আতাউস সামাদ
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার রায় চুড়ান্ত পর্যায় থেকে ঘোষণা করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর, ২০০৯)। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে এই মামলায় হাইকোর্টে �ডেথ রেফারেসে�র শুনানি শেষে যাদের প্রাণদন্ড হয়েছিল তাদের সবার শাস্তি বহাল রেখেছেন।
১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাড়িতে হত্যা করা হয় তার স্ত্রী, শিশুপুত্র রাসেলসহ তিন পুত্র, দুই পুত্রবধু ও এক সহোদরকে। একই সময়ে ঢাকাতেই অন্য দুই বাড়িতে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি ও তৎকালীন পানিসম্পদ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং ভাগনে প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও তার স্ত্রী। শেখ ফজলুল হক মণির শিশুপুত্র শেখ ফজলে নুর তাপস ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ সেলিম প্রাণে বেঁচে যান। তারা দু�জনই এখন জাতীয় সংসদের সদস্য। জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল হাসানাত আবদুল্লাহও প্রাণে রক্ষা পান। তিনি ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে চিফ হুইপ ছিলেন। নানা আইনি জটিলতা ও পলাতক থাকায় তিনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। নিহত রাষ্ট্রপতির দুই কন্যা-শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া তখন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বাংলাদেশস্হ সংবাদদাতা মার্ক ডামেট গত ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের রায় সম্পর্কে তার রিপোর্টে বলেন, �অভ্যুত্থানকারী সেনা কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের হত্যা করেছিল, যাতে ভবিষ্যতে কেউ তাদের বিচার না করতে পারে। তবে তারা হিসাবে ভুল করেছিল। নিহত রাষ্ট্রপতির কন্যা শেখ হাসিনা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওই হত্যার শোধ নিয়েছেন।� (বিবিসির সাংবাদিক ইংরেজিতে ধাবহমব শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।)। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে রোমে বলেছেন, তিনি প্রতিশোধ নিতে আসেননি, তিনি ন্যায়বিচার চান ও বাংলাদেশকে ১৫ আগষ্টের নৃশংস হত্যাকান্ডগুলোর অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চান।
গত শনিবার ২১ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে সশস্ত্রবাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ নভেম্বরে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় প্রসঙ্গে বলেন, �ওইদিন সত্যের জয় হয়েছে।� তিনি আরও বলেন, �অন্যায় যে করে, শাস্তি তাকে পেতেই হয়।� ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ইতিহাসের যে জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটেছিল, তা কেবল কারবালার ঘটনাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। কারবালার ঘটনায় নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়নি; কিন্তু ১৫ আগষ্টের কালরাতে নারী ও শিশুরাও ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি� (সমকাল, ২২ নভেম্বর)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে আরও বলেন, �খুনিরা প্রকাশ্যে এই হত্যাকান্ড ঘটানোর কথা দম্ভভরে প্রচার করে চ্যালেঞ্জ করেছিল, কে তাদের বিচার করবে? কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল, সবার উপরে একজন বিচারক আছেন-যিনি সব দেখেন-তিনি রাব্বুল আলামীন।� তিনি আরও বলেছেন, �এই জঘন্য হত্যাকান্ডকে সমর্থন ও সহযোগিতা করার জন্য অনেক অপবাদ ও অপপ্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। হত্যাকারীদের বিচার না করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।� তার এই ভাষণ দেয়ার সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যা মামলার বিচার হয়েছে ফৌজদারি আইনে। আসামিদের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫ তারিখে যা ঘটেছিল তা সেনা বিদ্রোহ। সেনা বিদ্রোহের বিচার সেনা আইনে হওয়া উচিত ছিল। তারা আশা করেছিলেন, সুপ্রিমকোর্টে আসামিদের প্রাণদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হবে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের আইনজীবী খান সাইফুর রহমান রায়ের পর প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদকের কাছে এই মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আদালতে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, যদি ধরেও নেয়া যায় যে, সেদিন বিদ্রোহ হয়েছিল, তবে সেদিন হত্যাও হয়েছিল এবং হত্যার বিচার সাধারণ আদালতে হওয়ায় কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, শুধু কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেই এটা সাধারণ আদালতে বিচার করা যায় এবং এক্ষেত্রে সেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছে। তিনি আরেকটি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বাংলাদেশের নৌবাহিনী আইনে (ঘধাু অপঃ) বিদ্রোহের যে সংজ্ঞা রয়েছে ১৫ আগষ্ট ঘটনাটি সেই সংজ্ঞায় পড়ে না।
আজকে অন্য আরেকজনের মন্তব্য মনে পড়ছে, তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরে নাম সংশোধন করে আওয়ামী লীগ) সাবেক যুগ্ম সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব সরকারের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ সাহেবকে হত্যার পর তিনিই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন, তিনিই সেদিন সামরিক শাসন জারি করেন (বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সেটাই শুরু) এবং ১৫ আগষ্ট ঘটনাবলীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়মুক্ত করে যে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যাস হয়েছিল, সেটাও তিনিই জারি করেন। কয়েক বছর পরে তিনি একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটির এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ১৫ আগষ্ট হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি কেন? উত্তরে খন্দকার মোশতাক আহমদ নাকি বলেছিলেন, �কোনো যুদ্ধে যারা বিজয়ী হয় তাদের কখনও বিচার হয় নাকি? ১৫ আগষ্ট তো একটা যুদ্ধ ছিল। সেদিন যারা জিতেছে তাদের বিচার হয়নি।� এখানে সবিনয়ে ও ক্ষমা চেয়ে একটি কথা বলে রাখি যে, ওই সংবাদ সম্মেলনে আমি যাইনি। উপরোক্ত প্রশ্নোত্তরটির কথা আমি শুনেছি কোনো সহকর্মী সাংবাদিকের কাছে। তাই এই বক্তব্যের বর্ণনার পুর্ণ সঠিকতার কথা হলফ করে বলছি না।
তবে খন্দকার মোশতাক আহমদের কথিত মন্তব্যের খেই ধরে দুটো কথা বলা চলে। প্রথমত, ঘটনাচক্র যেভাবে ঘুরেছে তাতে শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক ও ১৫ আগষ্টে অভ্যুত্থানকারী সেনা সদস্যরা একপর্যায়ে পরাজিত হয়েছেন, আর সে জন্যই তাদের বিচার হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমদ আজ জীবিত থাকলে তিনিও তার বহুদিনের বন্ধু ও রাজনৈতিক সহকর্মী রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি হতেন। এমনকি, এক নম্বর আসামিই হতেন হয়তোবা। দ্বিতীয়ত, ওই হত্যার বিচার যে বহুদিন পর্যন্ত হয়নি তার কারণ সম্ভবত সেনাবাহিনীর, তথা সশস্ত্রবাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের উপস্হিতি এবং একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানান জটিলতা, যার পুর্ণ চিত্র আজও প্রকাশ পায়নি। ইতিহাসবেত্তা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষকরা যদি এসব জটিলতার সঠিক তথ্য ও নির্মোহ বিশ্লেষণ করতে পারেন কোনোদিন, তাহলে দেশ অবশ্যই উপকৃত হবে। তবে কাজটি যে অদুর ভবিষ্যতে করা যাবে, তা মনে হয় না।
১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্ট আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার দিনকয়েক আগে থাকতেই পরিচিত মহলে আলোচনা হতে শুনেছি যে, রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার চুড়ান্ত রায় হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বিভেদ রয়েছে, তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে দুরত্ব আছে তা কমবে কিনা। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এর উত্তর দেয়ার জন্য আমার পালা এলে আমি কোনো আশাবাদ প্রকাশ করতে পারিনি। যদিও তেমনটা করতে পারলে খুশি হতাম।
পরে দেখলাম, রায়পরবর্তী করণীয় নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হতে সময় লাগেনি একটুও। যেমন গত শনিবারের আমার দেশ পত্রিকায় দেখলাম, জাতীয় সংসদের উপনেতা ও সাবেক আওয়ামী লীগ মন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল এবং পরবর্তী সময়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই কালো অধ্যাদেশ বাতিল করেনি, সেই মদতদাতাদেরও বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
অন্যদিকে, একই দিনে বিএনপি নেতা, ২০০১-২০০৬ মেয়াদকালের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ও বর্তমানে সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, �প্রধানমন্ত্রীর পিতা হত্যার বিচার হয়েছে। এ রায় নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা খুশি। আমরা চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক; কিন্তু পিতৃহত্যার বিচারের রায় পেতে যদি প্রধানমন্ত্রী হতে হয়, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলা যাবে না। �৭২ থেকে �৭৫ সাল পর্যন্ত অন্য যারা পিতা হত্যার শিকার হয়েছেন, সেসব বিচার সুষ্ঠুভাবে হলেই তবে বলা যাবে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।�
আমরা আর কী বলব! কেবল দেখতে থাকি। তবে উপরের ওই দুই উক্তি থেকে বোঝা যায় যে, একপক্ষ যেমন বিএনপিকে হেনস্হা করতে উদ্যত, তেমনি প্রত্যুত্তরে অপরপক্ষ মুজিব শাসনামল (�৭২-৭৫) ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যাবলীর বিস্তারিত পোষ্টমর্টেম করতে পিছুপা হবে না।
গত সপ্তাহে (১৯ নভেম্বর, ২০০৯) আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত �হারানো ঘুমের সন্ধানে� শিরোনামে আমার লেখাটির ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে একেএম আশরাফুল হক, যার জন্য আমি তার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ওই লেখাতে �হ্যাপি মিলার� নামে আমি যে গল্পটির কথা লিখেছি, সেটা আসলে গল্প নয়, সেটি বিখ্যাত ইংরেজ কবি আলফ্রেড টেনিসনের কবিতা, এই ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার চিঠিটা পড়ে খুব লজ্জা পেলাম। কিন্তু একটা নামকরা কবিতাকে গল্প বলে চালিয়ে দিলাম কেন, তা নিয়ে কিছু চিন্তা করেছি। আমার মনে হচ্ছে, ওই কবিতাটি বোঝার জন্য ওটার কোনো গদ্যরুপ পড়েছিলাম, সেটাই স্মৃতির পর্দায় রয়ে গেছে। আর কাহিনীটা বলতে গিয়ে কবিতার বাইরে যেসব কথা বলেছি তার মধ্যে নীতি কথাগুলো বোধহয় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা কোনো সময় শিখিয়েছিলেন। আমার লেখাটিতে সম্ভবত দুইয়ে মিলে খিচুড়ি হয়ে গেছে। বন্যার সময় ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারীদের অনেক সময় খিচুড়ি রেঁধে দেয়া হয়। তখনকার উপদ্রুত পরিস্হিতিতে খিচুড়িই উপাদেয় খাবার বলে বিবেচনা করা হয়। আমরা তো বিপন্ন সময়েই বসবাস করছি! তাই পাঠকরা আমাকে মাফ করে দেবেন, যেমন আমার ভুল দেখিয়ে দিয়েও ক্ষমা করে দিয়েছেন জনাব আশরাফুল হক। আমাকে বকাঝকা করেননি বলে তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




