১। নিশ্চয়ই কাজের ফলাফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল(আল-হাদীস)।কত সুন্দর কথাই না রাসুল (সঃ ) বলেছেন,শুধু মানুষকে পুন্য কাজে/ভাল কাজে উৎসাহ দেয়ার জন্য।কিন্তু দুনিয়াটা অনেক জটিল,জটিল তার মধ্যে বসবাস কারী মানুষ নামের প্রাণীগুলোও।পৃথীবীর অন্য দেশ,অন্য ধর্মের মানুষের দিকে না তাকিয়ে আমাদের নিজের দিকে,নিজের ধর্মের মানুষের কর্মকান্ড নিয়েই দুই একটি কথা বলতে চাই,বলতে চাই সব সময় নিয়ত দিয়ে কাজের ফলাফল মাপা ঠিক নয় বরং ফলাফল দিয়ে নিয়তের পরিশুদ্ধতা যাচাই করতে হয় মাঝে মাঝে।
২। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এলেন এক জাতীয় "কুতুব"।দুর্নিতী আর লুটপাটে যখন দেশে দুর্ভিক্ষ,লাখ লাখ মানুষ শুধু ক্ষুধায় মারা গেল তিনি তাতে ব্যাথিত হলেন।মানুষের দুর্দশা লাগবের জন্য তিনি চিন্তিত হয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি সমাজের মানুষের খোঁজ খবর নেয়া শুরু করলেন। জোবরা গ্রামের জন্মগত entrepreneur বা উদ্যেগতা "সুফিয়া খাতুন"এর কষ্ট দেখে তার মনে দাস প্রথার কথা মনে পরল এবং আরো অসংখ্য সুফিয়াদেরকে সেই দাস প্রথা থেকে মুক্ত করার "ভাল নিয়ত" নিয়ে তিনি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালালেন এবং আশানুরুপ ফলাফলও পেলেন। ফলাফল দেখে তিনি চিন্তা করলেন মাত্র ১৭ডলার সম মুল্যের টাকার বিনিময়ে যদি এত মানুষের মুখে হাঁসি ফোটানো যায়,এত মানুষকে সুখী ও দাস হওয়া থেকে মুক্ত করা যায় তাহলে আরো বৃহত আকারে নয় কেন?? এত দূর পর্যন্ত আমাদের কাছে ঐ কুতুবের নিয়তে কোন সমস্যা দেখা যায়না।এটাই হল আজকের গ্রামীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার গল্প!!
৩। আমার গ্রামের রহিমের(কল্পনা প্রসুত) একটা উদাহরন দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।রহিম দিনে আনে দিন খায় একটা লোক, মানুষের ক্ষেতে কাজ করে দিনে ১০০টাকা কামাই করে কোন রকমে দিন চলে যায়।একটা সময় অল্প অল্প করে কিছু টাকা জমিয়ে ৫ হাজার এক জায়গায় জমা করল এই আশায় যে ৮০০০ টাকা হলে সে একটা রিক্সা কিনবে।একই পরিমাণ পরিশ্রম করে দিন শেষে ২০০টাকা কামাবে এবং বৃষ্টির দিন বাহিরে বেড়ুতে ইচ্ছা
না করলে সে ঘরে বসে খিচুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দেবে।আমি ব্যাচেলর চাকুরীজীবি মানুষ টাকা জমাচ্ছি "বিয়ে" নামক "ব্যাবসার"জন্য পুঁজি তৈরি লক্ষ্যে।আমার কাছে প্রায় ৫লাখ টাকা আছে যেটা ব্যাংকে রেখে দিয়েছি আর মাসে মাসে "লাভ" যোগ হচ্ছে।যেহেতু আমার পুঁজি দরকার প্রায় ১০লাখ টাকা এবং তা
করতে আরো ২বছর লাগবে, আমি রহিমকে বাকী ৩০০০টাকা লোন(ক্রেডিট) দিয়ে একটা রিক্সা কিনে দিলাম এবং বললাম তুমি খিচুড়ি না হয় কিছু দিন পড়েই খেও,এখন কষ্ট করে কাজ করে বাড়তি কামাই করে ৬মাসের মধ্যে আমার টাকাটা ফিরত দিবা,সে রাজি।দিয়েও দিল ৬মাস পর।এখন সে স্বাধীন।
৪।আমি দেখলাম বিষয়টাতো চমৎকার।ব্যাংকে ৫লাখ টাকা রেখে দিলে মাসে হয়ত ৬-৮% লাভ পাই তার চেয়ে এলাকার আরো বেকার "আবুল" যারা আছে তাদেরকে একটা করে
রিক্সা কিনে দিলে তারাও স্বাবলম্বি হতে পারবে,টাকাটাতো পড়েই আছে।
wait a minute!আমি কেন সাহায্য করব?আমি কি হাজি মোঃ মহসিন নাকি? আমার ব্যাবসা করতে হবেনা?কিছু প্রশ্ন মাথায় চলে এল।
ঐদিকে রহিমের সফলতা দেখে কিছু লোক আমার চারেপাশে ঘুরঘুর করছে।আমার "আরো চাই" স্যাকুলার মন আমাকে নতুন বুদ্ধি দিল,টাকা আমি দেব কিন্তু সোয়াব-টোয়াব পড়ে আগে আমার লাভ কি হবে সেই হিসেবে নেমে গেলাম।
৫। প্রথম প্রথম ভয়ে ভয়ে ১লাখ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ১০জনকে
১০টা রিক্সা কিনে দিলাম এবং বললাম ১২ মাস পর
মুলটাকা ১০হাজার + ২হাজার টাকা লাভ আমাকে দিতে হবে।মানুষ কম হওয়ায় সবাইকে মনিটর করাও কঠিন ছিলনা,তাই ১বছর পর সবাই মুল টাকা লাভ সহ ফেরত দিয়ে গেল।আমার সাহস বেড়ে গেল।আমার বিয়ের সময়ও ঘনিয়ে আসছে তাই আরো বেশি টাকা লাভের আশায় পুরো ৫লাখ টাকাই আমি লোন দিয়ে দিলাম।
৬। বেকার সংখ্যা বেশি হওয়ায় এলাকায় আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।লোন প্রার্থি বেশি কিন্তু টাকা সীমিত,আমি ঘোষণা করলাম কে কে লাভ বেশি দিবে তাদেরকে লোন দেয়া হবে।এবার মুলটাকার উপর ৩০০০টাকা লভ্যাংশ দিতে হবে। যারা শর্ত পূরণ করতে পারল তারা লোন নিয়ে গেল কিন্তু সবাই রিক্সা কিনবে এমনটা নয় যে যেটাই করুক বছর শেষে আমার টাকা পেলেই হল। শুরুতে রিক্সার মাধ্যমে রহিম সহ ১০জন সফল হওয়ার অনেকেই সেদিকে এগিয়ে গেল।এলাকায় রিক্সার সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রতিযোগিতাও বেড়ে গেল ফলে রিক্সা ড্রাইবারগন গড়ে যেখানে আগে ২০০টাকা কামাই করত সেখানে এখন করে ১৫০টাকা!! ফলে বছর শেষে সবার পক্ষে মুল টাকাই শোধ করা সম্ভব হলনা।কিছু লোক seasonal কাচাঁ তরিতরকারীর ব্যবসা করেছিল কিন্তু ঐ বছর ফলন বেশি হওয়ায় ব্যাবসা আশানুরুপ হয়নি,কোন রকমে পুঁজিটা উঠে এসেছে,লাভ যেটা হয়েছে সেটা দিয়ে কোন রকমে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা গেছে।
৭। বছর শেষে দেখা গেল ৫০জনের মধ্যে প্রায় ১০জন ডিফল্টার!! আমার বিয়ের জন্য যে টার্গেট নির্ধারণ করা ছিল তাতো উঠলইনা বরং আসল টাকাও পাওয়া গেলনা।আমি তাদেরকে প্রেসার দিলাম টাকা দেয়ার জন্য,একটা পর্যায়ে আমি ওদের রিক্সাতো নিলামই সাথে সাথে ঘরের টিনও খুলে নিলাম।পথের "আবুল"রা আবার পথেই ফিরে গেল,নিস্ব হয়ে, বেকার হয়ে এদিকে সেদিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল, আমার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেল কেউ কেউ। এলাকায় ততদিনে আমার পাওয়ার প্রতিপত্তি বেড়ে বিশাল ব্যাপার কারন আমি কত মানুষকে কাজ দিয়েছি,কত মানুষকে আমি খাওয়াই,অনেকেই "ভার্সুয়ালী" আমাকে অন্নদাতা মনে করে।এলাকার মানুষকে আমি ইচ্ছা মত ব্যাবহার করতে পারি অনেকটা দাসের মত!! শুরুতে মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার নিয়ত নিয়ে কাজ শুরু করলেও আমিই এখন মানুষকে দাসত্বের শিকল পড়াই।
এই হচ্ছে পুঁজিবাদের চরিত্র।এই পুঁজিবাদকে যে নামেই ঢাকা হউক তার চেহারা একই,তার থেকে একই রকম দুর্গন্ধ বের হয় ।পুঁজিবাদের আগে "ইসলাম" লাগিয়ে আজকাল ইসলামি পুঁজিবাদ কায়েম করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি ব্যাংক রয়েছে যাদের পিলসফি হচ্ছে Profit Maximization( লাভ বৃদ্ধি)।চারিদিকে যখন এই ব্যাবসা জমে উঠেছে তখন কেউ কেউ এগিয়ে এল ইসলাম নাম দিয়ে একে হালাল করার জন্য,শুরুতে কিছুটা চমক থাকলেও শেষে একই রকম দুর্গন্ধ বের হতে দেখা যাচ্ছে।
মনে রাখা উচিত কনসেপ্টে কোন সমস্যা নেই কিন্তু প্রেকটিস!!যার কারনে আমার কনক্লুশন যেকোন "কাজের ফলাফলই" হউক নিয়ত বা উদ্দেশ্যের পরিশুদ্ধতা যাচাইয়ের মাধ্যম, অন্তত দুনিয়াবী ইস্যুতে।
Note: লেখাটি একই সাথে সোনার বাংলাদেশ ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




