বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন : কত গভীরে খুঁড়লে সুচেতনার দেখা পাব ॥ ফারুক ওয়াসিফ
by editor | Saturday, July 19, 2008 - 2:21pm
‘হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো’ যতটা কাব্যিক, বিবেক খুঁড়ে চেতনা জাগানো তত কাব্যিক নয়। বাস্তবে তা পুরোনো ঘা আঁচড়ে ক্লেদ-পুঁজের তলা থেকে শুদ্ধ রক্ত জাগানোর ব্যাপার।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আমরা বসে ছিলাম। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। সেটা সম্ভবত আগস্ট মাস ছিল। এ সময়টায় ঝড়-বৃষ্টি বেশিই হয়। তার মধ্যেই সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে ভোর, আবার ভোর থেকে আরেক ভোর অবধি আমরা বসে থেকেছি। দিনের পর দিন। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল দেশে। ঢাকার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বন্ধপ্রায়। ক্যাম্পাস থেকে ঢাকায় কিংবা ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে আসার একমাত্র বাহন ছিল নৌকা। বন্যা ও আন্দোলন উভয় কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। বিরাট ক্যাম্পাসে আমরা অল্প কিছু প্রাণী আছি। আর আছে ‘ধর্ষক গ্রুপ’ নামে পরিচিত সে সময়ের সরকারি সংগঠনের ক্যাডারকুল।
খবর আসত যে ঢাকা থেকে অস্ত্র এসেছে−যেকোনো দিন হামলা হবে। হামলা যে একেবারে হয়নি তা নয়। কিন্তু ভয়াবহ কিছু ঘটার গুজব তখন আমাদের চারপাশে। খবর আসে, রাতের অন্ধকারে চৌরঙ্গীতে একদল যুবক মুখে কালো কাপড় বেঁধে জমায়েত হয়েছে। সবাই জানত ওরা কারা। কিন্তু আমরা নিরুপায়। এমনকি ভয় পাওয়ার সামর্থ্যও যেন লোপ পেয়েছিল। আমাদের ফেরার পথ ছিল না। কেন ছিল না তা দেশবাসী জানে, আজ তা ইতিহাস। আমরা আমাদের কয়েকজন সহপাঠীর ওপর বীভৎস ধর্ষণের বিচারের জন্য মরিয়া হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বসে ছিলাম হিংস্র হায়েনার ঘেরাটোপের মধ্যে গায়ে গা লাগিয়ে, মেষশাবকের দলের মতো। তার আগে পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক কাঁটা বিছানো পথ।
সেটা ১৯৯৭ সাল। আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগের কথা। বিষয়টি তখন কেবল জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক খবরও হয়েছিল। দেশের মানুষ অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিল দেখার জন্য যে পথের শেষে কী মেলে।
বন্যায় বিপর্যস্ত পথঘাটের জন্য শেষের দিকে সাংবাদিকেরাও তেমন একটা আসত না। গোটা ক্যাম্পাসে একমাত্র মোবাইল ফোনধারী ছিল ধর্ষককুলশিরোমণি ছাত্রলীগের সভাপতি মানিক। আমাদের কিছু হলে সেটার খবর হতেও হয়তো এক-দুই দিন পেরিয়ে যেত। তবু আমরা নিরুপায়। সেটা ছিল নব্বইয়ের পরের বাংলাদেশের স্পর্শকাতর ও দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনগুলোর একটি। ধর্ষকদের ক্ষুদ্র একটি চক্র আর কিছু দোদুল্যমান শিক্ষার্থী ছাড়া সব শিক্ষার্থীই সেই আন্দোলনে শামিল ছিল। এবং আমরা জয়ী হয়েছিলাম। কুখ্যাত মানিকসহ আরও ছয়জন ধর্ষকের শাস্তি হয়েছিল। যদিও শাস্তি না বলে সেটাকে ফুলের টোকা বলাই ভালো। ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা বীরপুঙ্গব’ মানিকের ছাত্রত্ব চিরতরে বাতিল হয়েছিল এবং বাকিদের দুই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি বহিষ্ককারের দন্ড হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের তরফে এই রায় যখন ঘোষিত হয়, তখনো বন্যা চলছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ফলে ফরিয়াদিদের ‘হার না মানা হার’ মানতে হয়েছিল। সেই বিজয় বিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পাঠ শুদ্ধ হতো না, এবং জাতীয়ভাবে বাংলাদেশও গভীর কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়ে থাকত! কিন্তু আমাদের অনভিজ্ঞ মন বুঝতে ভুল করেছিল যে পথের শেষ বলে কিছু নেই। বরং সামনে রয়েছে আরও খানাখন্দ ও কাঁটায় ভরা পথের পদযাত্রা। ধর্ষকেরা এর পরও বারবার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী হানা দিয়েছিল, পেয়েছিল প্রশাসনিক মদদ।
আজ এত বছর পর মনে হচ্ছে, কিছু ঘা সহজে শুকায় না, কিছু প্রবণতার নিবারণ সহজে হওয়ার নয়। তাই জাতীয় সংবাদপত্রের এ-পাতায় ও-পাতায় যখন বারবার দেখি শিক্ষাঙ্গনে আবারও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে, আবারও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে মুখরিত হচ্ছে, বুঝি যে এই পোড়ার দেশে সময় সহজে পাল্টানোর নয়। নইলে কেন মাঝেমধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, এমনকি বড় বড় কলেজে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটার সংবাদ পাই? কেন আবারও মুখে ফেনা তুলে বলতে হয়, একটা প্রতিকার করো, রেহাই দাও রেহাই দাও!
এ রকম একটি খবর আবারও লক্ষ করা শুরু করেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের শাস্তি দাবি করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছেন। ১৫ জুলাইয়ের প্রথম আলোতেও সেই সংবাদ আছে। এ সপ্তাহেই চোখে পড়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকমই একটি ঘটনা। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ধারার প্রতিবাদ হয়েছে একজন শিক্ষকের অপকর্মের বিরুদ্ধে। ক্ষেত্রবিশেষে বিচারে আইনি শাস্তি না হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তিও হতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিকারের স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাও প্রবল।
প্রতিকারের সেই পন্থার ডাক এক যুগ আগে জাবি ও ঢাবির যৌন নিপীড়নবিরোধী দুটি বিরাট আন্দোলনের গর্ভ থেকেই উঠে এসেছিল। এক কথায় তা ছিল যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ও অভিযোগ সেল প্রতিষ্ঠার দাবি। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফরিয়াদি নারী-শিক্ষার্থীরা যখন অসহায়ত্বের সঙ্গে দেখলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বিধি তথা প্রক্টরিয়াল ল-তে এ বিষয়ে কোনো বিধানই নেই, তা কি ওই সব বিধিমালা তৈরির সময় এ ধরনের সমস্যার প্রকোপ কম ছিল বলে, নাকি কর্তৃপক্ষ ‘পুরুষ’ ছিলেন এবং আছেন বলে? নারীর শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তাহানির বিষয়টি বোধহয় তাঁদের চিন্তার মধ্যে ছিল না। এ ছাড়া সে সময়ের সমাজমানসে এ ধরনের বিষয় নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় বিরুদ্ধে রক্ষণশীল সংস্কারও ছিল অতি জোরালো। কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক সংস্কৃতিতে এ বিষয়ের চেতনা আগের চেয়ে প্রখর। প্রচলিত নারী নির্যাতন আইনের ভাষা ও বিধিই তার বড় প্রমাণ। কিন্তু সব ক্ষেত্রে বিষয়গুলো নিয়ে আদালত পর্যন্ত দৌড়ানো সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আমাদের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিতে সামাজিকভাবে নিন্দিত হওয়ার ভয়ে বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করার চেয়ে সয়ে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি। ধর্ষণবিষয়ক মামলাগুলোর প্রায় নিরানব্বই শতাংশই করেন গরিব ও শ্রমজীবী নারীরা। সম্ভবত তাঁরা শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর চেয়ে সাহসী ও অকপট কিংবা তাঁদের ‘কলঙ্কিত’ বোধ করার ধরন সম্ভবত আমাদের থেকে আলাদা। যা-ই হোক, শিক্ষাঙ্গন ও কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার মাধ্যমে অফৌজদারি শাস্তির ব্যবস্থা এবং গোপনে অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি তৈরি করা হলে অনেককেই বোবাকান্নায় গুমরে মরতে হয় না এবং মানিকের মতো অপরাধীরা পুরুষালি বীরত্বে বুক ফুলিয়ে একের পর এক নারীদের ‘শিকার’ করতে পারে না।
বিষয়টার আরেকটা মাত্রাও খেয়ালে রাখা চাই। আমরা কোনো বিশুদ্ধ সমাজে বাস করছি না। আমরা বাস করছি নানা কুপ্রবৃত্তিতে পরিপূর্ণ এক সংঘবদ্ধ দাপটের সমাজে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এর বাইরে নয়। বরং সেখানে দলীয় সন্ত্রাস ও দখলদারি, প্রশানিক স্বৈরাচার, শিক্ষক-ছাত্রদের একটি অংশের অসাধু ক্ষমতার আছর অতীতের বিষয় নয় এবং তা বিলোপ পেয়েছে বলে ভাবার উপায় নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতা কিংবা প্রশাসনিক পদ বা শিক্ষকসুলভ উচ্চ অবস্থানের জোরের মুখে শিক্ষার্থীদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার খুব সামান্যই। হুমকি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারী-শিক্ষার্থীদের রক্ষার কেউ নেই, যদি না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন এ বিষয়ে সজাগ থাকে। কিন্তু সজাগ থাকলেও কী লাভ? মান্ধাতার আমলের প্রক্টরিয়াল ল এখানে অকেজো। এত কথা বলার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং সমাজের কর্তাব্যক্তিদের অনেকের মধ্যে নারীর নিরাপত্তার চেয়ে নিজেদের অসদাচরণের ছাড় পাওয়ার অভ্যাস এতটাই জেঁকে বসে আছে যে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পোশাক কারাখানাসহ সব কর্মস্থলে নিপীড়ন ও হয়রানিবিরোধী নীতিমালার প্রতি তীব্র বিরোধিতা লক্ষ করা যায়। তারা এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এতটুকুই বলে যে এতে করে যদি নির্দোষকেও ফাঁসানো হয়? এই যুক্তি মানতে গেলে দেশ থেকে আইন-আদালত উঠিয়ে দিতে হয়। কেননা সেখানেও তো নির্দোষকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে ছাত্রপ্রতিনিধি ও শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে একটি নীতিমালা পেশ করা হয়েছে কয়েক বছর হলো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২০০৭ সালের শেষাশেষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আগ্রহে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটিও গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশ মানতে তাই অসুবিধা কোথায়। যেগুলোকে আমরা উন্নত দেশ বলি সেসব দেশের অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডসহ অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু আগে থেকেই এমন নীতিমালা ও অভিযোগ সেল প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেখানে নারীর মর্যাদা ও অধিকার আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। নারীর প্রতি বিবিধ নিপীড়ন কম হওয়ার পরও তারা যদি পারে তাহলে আমাদের অসুবিধা কোথায়। নাকি নারীকে খেয়ালখুশিমতো বিপন্ন করার বিদ্যমান পরিবেশ বহাল রাখার জন্যই নীতিমালাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ায় এত টালবাহানা? বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁরা এই ফাঁকিজুকির মাধ্যমে নিপীড়কদেরই পরোক্ষভাবে রক্ষার আয়োজন করছেন, তাঁরা আসলে চোখের আড়ে পাহাড় লুকাতে চাইছেন। তাঁরা আসলে নারীর জায়গা তো বটেই, এমনকি নারী-শিক্ষার্থীর শিক্ষক, সহপাঠী, অভিভাবক কিংবা বন্ধুর জায়গা থেকে বিষয়টাকে দেখতে ব্যর্থ হচ্ছেন; তাঁরা দেখতে চাইছেন পুরুষালি সুবিধাভোগের অবস্থান থেকে। এ অবস্থার অবসান না হলে নীতি-নৈতিকতা-সুশাসন-সভ্যতাজাতীয় কথাবার্তার বাখোয়াজি করে কী লাভ। যে দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে লাখ লাখ নারীর ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, সেই দেশে নারী-নিপীড়নকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ থাকতে পারে না।
শিক্ষকদের একটি অংশের মধ্যে এ বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে সত্য। কিন্তু আরও বড় সত্য হচ্ছে, অনেক শিক্ষকই এই দাবির পক্ষে। এটা সময়ের প্রয়োজনও বটে। শিক্ষাঙ্গনের গণতন্ত্রায়ণ ও নিরাপদ করার স্বার্থেই তা জরুরি। এ দুইয়ের অভাবে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণ তো বটেই, জীবনের সর্বনাশও ঘটে চলেছে। আর এটা এমন এক ধরনের বিপর্যয়, যা দেখে শান্ত থাকা কঠিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক ছাত্রীর আত্মহত্যা কি আমাদের চেতনায় কোনো দাগ কাটছে? নাকি চেতনার ওপর জমা গাদ খুঁড়ে খুঁড়ে হূদয় জাগানোর কাজ আরও করে যেতে হবে? সেই কাজ চলুক সমস্যা নেই, কিন্তু আমাদের বলে দেওয়া হোক, বিবেক বস্তুটি কত গভীরে চাপা পড়েছে, আমরা তত দুর পর্যন্ত খুঁড়তে রাজি আছি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




