somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিনিক্স পাখির রূপকথা

০৭ ই আগস্ট, ২০১০ সকাল ১০:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাই যখন অনেক আনন্দ নিয়ে লেখে ছেলেবেলার কথা, আমি তখন চুপ করে পড়ি। অথবা শুনি। আমার বলা হয়ে ওঠে না ছেলেবেলার আনন্দ মাখা স্মৃতি। বলব কি করে, নেই যে আমার। সবার তো সবকিছু থাকে না। আবার এই আমারই এমন অনেক কিছু আছে, যা আমার চারপাশের অনেকেরই হয়ত নেই। তাই সেই ছেলেবেলার অনন্দহীনতা নিয়ে আমার অপূর্ণতা নেই।

আমি ছিলেম আমার বাবার ফুলকন্যা, মধুকন্যা, দুধকন্যা আরো কত্ত কী! আর মায়ের মামনি, আম্মু। মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি এতো বেশী বাবাভক্ত ছিলাম, আব্বু যেন একসপ্তাহের জন্য কোথায় ট্রেনিং এ গিয়েছিল, যেদিন ফিরে এলো, সেদিন আমি আব্বুকে ঘিরে খালি ঘুরি আর বলি, আমাত আব্বু! আমাত আব্বু! পুতুলের মত মেয়ে ছিলাম নাকি, একহাতের উপর বসিয়ে সারা কুমিল্লা শহর ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো যেতো। আর ছিলাম খুব দুষ্টু। খুব চঞ্চল। যখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছি, তখন নাকি হামা দিয়েই চারতলার সিড়ি বেয়ে ছাদের দরজায় গিয়ে কাঁদছিলাম। দরজাটা আটকানো ছিল যে। মা আমায় কোত্থাও খুঁজে না পেয়ে হয়রান, শেষে কান্না শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখে, তার দুষ্টু মেয়েটা, যে এখনো হাঁটতেই শেখেনি, সে কিনা বিল্ডিং এর মাথায় গিয়ে বসে বসে কাঁদছে!

তখন আমরা থাকতাম অলিপুরে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। বাসার উলটো দিকে নাকি ছোট ছোট টিলা পাহাড় ছিল। এক বিকেলে, আব্বু তার বন্ধুর সাথে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমি আব্বু দেখে অস্থির। তখন দৌড়াতেও শিখেছি। কখন যে আম্মুর হাত ছেড়ে আব্বুর কাছে যাওয়ার জন্য ছুট দিয়েছি! টিলাটা ছিলো রাস্তার ওপাশে। আব্বু দেখে, তার ফুলকন্যা তার দিকে ছুট দিয়েছে, আর দূর থেকে আসছে একটা মোটর সাইকেল। পাহাড় থেকে পড়ি মরি করে নেমে আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরে। আর এইদিকে, মোটর সাইকেল আরোহীও থামিয়ে দিয়েছিল ভুঁ সাইকেল খানা। মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়েই নাকি সে নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। এই গল্পগুলো সবই শোনা গল্প, আমার স্মৃতির সাধ্যি নেই, এগুলো মনে করার। তখনও আমার বাবা মা তাদের ফুটফুটে রাজকন্যাকে নিয়ে সুখী রাজা-রানী!

আমার বয়স তখন তিন। হঠাৎ করেই একদিন আমার আম্মুর চোখে পড়ে, আমার ডান চোখটা বাঁকা। যাকে মানুষ বলে টেরা। আদর করে বলে লক্ষীটেরা। আব্বু আমায় নিয়ে গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আমায় দেখে টেখে সোজা আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সেইসময়ের নামকরা চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডঃ মোস্তাফিজুর রহমানকে দিয়ে দেখাতে বললেন। আমার কপাল ছিলো মন্দ। ডাক্তার তখন ছিলেন না দেশে। উনার অনুমতি নিয়েই আরেকজন ডাক্তার আমাকে নিয়ে গেলেন অপারেশন থিয়েটারে। ঐ চোখকাটা ঘরে ঢুকেই বুঝলেন, এই অপারেশন তাকে দিয়ে সম্ভব নয়।কেবল আমার ডানচোখের আইরিশে ছোট্ট একটা স্কারমার্কের চিহ্ন দিয়ে আমায় ফিরিয়ে দিলেন। বেড়িয়ে এসে বাবাকে জানালেন, এই অপারেশন সম্ভব নয়। কনজেনিটাল ক্যাটার্যািক্ট! জন্মের ছয়মাসের মধ্যে নির্ণয় করা সম্ভব হলে আমার এই চোখের দৃষ্টি ফেরান যেত। এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে!চিকিৎসাবিজ্ঞান আজো আমার ক্ষেত্রে নীরবই রয়ে গেছে, বোবার মত চেয়ে রয় আমার দিকে।

সুখী রাজা রানীর চোখে মুখে বিষাদের ছায়া। বুকের মাঝে কান্না। দুষ্টু চঞ্চল মায়াবী চখের মেয়েটা যে জন্মেছেই এমন ত্রুটি নিয়ে, তা তারা কল্পনাতেও ভাবেনি। এদিকে আমিও বড় হতে শুরু করেছি।বুদ্ধি হবার পর থেকেই বুঝতে পারলাম, আমার বয়সী বাচ্চারা আমাকে টেরা বলে ডাকে! প্রায় রোজ বিকেলে খেলতে গেলে সেই ডাকটা শুনতে পেতাম। ডাকটা খারাপ কি ভালো বুঝে ওঠার আগেই দেখতাম, আমার বাবা মা শব্দটা শুনলেই মন খারাপ করে ফেলে। আমাকে বিকেলে আর খেলতে বাইরে যেতে দিতে চায় না। ঘরের মধ্যেও দেখতাম, চাচ্চু ফুপুরা কেউ কেউ যেন আমাকে একটু অবহেলাই করে। ঠিক বুঝতাম না। কিন্তু আমিও আস্তে আস্তে হয়ে যেতে লাগলাম অন্যরকম। বিকেল বেলা বের হয়, লজ্জাবতীর ঝোপের সাথে একা একা খেলি। সবুজ ঘাসের মধ্যে ঘাসফুল তুলে বেড়াই। একটু দূরেই একটা মসজিদ ছিলো, তার সামনে ছিল একটা পুকুর। সেই পুকুরে লাল শাপলা ফুটতো। রোজ বিকেলে চলে যেতাম, ফুল ফুটেছে কিনা দেখতে। দেখতাম কলমীর ফুল। দেখতাম প্রজাপতি। ওরাই আমার খেলার সাথী।

আরেকজন ছিল খেলার সাথী, রাসেল। আমার ছোট ছোট হাড়ি, পাতিল, ছোট ছোট পুতুল, এইসব নিয়ে কেবল ওর সাথেই খেলা হত আমার। কদিন পর রাসেলরা কোথায় যেন চলে গেলো। তারও কদিন পর, একদিন রাসেলের বাবা এসে কেঁদে ফেললেন। আমার সাথে রাসেলের যত ছবি ছিলো, সব নিয়ে গেলেন। আঙ্কেল চলে গেলে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসেলের আব্বু কাঁদল কেন আম্মু? আম্মুও কেঁদে ফেললেন। বললেন, রাসেল মরে গেছে। আমি তো বুঝিনা, রাসেল মরে যায় কিভাবে! কি হলে বলে, মরে গেছে, বলে কাঁদে! আম্মুর কান্না দেখে আমিও কেঁদেছিলাম…

বাবা মা বড় শখ করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করেছিল। আমার প্রথম স্কুলব্যাগটা কিনে এনে আব্বু আমাকে বলেছিল, যাওতো, কাঁধে নিয়ে হাঁটতো! সেদিন আব্বুর চোখে যে আনন্দ দেখেছিলাম, আজো মনে পড়ে সেই হাসি। কিন্তু আমিই যে হয়ে গেছি, ফুল, পাখি, গাছ, লতা-পাতার সংগী। আরেকটু বড় হয়ে হলাম বৃষ্টির সংগী, রোদের সংগী!

ছেলেবেলার কথা আমার মনে করতে ইচ্ছে করে না। মনে হলেই আমার সেই রজনীগন্ধা গাছটার কথা মনে পড়ে যায়, আমার আবদারে যেটা আব্বু আমায় এনে দিয়েছিল। তাতে যেদিন প্রথম ফুল ফুটল, আমার ছোট্ট ভাই, হাঁটি হাঁটি পা পা করে হেঁটে গিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে এলো গাছের মাথাটা। মনে পড়ে সেই টাইম রোজ গাছ গুলোর কথা, যেগুলো লাগানোর কদিন পরেই, মুরগীতে ঠুকরে ঠুকরে নষ্ট করে দিয়েছিল। বাঁচেনি সেগুলোও!

এতোগুলো বছর সেই বিষন্ন ছেলেবেলা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার চলাফেরা এতো স্বাভাবিক, আমাকে দেখলে সবাই ভাবে কী উচ্ছল মেয়েটা। দ্যূত্যিতে ঝলমলে! পৃথিবী আমায় অবহেলা করেছিল বলেই, বাবা মায়ের আদরটা পেয়েছি বাড়াবাড়ি রকমে। তাদের বুকে আমায় নিয়ে যে নীরব কষ্ট ছিল, তা আমি একের পর এক মুছে দিয়েছি। তারা আমায় নিয়ে আজ তৃপ্তির হাসি হাসে, গর্বে, অহংকারে।তারা বিশ্বাস করে, তাদের রাজকন্যা সব বাধা উপেক্ষা করে জয় করতে জানে। যারা আমার দিকে তাকাতো অবজ্ঞাভরে, তাদের চোখও আজ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। তারাও ভুলে যায়, অনেকবছর আগের দিন গুলো।

এইতো আমি চেয়েছিলাম, চেয়ে যাবো আজীবন। প্রতিটা দিনকে জয় করার প্রত্যয়ের দিপ্তী!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×