ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্ম্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কাল্চার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।
ধর্ম্ম মানে জীবনের নিয়ন্ত্রণ। মার্জ্জিত আলোকপ্রাপ্তরা কাল্চারের মারফতেই নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করে। বাইরের আদেশে নয়, ভেতরের সূক্ষ্মচেতনাই তাদের চালক, তাই তাদের জন্য ধর্ম্মের ততটা দরকার হয় না। বরং তাদের উপর ধর্ম্ম তথা বাইরের নীতি চাপাতে গেলে ক্ষতি হয়। কেননা তাতে তাদের সূক্ষ্ম চেতনাটি নষ্ট হয়ে যায়, আর সূক্ষ্মচেতনার অপর নাম আত্মা।
সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত কাল্চারের উদ্দেশ্য নয়- উপায়। উদ্দেশ্য, নিজের ভেতরে একটা ঈশ্বর বা আল্লা সৃষ্টি করা। যে তা করতে পেরেছে সে-ই কালচার্ড অভিধা পেতে পারে, অপরে নয়। বাইরের ধর্ম্মকে যারা গ্রহণ করে তারা আল্লাকে জীবনপ্রেরণা রূপে পায় না, ঠোঁটের বুলি রূপে পায়। তাই শ’র উক্তিঃ Beware of the man whose God is in the skies- আল্লা যার আকাশে তার সম্বন্ধে সাবধান। কেননা, তার দ্বারা যে কোন অন্যায় ও নিষ্ঠুর কাজ হতে পারে। আল্লাকে সে স্মরণ করে ইহলোকে মজাসে জীবন যাপন করার জন্য আর পরকালে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে, অথবা স্বর্গে একটা প্রথম শ্রেণীর সিট্ রিজার্ভ করার আগ্রহে- অন্য কোন মহৎ উদ্দেশ্যে নয়। ইহলোকে ও পরকালে সর্ব্বত্রই একটা ইতর লোভ।
অপর দিকে কাল্চার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে অন্যায় আর নিষ্ঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। নিষ্ঠুর হয়ো না- এই তাদের ভেতরের দেবতার হুকুম আর সে হুকুম তারা তামিল না করে পারে না, কেননা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই একটা ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করা কাল্চারের উদ্দেশ্য। যেখানে তা নেই সেখানে আর যাই থাক্ কাল্চার নেই। কাল্চার একটা ব্যক্তিগত ধর্ম্ম। ব্যক্তির ভেতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ।
কাল্চার সমাজ-তান্ত্রিক নয়, ব্যক্তি-তান্ত্রিক। নিজেকে বাঁচাও, নিজেকে মহান করো, সুন্দর করো, বিচিত্র করো এ-ই কাল্চারের আদেশ। এবং এই আদেশের সফলতার দিকে নজর রেখেই তা সমাজ-তন্ত্রের সমর্থক। সমাজতন্ত্র তার কাছে লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ্য। কাল্চার ব্যক্তিতান্ত্রিক একথা বল্লে এ বুঝায় না যে, কাল্চার্ড মানুষ সমাজের ধার ধারে না, সে দলছাড়া, গোত্রছাড়া জীব। তা নয়, সমাজের ধার সে খুবই ধারে। নইলে প্রাণ পাবে কোত্থেকে? ব্যক্তি তো নদী, সমাজ সমুদ্র। সমুদ্রের সঙ্গে যোগ-যুক্ত না হলে সে বাঁচবে কী উপায়ে? সুতরাং নিজের স্বার্থের দিকে নজর রেখেই কালচার্ড মানুষ সমাজের কথা ভাবে, এমন কি দরকার হলে সমাজের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত থাকে। সংস্কৃতিবান মানুষ ব্যক্তিতান্ত্রিক এই অর্থে যে, সমাজ বা অর্থনীতির কথা ভেবে সে নিজের অসৌন্দর্য্যকে ক্ষমা করে না। এই সমাজে, এই অর্থনীতির অধীনে এর চেয়ে বেশী সুন্দর হওয়া যায় না, এ কথা বলে নিইজেকে কি অপরকে সান্ত্বনা দিতে সে লজ্জাবোধ করে। সে চায় নিজের সৌন্দর্য্যবোধের সম্পূর্ণ উন্মোচন, নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ বিকাশ। নিজের কাছ থেকে ষোল আনা আদায় করে না নিতে পারলে সে খুশী হয় না। এই জন্য শুধু সমাজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রকাশ করা তার মনঃপূত নয়। কেননা তাতে জীবনের গভীরতর স্তরের ধ্যনকল্পনার সম্পূর্ণ প্রকাশ ব্যাহত হয়, এবং নিভৃতবাসী অন্তর-পুরুষের সাক্ষাৎকার সম্ভব হয় না। জীবনের শ্রেষ্ঠ ও বহুভঙ্গিম প্রকাশ নিজের দিকে তাকিয়েই হয়, সমাজের দিকে তাকিয়ে নয়। অত্যধিক সমাজচেতনা মানুষকে একপেশে ও প্রমাণ-সাইজ করে রাখে- মানুষের চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে অন্তরায় ঘটায়। সমাজের আদেশঃ দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না। এগারোদের সে সহ্য করে না- যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে। কালচারের আদেশঃ দশের মধ্যে এগারো হও, দশের মধ্যে থেকেই নিজেকে নিজের মতো করে, সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর করে ফুটিয়ে তোল। তাতেই হবে তোমার দ্বারা সমাজের শ্রেষ্ঠ সেবা, যদিও সমাজের বিরক্তি-ভাজন হওয়াই হবে তোমার ভাগ্য।
বাকিটা টাইপ করা শেষ হয়নি। অচিরেই দিয়ে দেবো।
আর পারলে মি চৌধুরীর প্রবন্ধের বইটা (সংস্কৃতি কথা) কিনে পড়ে ফেলুন।