বারান্দায় চেয়ারে বেশ আরাম করে বসেছেন তালুকদার সাহেব যদিও তার ভিতরে অশেষ ব্যস্ততা কাজ করছে। আজ তার ছোট মেয়ে পপির গায়ে হলুদ। বাসাভর্তি মেহমান, সবার মধ্যে ছোটাছুটি হুড়োহুড়ি। অন্দরের মেয়েরা সাজগোজ, হাড়িপাতিল, রান্নাবান্না আর কন্যাকে নিয়ে ব্যস্ত, বাহিরের কাজ যা আছে সব একাই সামলে নিচ্ছে তার মেজো জামাই। ডেকোরেটার্স, কমিউনিটি সেন্টার, কেনাকাটা আয়োজনের প্রত্যেকটা কাজই সে নিজে করছে অথবা তার কোন না কোন বন্ধুবান্ধব দিয়ে করাচ্ছে। তাকে কোন কিছুতেই হাত দিতে দিচ্ছে না, শুধু কেনাকাটার সময় নিজে একটু জামাইর সাথে গিয়েছিলেন। তার মেজো জামাই রুবেলের কথা, 'আব্বা আপনি বাসায় বসে সব দেখেন, তদারকি করেন, কাজে ভুল হলে আমাকে জানাবেন। চিন্তা করার কোন দরকার নাই, সব ঠিকঠাক হবে।'
বারান্দায় বসে বসে এখন খুটিয়ে খুঁটিয়ে সবার ছোটাছুটি লক্ষ্য করছেন। ডেকোরেটার্সের ছেলেরা বিয়ের তোরণ তৈরী করেছে গলির মুখে, লাইটিং নিয়ে কি যেন সমস্যা ছিল, রুবেলের বন্ধু আবিরকে সব দায়িত্ব দেয়া, সেই ছেলেটা কি যেন ওয়েডিং ম্যানেজম্যান্টের কাজ করে, সেই কোথা থেকে যেন সব ব্যবস্থা করে ফেলছে। বেশ কাজের ছেলে। তার কোন কাজে হাত দিতে হচ্ছে না দেখে মনের ভিতর খচখচানি, খুঁতখুতে ভাবটা কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে, মেজো জামাইর কাজ দেখে পরে খুঁতখুঁতে ভাবটা নিমেষে দূর হয়ে যায়। অথচ তার আগের দুই মেয়ের বিয়েতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিলো। একমাত্র ছেলেটা থাকে আমেরিকা, সেখান থেকে টাকা পাঠিয়েই তার কাজ শেষ। বড়মেয়ে লিপির বিয়ের সময় তো তার একমাত্র নাতনী তাসফিয়া অসুস্থ ছিল তাই আসতে পারে নি ছেলে ও ছেলের বউ। মেজো মেয়ে হ্যাপির বিয়েটা তো দায় সারা ভাবে দেয়া, প্রেমের বিয়ে কারোরী তত মত ছিলো না। ছেলেও আমেরিকা থেকে আসে নি। বিয়ের আগে মেজো জামাইকে তার ততটা পছন্দ ছিল না, ছোট খাটো একটা চাকরি আর তার পাশাপাশি নতুন ব্যবসা ছিল। শুধু মেয়ের জেদের কাছে হার মেনে বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। সাদাসিদে একটা বিয়ে, তার তুলনায় এবার ছোট মেয়ের বিয়েটা বেশ ধুমধাম করে হচ্ছে। আসলে হ্যাপিকে ঠকানো হয়ে গিয়েছে ভেবে খানিকটা তার আফসোস হলো, এটা করা উচিত হয় নি। প্রেমের বিয়েতে যদি মত থাকতোই তবে প্রথমেই লিপির পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া যেত কিন্তু তখন দেন নি, প্রেম ভালবাসার বিয়ে আবার কী! মেয়েরা বিয়ে করবে বাবার পছন্দে, এই নীতির কারনে। হয়ত সেই ছেলের সাথে বিয়ে দিলে ভালোই হত, রুবেলের মতো মিশুক ছেলে হতো হয়তো বা কাজকর্মেও পটু থাকত। সেবার হাসপাতালে চারদিন থাকার সময় প্রত্যেকটা রাত মেজো জামাই হাসপাতালে বসে কাটিয়েছে, আর হ্যাপি তার মাথার পাশে বসে ছিলো। বড় জামাই দুয়েকবার এসে দেখে গেছে, এ পর্যন্তই। বড়লোক জামাইরা আন্তরিক হয় কম, সবকিছুই টাকা দিয়ে মাপতে চায়। মধ্যবিত্ত জামাইরা টাকার অভাবটা আন্তরিকতা দিয়ে পূরণ করতে চায়। অনেকে বুঝতেই চায় না যে টাকার চেয়ে আন্তরিকতা কতটা দামী। এই দুর্দিনে কেইবা কাকে ভালোমন্দের কুশল জিজ্ঞাসা করে। পপির জামাইটা কেমন হবে? বড় জামাইর মতো না মেজো জামাইর মতো? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে তার চোখ লেগে এলো চেয়ারে হেলান দিয়ে তা হয়ত টের পেতেন না যদি না রুবেল এসে তাকে ডাক দিত, 'আব্বা আপনে নাকি চা খাইতে চাইছিলেন? এই নেন ভিতর থেকে আপনার জন্যে স্পেশাল চা নিয়ে আসছি।'
তালুকদার সাহেবের হঠাত্ খেয়াল হলো, তিনি তো বারান্দায় আসার আগে ভিতরে এককাপ চা চেয়ে আসছিলেন লিপির কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:০২