মানুষ যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে তার গুরুত্ব বোঝে সে তখনই যখন অন্য এক পরিবেশের সাথে তার পরিচয় ঘটে। শহরের মানুষকেই প্রকৃতি টানে তাই একটু বেশিই।
আমি আজন্ম শহুরে পরিবেশে মানুষ। তাই শহরের জীবনটাকে আলাদা করে ভালোলাগার কথা মাথায় আসেনি কখনো। বরঞ্চ মনে হয়েছে এখানে সৌন্দর্য উপলব্ধির কিছু নেই। তবে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি এই যান্ত্রিক পরিবেশের মাঝেও আলাদা কিছু নান্দনিকতা আছে।
আমি বর্তমানে যেখানে থাকি ভূমি থেকে তার উচ্চতা প্রায় ৮০-৮৫ ফিট। তবে ঢাকা শহরের খুব ব্যস্ত এলাকায় অবস্থিত বলে এটা এখানে খুবই স্বাভাবিক। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমাদের বাড়ির পাশের বাড়ি গুলো এখনও উঁচু হওয়া শুরু করেনি।তাই ব্যস্ত ঢাকার বেশ খানিকটা অংশ এখান থেকে দেখতে পাই।
আমার বাসাটা খুব আহামরি না হলেও এর আকর্ষণীয় দিক গুলোর একটা হচ্ছে এখানে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত- দুটাই স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে আমরা যখন নতুন এলাম তখন এই ব্যাপারটি আবিষ্কার করে আনন্দে বিহবল হয়ে গিয়েছিলাম। খোলা মাঠে থাকলে যে চিলকে মনে হয় আকাশের কাছকাছি, আমার জানালা দিয়ে তাকালে প্রায়ই পাশ দিয়ে সেই সোনালী ডানার চিল উড়ে যেতে দেখি।
এর পর আবিষ্কার করলাম আরেক আশ্চর্য দিক, তা হল রাতের বেলা একটু দূরের ২০-২২ তলা দালান গুলোতে যখন বাতি জ্বলে, দেখতে দারুণ লাগে। আমি প্রতি রাতে একবার হলেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখি। দেখার সময় মাঝে মাঝে নিজের ভারী চশমাটা খুলে ফেলি-তখন মনে হয় এ এক আশ্চর্য জগত!
আমি আবার নিশাচর। রাত্রি আমাকে অসম্ভব টানে। মাঝে মাঝে এমন হয় আমার বাসার সবাই যখন ঘুম থেকে ওঠে, আমি তখন ঘুমাতে যাই! এমনি এক নিঃসংগ রাতে আবিষ্কার করলাম আরেক অদ্ভুত ব্যাপার! আমাদের একটি জানালা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় বহুল পরিচিত এক ট্রাফিক সিগন্যাল। বৃষ্টির রাত যখন গভীর হয়, যানবাহন গুলো যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে যায়, তখন নিঃসংগ সিগন্যাল বাতির লাল আলো পড়ে বৃষ্টিভেজা চকচকে কালো রাজপথে। এক অপূর্ব অনুভূতি গ্রাস করে আমাকে। মনে হয়, আলোটাই তরল রূপ ধারণ করেছে। এক দৌড়ে রাস্তায় নেমে সেই তরল রঙ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার, একটু গালে লাগানোর অদম্য ইচ্ছাকে মনে মনে হেসে দমন করার চেষ্টা করি।
এরপর থেকে বৃষ্টি হলেই রাতের জন্য অপেক্ষা করি। বৃষ্টির রাতে অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেই খুব মিস করি এটা।
মানুষ নিজের ভালোলাগাকে তার প্রিয়জনের সাথে ভাগ করতে পছন্দ করে, আমি আমার পরিচিত প্রায় সবাইকেই আমার প্রিয় ব্যাপার গুলো ভাগাভাগি করেছি। চেষ্টা করেছি আমার অনুভূতি গুলোকে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আমি মানুষ হিসেবে খুবই যন্ত্রনাদায়ক! তাই বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় আসা অতিথীদের অনেক রাত পর্যন্ত বসিয়ে রেখেছি শুধুমাত্র এই দৃশ্যটি দেখাবার জন্য। তারাও মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেছে। আজ আপনাদের সাথেও আমার এই অদ্ভুত ভালোলাগা গুলো শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না! তবে আমার কাছে প্রকৃতিকে বন্দী করার যন্ত্রটি আপাতত না থাকায় এর আসল অনুভূতিটা দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত।
সময় করে আর এক দিন দেখাবো।