একটা সময় ছিলো, যখন প্রচুর মুভি দেখতাম। মুভি দেখা প্রথম শুরু হয়েছিলো মূলত ইংরেজী শেখার নাম করে। ২০১৪ এর দিকে এসে পরিচয় ঘটে একটা টিভি সিরিজ The Big Bang Theory এর সাথে।
বিজ্ঞান ভিত্তিক কথাবার্তা সহ একটা টিভি সিরিজ হবার কারণে বেশ পছন্দ হলো। দেখা শুরু করলাম। সেই মাপের মজার ছিলো টিভি সিরিজটি। একই সময়ে Friends এবং How I Met Your Mother নামের দুইটা টিভি সিরিজের সাথে পরিচয় হলো।
একটা সময় নিজের ভিতর অস্বস্তি ফিল করা শুরু করলাম। মনে হতে থাকলো এই টিভি সিরিজ গুলি আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আনছে। একটু দেরীই হয়েছিলো পরিবর্তনটা বুঝতে। পরিবর্তনটা হচ্ছে, এগুলি আমাকে শিখিয়েছে মানুষকে অপমান করতে!
জ্বী, সব গুলি টিভি সিরিজেই কাহিনীর সাথে সাথে একটা বিষয় খুব সুন্দর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে অপরকে অপমান করা। বিশেষ করে The Big Bang Theory এর প্রায় প্রতিটি ডায়লগই অন্য কাউকে অপমান করা টাইপের। দেখে আপনার কাছে প্রচন্ড হাস্যরসের মনে হবে। তবে যদি নিজেকে ঐ লোকের জায়গায় দাড় করাতে পারেন, তখন বুঝবেন যে কতটা খারাপ লাগার মত কথা বলা হয় প্রতি লাইনেই!
আমরা মানুষ হিসাবে বেশীরভাগই অন্যকে সামান্য খোঁচা দিয়ে বা খোঁটা দিয়ে মজা পাই। একটু অপমান করতে পারলে মজা আরও বাড়ে।সেই জিনিষ গুলি আমাদের ছোটখাট গন্ডির মধ্যে এক সময় আবধ্য ছিলো। কিন্তু ইন্টারনেটের কারণে এখন সেই গন্ডি ছড়িয়ে গেছে। আমরা এখন পাড়া-মহল্লা বা জেলায় সীমাবদ্ধ নই, পুরা পৃথীবিতে ছড়িয়ে পড়েছি।
কোথায় কোন হিরো আলম, আর কোথায় কোন পরীমনি; কোথায় মার্ক জুকারবার্গ আর কোথায় ইলন মাস্ক; আমরা কাউকে ছাড়িনি। আস্তাকুড় থেকে কাউকে তুলে এনে তাকে ব্যাঙ্গ করতে করতে এখন তারাই আমাদের সমাজে হিরো হিসাবে বসে গেছে! আমরা মজা করেই যাচ্ছি। কোন থামাথামি নাই।
এর মধ্যে গজিয়েছে কিছু লেখক নামের লোক; যারা খুবই নাম করা। এনাদের কাজ হচ্ছে প্রচন্ড সিরিয়াস কোন বিষয়কে মজার খোরাক হিসাবে উপস্থাপন করা। এরা এই কাজটি সমাজের জন্য প্রচন্ড ক্ষতিকর। কেন?
জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ সেকশনে গেলে দেখবেন দেয়ালে বড় করে পত্রিকার কাটিং দেওয়া আছে। দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থায়ও মানুষ বেবি ট্যাক্সির ভাড়া বাড়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে এমন নিউজ পাবেন সেখানে। আর আমরা এখন কি করছি? পেয়াজের দাম বেড়ে গেছে, পেয়াজ নিয়ে টিকটক ভিডিও বানাচ্ছি; না হয় ফেসবুকে মজার ছবি বা স্ট্যাটাস পোষ্ট করছি।
সৈরাচার শাসককে কান ধরে টেনে নামানো ছাত্র সমাজ এখন 'পুলিশ কোন চ্যাটের বাল' লেখা প্লাকার্ড নিয়ে ঘুরে! ঐ পর্যন্তই তাদের দৌড়।
আপনার কি ধারণা এমনে এমনে ছাত্র সমাজ হিরো থেকে হিজড়াতে পরিণত হয়েছে? না, আমরা যারা সিরিয়াস বিষয়কে ফান হিসাবে উপস্থাপন করি, আমরা এর পিছনে দ্বায়ী।
একটা সময় ছিলো যখন পাড়ায় বড় ভাইয়েরা ঢুকলে ছোট কেউ ধূমপান করতে থাকলে তা লুকাতো। কখনও কখনও দৌড় দিতো। এখন সেটা উল্টে গেছে; বড় ভাই গিয়ে ছোটদের কাছে সিগারেট চায়; ছোটরা মুখের উপর বলে দেয় যে সিগারেট নাই। বড় ভাই চলে যাবার সময় পিছ থেকে ছ্যাচ্চড় গালিও শুনতে পাওয়া যায় কখনও কখনও।
এভাবে একে অন্যের সাথে মজা করে বেয়াদবি করতে করতে আমরা একটা বেয়াদবির কালচারের মধ্যে ঢুকে গেছি। যে যত বেশী অন্যকে পচাঁতে পারে, সে এখন তত বড় হিরো। যে যত বেশী ব্যাঙ্গ করতে পারে, সে তত বেশী লাইক পায়।
পরিচিত-অপরিচিত মানুষের উপর যে নূন্যতম সম্মান ভাবটা কয়েক বছর আগেও দেখা যেতো; এখন তা বিলুপ্ত প্রায়। আপনি বেছে খুটে কিছু সাগরেদ জমিয়ে নিন, তাদের সমালোচনা না করে তাদের তালে তাল দিয়ে চলুন, অন্যকে কটাক্ষ করুন, পারসোনাল এট্যাক করুন; দেখবেন আপনার সাগরেদেরা আপনাকে সাথ দিয়ে "এমন কথা বলার দরকার আছে" বলে চিৎকার করে উঠবে।
আমরা একটা কথা বুঝতেই পারি না; অন্যকে অপমান করতে করতে আমরা আমাদের নিজেদের সেল্ফ রেসপেক্ট হারিয়ে ফেলেছি। বন্ধুদের মধ্যে একজন আর একজনকে মাদার*দ বলে গালি দিলে সেও তাকে একই গালি দিয়ে দাঁত ক্যালায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১:৩২