নড়ে চড়ে হাসে খেলে মনের কথা কয়ে.......
আমরা সবাই পুতুল ছাড়া আর তো কিছু নইগো......
নিয়তির লিখন মেনে খেলার পুতুল হই গো..........
সেই ছোট্টবেলা থেকে মা এর মুখে এই গানটা শুনতে শুনতে ভাত খেয়েছি, ঘুমিয়ে পড়েছি..........আর বড় হয়েছি।
আজ জীবনের ২৫টা বছর পেরিয়ে যাবার সময় বুঝতে পারছি কি ভয়ানক সত্যি কথাগুলো ছিল ওই গানটার মধ্যে!!!!
সরকারি চাকরীরত পিতা.....তাই দেশের অনেকগুলো শহর খুব সহজেই আমার আপন হয়ে গেসিল।
আর আমাদের দুবোনের এই এক দোষ......এত সহজে যে মায়া পড়ে যায়.......কালি শেষ হয়ে যাওয়া কলম, পুরোনো ক্লাশের ডায়রী, ছোট হয়ে যাওয়া স্কুল ড্রেস, ছিঁড়ে যাওয়া জামার বোতাম, ইরেজারের শেষ অংশ, খালি সেন্টের শিশি, হ্যান্ডেল ভাঙা পানি খাবার মগ, তাসের জোকার, প্রিয় ক্রিকেটারের ছবির পেপার কাটিং...................এরকম হাজারো জিনিস জড়ো হতে থাকে আমাদের সংগ্রহগারে!! কিছুই যে ফেলতে ইচ্ছা করে না.......সব কিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে আমাদের কোন না কোন স্মৃতি। হয়তো এই পেন্সিলটা বড়মামা দিয়েছিল.....এই কলমটা দিয়ে লিখেই তো রচনাটাতে হাইয়েস্ট পেয়েছিলাম......এটা আমার প্রথম স্কুলের ড্রেস.........কোনটা ছেড়ে কোনটা ফেলি..............................
আমাদের শুধু স্মৃতিই সম্বল.......জীবনের প্রয়োজনে আমরা সবাই যখন একেকটা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছি.............তখন স্মৃতি রোমান্থন ছাড়া আর কিই বা করার আছে??
ক্লাশ আর অফিস সেরে সারাদিন পর হলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি......ঘুমের মধ্যেই ভাবি এখনই হয়তো মা এসে খাইয়ে দেবে.......কিংবা বাইরের কাপড়ে শুয়ে পড়ার জন্য বকাবকি করবে...........কিন্তু না....যখন ঘুম ভাঙে মাথার উপর ঝুলভর্তি ছাদ থেকে উঁকি মারে ১০০ ওয়াটের বাল্ব.......তিনদিকে তিনটে বিছানা, পড়ার টেবিল, এলো মেলো কিছু হাড়ি কড়াই...........আর একলা আমি। গলার কাছে কি যেন একটা দলা হয়ে আসে....চোখদুটো ঝাপসা........উঠে যাই.....টিন থেকে দুটো বিস্কুট বের করে পানি দিয়ে গলধঃকরন করি.......ফিরে যাই নিত্যদিনের কাজগুলোতে......মনে পড়ে এই সেইদিন জন্ম নেওয়া আমার ছোটবোনটাও তো এভাবেই একেকটা দিন পার করছে...........
মফস্বলে কাটানো আমার ছোটবেলা.....ছপছপে কাদামাখা মাঠ....স্কুলে যাবার রাস্তার ধারে পুকুর ভর্তি শাপলা.....ঝুম বৃষ্টিতে শীল কুড়ানোর জন্য মা'র জোর করে উঠোনে ঠেলে দেওয়া, হারিকেনের আলোতে পড়া.....দিনাজপুরের প্রচন্ড ঠান্ডায় ছোটবোনটার নীল হয়ে যাওয়া....ওকে দোলনায় শুইয়ে দোল দেওয়া....ওর কচি হাতে তেলাপোকা ধরে মুখে ভরে দেওয়া......সুন্দরবনে আমাদের বাংলো কোয়ার্টার.....বাসার পাশে হরিণ ছানাগুলো.....মাঝনদীতে ট্রলারে কাটানো একেকটা রাত......বিদ্যুৎবিহীন এলাকায় সারাটারাত ধরে আব্বুর পাখা চালানো....মা'র আচার আর ডালের বড়ি পাহারা দেওয়া....আমাদের লাল-নীল-সবুজ রঙের স্কুল ড্রেসগুলো...বিশেষ দিনে একসাথে চাইনীজে যাওয়া.....২১ আগস্ট আমার জন্য স্পেশাল পুডিং.....শীতের রাতে লেপের নীচে শুয়ে গরম হওয়া........আমার নবাবগঞ্জ.....আমার খুলনা শহর......আমার সুন্দরবন....আরও কত কি.......চোখের সামনে থেকে কি দ্রুতই না সরে যাচ্ছে.............হঠাৎ করেই কি আমি বড় হয়ে গেলাম???
আমি কেন বড় হলাম???
আমরা কেন বড় হলাম???
আমরা আসলেই কি কারো খেলার পুতুল???
সে কেন এভাবে খেলছে আমাদের নিয়ে???
আবারো ঝাপসা হয়ে আসা চোখ..........আবারো একটা যান্ত্রিক দিনের শুরু.......আবারো আরেকটু বড় হয়ে ওঠা.......আবারো চোখে জল......
ধ্যাৎ............