somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এভাবেই ওরা হত্যা করেছিলো, এভাবেই এরা বেঁচে আছে... থাকে... থাকবেও ?

০৩ রা নভেম্বর, ২০০৭ দুপুর ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রশীদ হায়দার সম্পাদিত '১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা' বই থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ আলীম এর স্ত্রী শ্যামলী চৌধুরীর স্মৃতিকথা 'ক্ষত-বিক্ষত আলীম' লেখাটি পড়ছিলাম। মনে হলো শেয়ার করি। পুরো লেখা দিলাম না... কিছু কিছু অংশ।

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর থেকে যখন ঢাকার ওপর আক্রমণ আরম্ভ হলো তখন হাসপাতালে যেয়ে থাকার জন্য আমরা প্রস্তুতি নিলাম কিন্তু বাদ সাধলো আমাদের বাসার নীচের তলায় আমাদেরই আশ্রিত মৌলানা আব্দুল মান্নান। .......... .......... জুলাই মাসের মাঝামাঝি মৌলানা সাহেব আমাদের সাহেব আমাদের নীচের তলায় এসে আশ্রয় নিলেন। একদিন সকাল দশটার দিকে টিটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দোতলা থেকে দেখি আমাদের প্রতিবেশী তৎকালীন পিডিপির মতীন সাহেব একজন লোক নিয়ে আমার স্বামীর কাছে এলেন। মতীন সাহেব তাকে বললেন- ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছেন। তার ঘরবাড়ী কে বা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তিনি একেবারেই নিরাশ্রয়।
আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও সেদিন আলীম চিরকালের অভ্যাসমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। মৌলানা এক কাপড়ে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে উঠে এলেন আমাদের নীচের তলায়। চক্ষু ক্লিনিকের সবকিছু সরিয়ে দিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। ১৫/২০ দিন পরই মৌলানার আসল চেহারা বুঝতে পারলাম কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়িতে পাকিস্তানী সৈন্যদের আনাগোনা, রাতভর হৈ হুল্লোড়, বন্দুকধারী আলবদরদের পাহারা দেয়া দেখেই বুঝতে বাকী রইলো না যে অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। মৌলানা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আলীমকে ভুলিয়ে রাখলো। তিনি সবসময়ই বলতেন- ডাক্তার সাহেব, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলবোনা। আপনার কোনো ভয় নেই। আপনার কোনো বিপদ হবেনা। যদি কখনও কোনো অসুবিধায় পড়েন, সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমার জীবন থাকতে আপনার কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবেনা।
...................
.....................
১৫ ডিসেম্বরের সকাল তো আর সব দিনের মতোই ছিলো... ... ... ... আলীম, মা আর আমি দোতলার সামনের বারান্দায় বসে দেখছিলাম পিলখানার ওপর প্রচন্ড বোমাবর্ষণ। নিশ্চিত বিজয় সামনে দেখে আলীম আনন্দ আর ধরে রাখতে পারছিলোনা। আচমকা গাড়ির শব্দে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি মাটি দিয়ে লেপা একটি মাইক্রোবাস। থেমেছে মৌলানার গেটের কাছে। মনে কোন শঙ্কা জাগেনি কারণ এধরনের গাড়ি ইদানীং তাঁর বাড়িতে প্রায়ই আসে। আলীম আমাকে উঁকিঝুঁকি না দিয়ে ভেতরে চলে আসতে বলে নিজেও চলে এলো শোবার ঘরে। কিছুক্ষন পরেই দরজায় করাঘাত। ওপরের জানালা দিয়ে দেখলাম দু'জন আলবদর বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে বলছে। আমি আলীমকে জিজ্ঞেস করলাম খুলবো নাকি। সে বললো খুলে দাও। বলেই সে নীচের তলায় মৌলানার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আমি বললাম কোথায় যাও ? বললো মৌলানা সাহেবের কাছে। তিনিতো অসুবিধা হলেই যেতে বলেছেন। আমি বাধা দেইনি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মৌলানার দরজায় সে প্রাণপণে আঘাত করতে লাগলো আর বললো, মৌলানা সাহেব, একটু দরজাটা খুলুন। অনেকবার বলার পরও মৌলানা দরজা খুললেন না। শুধু ভেতর থেকে বললেন আপনি যান আমি আছি। আবার সেই মিথ্যা আশ্বাসকেই বুকে ধরে আলীম চলে এলো। আমাদের গেট থেকে গাড়ি দূরে ছিলো বলে গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যেতে কিছুটা সময় লেগেছিল। সে সময়টুকুতে আমি মৌলানাকে জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে অনুনয় বিণয় করলাম কিন্তু তিনি অনড়, অটল হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। গাড়ি ছাড়ার শব্দ হলো। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তিনি তখন বললেন অস্থির হবেন না। ডাক্তার সাহেবকে আমার ছাত্ররা নিয়ে গেছে চোখের চিকিৎসা করতে। বুঝতে পারলাম, তিনি সবই জানেন। ওপরে এলাম, ভাবলাম কাজ শেষ হলেই আলীম চলে আসবে। .................... .....................
অনেকবার ফোন করে মিসেস রাব্বিকে পেলাম। মৌলানাই বলেছিলেন যে ডাঃ রাব্বিকেও একই সাথে নেয়া হয়েছে। ফোনের ওপার থেকে মিসেস রাব্বির কান্নাভেজা স্বর 'ওরা কি আর ফিরে আসবে' শুনে আমি চমকে উঠলাম। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা এ কথা। মনে হচ্ছিল, না এ হতেই পারেনা, কিছুতেই না। সারাটি রাত জেগে পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ............. ....... সকাল হয়ে গেল। ভাবলাম, রাতে আসেনি, এখন অবশ্যই আসবে। রাস্তার দিকে বারান্দা থেকে যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে থাকলাম। সকাল আটটার দিকে হঠাৎ শুনি 'জয় বাংলা' ধ্বনি চারদিকে। ছাদে ছাদে মানুষ ভরে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়া হলো অনেক বাসায়। ......... ............ ......... কিছুক্ষণ পরই মৌলানা একটি পুঁটলি নিয়ে ওপরে উঠে এসে আমাকে বললেন, একটু আশ্রয় দিন, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। কি বলবো বুঝতে না পেরে তাকে আমাদের খাওয়ার ঘরে চলে যেতে বললাম। ........ ....... ........ .... একজন মুক্তিযোদ্ধা এসএলআর হাতে এসে আমাকে বললো সেই শয়তানটা কোথায় যে আলীম ভাইকে মেরেছে ? আমি অবিশ্বাস্য এই কথাটি শুনে হতভম্ব হয়ে বসে পড়লাম। মনে হলো, না ভুল শুনেছি। ছেলেটি বোধহয় জানেনা। এর মধ্যে কোন ফাঁকে মৌলানা সরে পড়েছেন কেউ টের পাইনি।
.............
......................
১৮ ডিসেম্বর সন্ধান পাওয়া গেল। রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে লাশ হয়ে পড়ে আছে আলীম আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর সাথে। একটি ইটের ভাটায় পড়েছিলো ডাঃ রাব্বি, আলীম, লাডু ভাই এবং আরও অনেকে।
..............
.................
দেখলাম- আলীম ঘুমিয়ে আছে। প্রচন্ড আঘাতের চিহ্ন সারা শরীরে। নিয়ে যাওয়ার সময় চোখ বেঁধেছিল যে গামছা দিয়ে তা গলায় জড়িয়ে আছে। হাত দু'টি পেছন দিকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। গায়ের গেঞ্জি, সার্ট, লুঙ্গি পরাই ছিল। কত কষ্টে তাকে চলে যেতে হলো। যখন ইটখোলায় তাদের সবাইকে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালো, যখন বেয়নেট দিয়ে নৃশংসভাবে ঘাতকরা তাদের দেহ খন্ড বিখন্ড করল, যখন অসংখ্য বুলেট তাদের শরীরকে বিদ্ধ করল তখন কি করলো তারা সবাই ? কার কথা তাদের মনে হলো ? নিজের, আত্মজের কথা, না দেশের কথা, না পেছনে ফেলে আসা জীবনের কথা ? কি অপরাধে তাদের এভাবে চলে যেতে হলো ? আলবদরদের কত ক্রোধ জমা হয়েছিল এদের বিরুদ্ধে ? একটি বুলেটেই তো একজন মানুষ মরে যায় তাহলে কেন এত বুলেট আর বেয়নেটের তীক্ষ্ম ফলা দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করতে হলো তাদের ? আলীম রাব্বি এবং এরা সবাই তো মানবতাবাদী মানুষ ছিল। দেশবাসীর সেবাই ছিল তাদের ধর্ম। বস্তিবাসী, রিকশাওয়ালা এবং দরিদ্র গ্রামবাসী বিনামূল্যে চিকিৎসা আর ওষুধ পেত তাদের কাছে। বন্ধুবৎসল বলে তাঁদের সুনাম ছিল। শত্রুর বিপদেও তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। নিজের দেশের জন্য ছিল অসীম ভালোবাসা। তাই বুঝি প্রাণ দিতে হলো অকালে, তাদের কাছে, যাদের ভন্ডামি আর মিথ্যাচারের জন্য দেশবাসী আজ অতিষ্ঠ। নিরাপত্তাহীন, সম্ভ্রমহীন জীবনযাপনে শঙ্কা অপরহ। মুখ ফুটে সত্য কথনের উপায় নেই। একাত্তরের সেই ঘাতকেরা এখনও এদেশে সক্রিয়। এখনও কী দম্ভে এরা দন্ড-মুন্ডের অধিকার হাতে তুলে নেয় ? আর কতদিন স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে মুখোশ এঁটে মাথা উঁচু করে চলবে এরা ? এদের চিনতে কত দেরি আমাদের ?


*সচলায়তনে প্রকাশিত
২৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×