভাল লাগলো যখন বুঝলাম আপ্যায়নকারীদের অনেকেই বাংলাদেশী। আলাপচারিতায় জানলাম, মালদ্বীপে কেবল মোটা অঙ্কের মাইনে-ই নয়, প্রাপ্য সম্মানটুকুও সবসময়ে দেওয়া হয় তাঁদেরকে। মালদ্বীপে মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত শান্তিপূর্ণ সংসদীয় নির্বাচনের গল্প শুনলাম ওঁদের মুখে; শুনলাম রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বর্ণনা।








অতঃপর জলপরীর দেশে অবগাহন, নিমজ্জন! আলোর প্রতিসরণের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় জলপরীর দেশে যত গভীরে তলিয়ে যাই, আশেপাশের দৃশ্যপট রঙধনু-রঙ বদলায়। সুলতানা বিবিয়ানা, ঐ নিমোর বৈঠকখানা! অ্যারিয়েলের প্রবাল রাজপুরী। আমাকে আহার ভেবে টিয়াপাখির মত বর্ণালী এক মাছ (পরে জেনেছিলাম, ওটা 'প্যারট ফিশ') আঙুলে ঠোকর মারলো। আমাকে ঘিরে উপরে, নীচে, পাশাপাশি প্রবালপুরীর সকলে - পাতালপুরীতে উৎসব! আমার অনুভবের কোষে কোষে ঐশী নাযিল হল।








গভীর রাত অবধি একাকী সাগরপাড়ে অতন্দ্র প্রহর কেটে গেল। হঠাৎ দেখি পাতালপুরীর এক মৎস্যকুমার হৃদয় সঁপে দিতে কোত্থেকে সাগর ফুঁড়ে একেবারে আমার পায়ের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে! ডাঙ্গায় উঠে শ্বাসকষ্টে ছটফট করছিলো বেচারী। অম্লান অনুরাগ ফ্রেমবন্দী করে যন্ত্রণানীল পাতালকুমারকে তাই মহাসমুদ্রের কোলে ফিরিয়ে দিলাম। এর ফাঁকে কখন ফজরের ওয়াক্ত হয়েছে টের পাইনি। বৃক্ষরাজির বাসিন্দাদের কলকাকলীতে ধ্যানভঙ্গ হল।

[উৎসর্গ: প্রিয় বন্ধুনাহিদ আফরোজ, ওঁর মালদ্বীপ ভ্রমণের গল্পে মুগ্ধ হয়েই আমাদের যাত্রার সূচনা।]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ২:৩৪
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×