একসঙ্গে চা খাওয়া হলো না, স্যার-
মাহমুদুর রহমান
সা ইফুর রহমান চলে গেলেন। তার সফল ও বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টানার সময় এখনও হয়নি, সেটাও হয়তো ৭৭ বছরে আর বলা যায় না। তাই বলে এমন সকরুণভাবে প্রিয়জনের মুখ না দেখেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসপাতালের বেড থেকে চলে যাওয়ার কথা ছিল না। আমার লেখাটি পড়ার আগেই দেশবাসী জেনে গেছেন বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের এবং সফলতম সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান তার প্রিয় জন্মভুমি সিলেট থেকে সড়কপথে ঢাকায় আসার পথে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। সে সঙ্গে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক অসাধারণ মেধাসম্পন্ন, আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক, বিদ্বান রাজনীতিবিদকে। আর সিলেট কী হারাল, সে বিবেচনা সিলেটবাসীর। আমার কাছে অন্তত কখনও মনে হয়নি যে, ওই অঞ্চলবাসী তাদের এই ক্ষণজন্মা সন্তানটিকে সঠিকভাবে মুল্য দিতে পেরেছিল। ১৯৯১ সালে সাইফুর রহমান টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন; কারণ নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি। এরশাদ সরকারের রেখে যাওয়া শুন্য ভান্ডার নিয়ে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতা থেকে বিদায় গ্রহণ করে, ততদিনে প্রায় দেউলিয়া বাংলাদেশ এশিয়ার ?ইমার্জিং টাইগার?-এ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের কাহিনীর সঙ্গে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এক সফল অর্থমন্ত্রীর গল্প। ২০০১ সালে পুনর্বার একই দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন সাইফুর রহমান। সরকারের মেয়াদান্তে ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতা ত্যাগকালে বাংলাদেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছিল। অর্থনীতির সব মানদন্ডে বাংলাদেশ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছিল। বেগম খালেদা জিয়া-সাইফুর রহমান জুটির দ্বিতীয় মেয়াদের সফল অর্থনৈতিক ব্যবস্হাপনায় হেনরি কিসিঞ্জারের বর্ণিত এক সময়ের ?তলাবিহীন ঝুড়ি? দ্রুত একটি মধ্যম আয়ের দেশে রুপান্তরের পথে অগ্রসরমান। বলা হচ্ছিল আগামী এগার (ঘবীঃ ঊষবাবহ) অর্থনৈতিক শক্তির একটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপুর্ণ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আজ এসবই ইতিহাস। মরহুম সাইফুর রহমানও সব প্রশংসা-নিন্দার ঊর্ধ্বে।
জনাব সাইফুর রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ২০০২ সালের মার্চে বিনিয়োগ বোর্ডের সভায়। তার আগে তিনি আমাকে চিনতেন না। প্রথম সাক্ষাৎ খুব সুখকর হয়েছিল-এমন দাবি করা যাবে না। ডাকসাইটে অর্থমন্ত্রীর কাছে আমি সম্ভবত নিতান্তই দুগ্ধপোষ্যরুপে প্রতিভাত হয়েছিলাম। বয়সের কথা বলছি না। প্রথম পরিচয়ে আমার লেখাপড়া, জ্ঞানের পরিধি নিয়ে তিনি যে খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করছিলেন না, সে অনুভুতি লুকিয়ে রাখার মানুষ যে সাইফুর রহমান ছিলেন না-সেটি তার পরিচিতজনরা জানেন। আমার চরিত্রেও বিনয়ের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কাজেই পরিচয়ের প্রথম দিনে সম্মানজনক দুরত্ব বজায় রেখেই যে বোর্ডসভা সমাপ্ত করেছিলাম, সেই স্মৃতি এখনও উজ্জ্বলই রয়েছে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সেই দুরত্ব ক্রমেই ঘুচেছে। শেষদিকে তার দিক থেকে কখনও কখনও কিছুটা স্নেহও যেন টের পেতাম। জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়ার পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে মাঝেমধ্যেই মতবিরোধ সৃষ্টি হলেও সে কারণে তিনি কখনও আমার ওপর বিরক্ত হচ্ছেন-এমন মনে হয়নি। বরং তেলের দাম পরিশোধ না করার কারণে যখন একদিনের জন্য বাংলাদেশ বিমানে জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলাম, সে সময় জাঁদরেল মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র মরহুম সাইফুর রহমানই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
এক-এগারোর পর বিভিন্ন কলামে তার পারিবারিক দুর্যোগের ভয়াবহতা অনুধাবন না করে তার রাজনৈতিক অবস্হানের কঠোর সমালোচনা করে দিনের পর দিন লিখে গেলেও একবারের জন্যও অনুযোগ করেননি। উল্টো প্রায়ই ফোন করে আমার দুর্বল রচনারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কতদিন বলেছেন তার বাসগৃহে যেয়ে এক কাপ চা খেয়ে আসার জন্য। তখন তিনি বড়ই নিঃসঙ্গ ছিলেন। বড় ছেলে কারাগারে, ছোট ছেলে দেশান্তরী। এমনকি জ্যেষ্ঠ পুত্রবধুকেও সামরিক জান্তা ছাড় দেয়নি। একসঙ্গে বসে চা খাওয়ার সময় করে আর উঠতে পারিনি। আজ মনে হচ্ছে, কেবলই কি সময়ের অভাব ছিল? নাকি খানিকটা উদাসীনতাও? আপনার চায়ের দাওয়াত রক্ষা করতে না পারার জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে, স্যার।
এক-এগারোর কুশীলবরা দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করার মানসেই জাতীয়তাবাদী শক্তিকে হীনবল করতে চেয়েছে। সেই উদ্দেশ্য সাধনে একটি খন্ডিত বিএনপি সৃষ্টি করার জন্য সে সময় জনাব সাইফুর রহমানের ওপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তার প্রবীণ বয়স কিংবা দেশের প্রতি অবদানকে কোনোরকম সম্মান না দেখিয়ে সন্তানদের জিম্মি করে তাকে রীতিমত ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। বিদেশিদের ক্রীড়নক সেই অশুভ গোষ্ঠী বর্তমান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এখনও যে তাদের অবস্হান ধরে রেখেছে এটাই জাতির দুর্ভাগ্য। জীবন সায়াহ্নে এসে জনাব সাইফুর রহমানকে যে মানসিক নির্যাতন সইতে হয়েছে, তার বিচারের জন্য একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক এবং দেশপ্রেমিক সরকারের অপেক্ষায় থাকতে হবে আমাদের।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি সিলেট সদর আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। বলছিলেন বয়স হয়ে গেছে, দুই আসন থেকে নির্বাচন করার ধকল শরীরে সইবে না। পুরনো সহকর্মীদের ফিরিয়ে দেয়ার পর আমি অনুরোধ করলাম। টেলিফোনেই অনেক সুখ-দুঃখের কথা হলো। শেষ পর্যন্ত আমার কথা রাখলেন। শুধু শর্ত দিলেন, আমাকে সিলেট যেতে হবে। আমি তার বন্ধু জনাব শফিক রেহমানকে নিয়ে সিলেটে গিয়েছিলাম। তিনি নিজে ওসমানী বিমানবন্দরে এসেছিলেন আমাদের রিসিভ করতে। এ সম্মানের কথা আমৃত্যু ভোলার উপায় নেই। একটা পুরো দিন তার সঙ্গে কাটিয়েছি। দুপুরে হাওরের নানা ধরনের মাছ পাতে তুলে দিয়ে খাইয়েছিলেন। তার সঙ্গে নির্বাচনী জনসভাতেও যেতে হয়েছিল। মনে পড়ছে, সেখানে অর্বাচীনের মতো একখানা বক্তৃতাও দিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় তার গাড়িতে, তার পাশে বসেই বিমানবন্দরে ফিরে এসেছিলাম। সেই শেষ দেখা। এরপর ফোনে কথা হয়েছে। কিন্তু দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। শেষ নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন সিলেটের এই সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। কিন্তু পরাজয়ের বেদনা বোধ করেছি আমি বোধহয় তার চেয়েও অনেক বেশি। ভুলি কী করে, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাননি। কেবল আমার কথাতেই সম্মত হয়েছিলেন। জানা হলো না আমার সেই অবিমৃষ্যকারিতার অপরাধ তিনি মৃত্যুর আগে ক্ষমা করতে পেরেছিলেন কিনা। সিলেটবাসী আজ কী বলবেন আমি জানি না। তবে একজন সাইফুর রহমানকে যথাযথ মুল্যায়ন না করার ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা আমার তরফ থেকে আমি চেয়ে রাখছি। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার বিদেহী আত্মার জন্য অপার শান্তি প্রার্থনা করে শেষ করছি আমার শ্রদ্ধার্ঘ
(সুত্র,আমার দেশ, ০৬/০৯/২০০৯)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




