ওয়াশিংটন ডিসি'র আন্তর্জাতিক আমেজ এখানে বসবাসকারী কারও কাছে তেমন অজানা নয়। পৃথিবীর প্রায় ১৭৫টি দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশন রয়েছে ডিসিতে। শুধু আমেরিকার রাজধানী নয়, বরং বিশ্বের রাজধানী হিসেবে ডিসি'র কূটনৈতিক পাড়ার পরিচিতি ও স্বীকৃতি রয়েছে। গত বছর থেকে শুরু হওয়া "পাসপোর্ট ডিসি " হচ্ছে এখানকার সবচেয়ে বড়ো আন্তর্জাতিক উৎসব। ডিসির বিদেশী মিশনগুলো এদিন তাদের দ্বার উন্মুক্ত করে দর্শনার্থীদের জন্য। এ বছর পাসপোর্ট ডিসি নামে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেয় প্রায় ৩০টি দেশ। গতবারের মতো এবারও বের হলাম পাসপোর্ট ডিসি'র এই উৎসব দেখতে। আমার গন্তব্য সৌদী দূতাবাস থেকে শুরু করে বাংলাদেশ দূতাবাস পর্যন্ত।
প্রথম গন্তব্য সৌদী দূতাবাস। কেনেডী সেন্টারের পাশে আর বিখ্যাত ওয়াটার গেটের কাছে সৌদী দূতাবাস। আধা ঘন্টার মধ্যে চলে এলাম দূতাবাসের সামনে। দশ মিনিট এদিক সেদিক ঘুরে ঠিক দূতাবাসের সামনে একটা ফাঁকা পার্কিং স্পেস সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম। যথারীতি সদর দরজা পেড়িয়ে ভবনে ঢুকতে গিয়ে দেখি সিকিউরিটি চেক। অবশ্য আগেই বলে রাখি একমাত্র সৌদী দূতাবাসেই সিকিউরিটি চেক। ক্যামেরা/চাবি স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে হলওয়েতে পাসপোর্ট ডিসি'র একজন ভলিন্টিয়ার অভ্যর্থনা জানাল। হাতে একটা কাউন্টার। সমাগত দর্শকদের মাথা গুনছে। ঢুকতেই দেখি এক সৌদী কর্মকর্তা কা'বা শরীফের বিশাল বাঁধাই করা ছবির সামনে একজন দর্শনার্থীকে হজ্জ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলছেন।
এর পর অভ্যর্থনা কক্ষের মাঝে অনেকে মনোযোগ দিয়ে আপাদমস্তক আবৃত এক সৌদী মহিলার কাছ থেকে আবাইয়া (বোরখা) সম্পর্কে বিশদ বিবরণ শুনছেন। অন্য কক্ষে অতিথিরা সৌদী পোশাক আর মহিলারা আবাইয়া পড়ে ছবির পোজ দিচ্ছে। অন্যপাশে একজন সবুজ বেলুন ফুলিয়ে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
সৌদী দূতাবাস দেখা শেষ করে যাত্রা শুরু করলাম ম্যাসাচুসেটস এভিনিউ'র দিকে। এই রাস্তার দুপাশে রয়েছে বিদেশী দূতাবাসগুলো। কিন্তু আমার গন্তব্য নেপালের দূতাবাস। সেখানে ঢুকতেই দেখলাম এক নেপালী মেয়ে প্রণাম করে অভ্যর্থনা করছে অতিথিদের। একপাশে টেবিলে সাজানো রয়েছে নেপালের তৈরী তৈজসপত্র। মন্দির, ছুরি, মূর্তি, আর পেতলের তৈরী থালা বাটি।
নেপালী দূতাবাসের কাছেই ইরাকের দূতাবাস। প্ল্যান করেই এসেছিলাম যে ইরাকী দূতাবাসে যাব। কিন্তু দূতাবাসের সামনে আসতেই মনে পড়ল সে আর হচ্ছে না। অনেক লম্বা লাইন। ইরাকী দূতাবাসে গিয়ে দেখার ব্যাপারে আমেরিকান আকর্ষণ আর ফেসিনেশনটা অস্বাভাবিক নয়। কয়েকমিনিট সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলাম গাড়ী নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে। ভেতরের থার্টি ফোর্থ স্ট্রীট ধরে ভ্যাননেসে রাইট করে ডানে মোড় নিয়ে এলাম ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভের উপর। ডিসির ভেতরের অলিগলি রাস্তা জানা থাকলে মূল সড়কের যানজট এড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাস্তায় হালকা ট্রাফিকে চলা যায়। গত পনের বছর ধরে ডিসিকে জানার এটাই বাড়তি সুবিধে। এই রাস্তার উপর বাংলাদেশ সহ বেশ অনেকগুলো দূতাবাস রয়েছে। ভাগ্যক্রমে এখানেও বিনা কসরতে পার্কিং পেয়ে গেলাম।
গাড়ী থেকে দু'কদমে চলে এলাম ইথিওপীয়ান দূতাবাসে। দূতাবাসের আঙ্গিনায় হ্যান্ডিক্রাফটের দোকান। মেঘলা দিনের কারণে এবার আর ইথিওপীয়ান কফির আসর বসেনি। ভেতরে ঢুকে বেশ ভীঁড়। একপাশে একজন আর্টিস্ট তার তৈরী চিত্রকর্ম নিয়ে বসে আছেন। লম্বা এই ফেব্রিকের কাজটির দাম সাড়ে তিন হাজার ডলার। দাম দেখেই বুঝলাম বনেদী শিল্পী। আলাপকালে তার পেপার কার্টিং দেখেই বুঝলাম, শিল্পীর কদর তার বাণিজ্যিকীকরণের সাফল্যের উপর নির্ভর করে। এখানে এসে সবচেয়ে মজা পেলাম, দূতাবাসের বিশাল হলরুমের পুরোটাই টেবিল দিয়ে খাবার রেস্টুরেন্টে রুপান্তরিত হয়েছে। পয়সা দিয়ে লোকজন ইথিওপীয়ান খাবার খাচ্ছে। পাসপোর্ট ডিসি'র সুবাদে নানা দেশের হরেক রকমের খাবারের বিচিত্র স্বাদ চেখে দেখার এই বিরল সুযোগকে হেলা করা কি ভোজনবিলাসীদের সাজে? তবে এখানে পাসপোর্ট ডিসি'র আমেজকে ইথিওপীয়ান ক্যুজিনের সফল বাণিজ্যিক রুপান্তরন খুব চোখে ঠেকল!
ইথিওপীয়ান দূতাবাসের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। মেঘলা দিনে টিপ টিপ করে বৃস্টি পড়ছে। তার মাঝে ঢুকতেই চোখে পড়ে মাননীয় রাস্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের উষ্ণ অভ্যর্ভনা। তারপরে দাড়িঁয়ে আছেন দূতাবাসের কাউন্সিলর জনাব শামীম আহসান। বেলা প্রায় দু'টো বাজে। প্রচুর দর্শনার্থী। বেশ চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে দূতাবাসের আঙ্গিনা। বাংলাদেশের স্টলে রয়েছে দেশীয় পণ্যের সমাহার। বিক্রির জন্য নয়। আগ্রহভরে দর্শনার্থীরা দেখছেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বেশ ব্যস্ত অতিথিদের সাথে আলাপনে। বাংলাদেশে দেশী পণ্য কিনে আমরা কতোটা ধন্য হই তা বলতে না পারলেও বিদেশের ভিনদেশীদের কাছে দেশীয় পণ্যের কদর দেখে নিজের প্রাণ আনন্দে ভরে যায়।
বিদেশে বাংলাদেশ যতো পরিচিত হবে বাংলাদেশ নিয়ে বাড়বে ততো আগ্রহ। যেমনটা নিউজার্সী থেকে আসা বয়োবৃদ্ধা মিস লিন্ডা বললেন, "বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে গেছে। এতো ঐশ্বর্য ও চাকচিক্য রয়েছে বাংলাদেশের। রং-এর বাহার"। আমাদের হস্তশিল্পের রং-এর ছটা বিদেশীদের নজর বেশ টানে। বাংলাদেশী প্রকাশনা, পোস্টার আর পর্যটন নিয়ে টেবিলগুলো বেশ তথ্যসমৃদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ দূতাবাসে কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেই ফাঁকে আর ক'টা দূতাবাস দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
তারপরে চলে এলাম বাংলাদেশ দূতাবাসের পাশে অবস্থিত ঘানার দূতাবাসে। দূতাবাসের বাইরে খাবারের দোকানে বিক্রি হচ্ছে। গতবারের মতো এবারও ঘানার তৈরী পোশাক আর তৈজসপত্র বিক্রি হচ্ছে। দূতাবাসের ভেতর এই কাঠের সিঁড়িটা খুব চমকপ্রদ। হলরুমে গিয়ে দেখি একজন ড্রাম বাজাচ্ছেন আর ক'জন দর্শনার্থী সেই ড্রামের তালে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমোনোর ব্যর্থ কসরৎ চালাচ্ছেন।
এবার হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম পাকিস্তানী দূতাবাসে। আঙ্গিনায় রয়েছে পাকিস্তানী ড্রেসের দোকান। একপাশে খাবারের দোকানে লাইন ধরে খাবার কিনছেন। অন আর অন্যপাশে এক তবুলচে তবলায় শব্দের কারুকার্য তুলছেন হাতের ছন্দময় স্পর্শে। ভেতরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে দেয়ালে টাঙ্গানো নেতাদের ছবি দেখছেন। পাকিস্তানের জাতির জনক কায়দে আজমের ছবির পাশে এখনকার রাস্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে ইতিহাসের পাতা উল্টাতে মন চাইল না।
বেরিয়ে চলে এলাম সামনের মালয়েশীয় দূতাবাসে। আঙ্গিনায় সারি সারি খাবারের দোকান। দর্শনার্থীরা খাবার কিনে বাইরে বসে খাচ্ছেন। ভেতরে ঢুকে মালয়েশিয়ার পর্যটনের টেবিলটা বেশ নজর কাড়ল। প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আবদুর রহমানের কাঠের তৈরী আবক্ষমূর্তি চোখে পড়ল। বাইরে এসে বরফকুচি দিয়ে আইসক্রীমের দোকানটা চোখে পড়ল। গুঁড়া মাছের শুটকি, একটু ভাত, আর সব্জী দিয়ে সাজানো মালয়েশিয়ান খাবার। তারমাঝে কাবাবের দোকানে সাতাই ক্ষিধেটা উস্কে দিলেও কাবাবাবের সাইজটা পছন্দ হলো না।
মালয়েশীয় দূতাবাস থেকে বেরিয়ে চলে এলাম সামনে নাইজেরিয়ান দূতাবাসে। গতবারের হতচ্ছারা ছবিটা এবার নেই। বেশ জনাকীর্ণ। বিশাল সাইজের এই চিত্রকর্মটা বেশ চোখে পড়ার মতো। এখানেও খাবার কেনার জন্য লম্বা লাইন। সামনে একটা ব্যান্ড পার্টিতে গান গাচ্ছে ক'জন তরুন। তাতে সর্বোচ্চ ভলিউমে আর উচ্চলয়ে বাজানো ব্যান্ড কানের কাছে অসহ্য মনে হচ্ছিল। শব্দযন্ত্রণা কি ভয়াবহ!! এখানেও হস্তশিল্পের দোকান। তাতে দু'চারজন কিনছেন।
এখান থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে এলাম বাংলাদেশ দূতাবাসে। দর্শনার্থীর ভীঁড় আরও বেড়েছে। শুরু হলো বাংলাদেশী শিশু শিল্পীদের নৃত্য প্রদর্শনী। লোকগীতির সাথে সেলাম বাবু জানিয়ে নাচ জমিয়ে রাখল দর্শনার্থীদের। নাচ-গান ছাড়া বাংলাদেশের প্রকাশ অসম্পূর্ণ। সুর আর শব্দের দ্যোতনায় আমাদের চিরন্তন প্রকাশ। ছন্দে খুঁজে পাই আমরা আনন্দ। নৃত্য পরিবেশনার সাথে সাথে গানের সুরে ছন্দবদ্ধ নৃত্য মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। অনেকেই জানাল, আবারও আগামী বছর তারা বাংলাদেশ দূতাবাসে ফিরে আসবেন।
খাবারের মধ্যে ছিল কাচ্চী বিরিয়ানী, সালাদ আর বুন্দিয়া। না, পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি। অত্যন্ত উপাদেয়। এবার অন্তত চেখেই বলছি। দূতাবাসের একান্ত আয়োজনে ও কর্মকর্তাদের বদান্যতায় প্রকাশ পেল বাংলাদেশের অতিথিবৎসলতার চিরন্তন নিদর্শন। সম্ভবত: একমাত্র বাংলাদেশই অন্যদের দেখাতে পারে অতিথিবৎসল হওয়ার জন্য আর্থিক প্রাচুর্যের খুব দরকার নেই, দরকার হচ্ছে বৃহৎ হৃৎপিন্ডের অধিকারী হওয়ার। প্রায় সাড়ে তিন হাজার দর্শনার্থী এবার শুধু বাংলাদেশ দূতাবাসেই এসেছিলেন। সংখ্যাটা পাসপোর্ট ডিসি'র সংগঠক ও ভলিন্টয়ারের কাছ থেকে নেয়া। দর্শনার্থী সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন।
এবারের বাড়তি আয়োজন ছিল হাতে মেহদী ডিজাইন দেওয়ার আয়োজন। অনেকে ধৈর্য ধরে লাইনে দাঁড়ান বাংলাদেশি মেহদীর ডিজাইন হাতে এঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারই একজন ছোট সিমোন দূতাবাসের বাইরে তার হাতের ডিজাইন আমাকে দেখাচ্ছিল। খুবই আনন্দিত সে। সকাল দশটা থেকে দূতাবাসের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী হাসিমুখে অতিথিদের আপ্যায়ন করেছেন।
বেরোবার পথে মাননীয় রাস্ট্রদূতের সাথে আলাপ হলো আবারও। বেলা তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। তখনও দর্শনার্থীরা আসছেন। মাননীয় রাস্ট্রদূত হুমায়ুন কবির সহাস্যে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছেন। সোয়াইন ফ্লু'র এই আতঙ্কিত সময়ে সবার সাথে হাত মেলানো যথেস্ট সাহসের কথা। বিশেষ করে আজকে সারাদিন ধরেই স্থানীয় রেডিও'র শিরোনাম ছির, সোয়াইন ফ্লু'র আতঙ্কের কারণে বাহরাইন দূতাবাস ডিসি পাসপোর্টের উৎসবে যোগ দেয়নি।
আলাপকালে মাননীয় রাস্ট্রদূত জানালেন, বাংলাদেশকে আমেরিকার সাধারণ জনগণের কাছে তুলে ধরার এই সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে তিনি খুবই আনন্দিত ও গর্বিত। বিশেষ করে সারাদিন ধরে এই হাজার হাজার দর্শনার্থীদের কাছে বাংলাদেশকে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমেরিকার ঘরে ঘরে বাংলাদেশকে আরও পরিচিত করে তোলা সম্ভব হবে। ডিপ্লোম্যাটিক মিশনগুলো এধরণের বিশাল ক্রাউড ম্যানেজমেন্টে অভ্যস্ত নয়। তারপরও এই প্রচেস্টা এক দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে বলে তিনি আশাবাদী। গতবারের মতো এবারও শুধু বাংলাদেশ দূতাবাসেই মাননীয় রাস্ট্রদূত কর্তৃক উষ্ণ অভ্যর্থনার বিরল সুযোগ পেয়েছেন সমাগত দর্শনার্থীরা।
বেরুতে গিয়ে মনে হলো, বাংলাদেশ দূতাবাসের এই অন্তরঙ্গ আতিথেয়তার নিদর্শন ডিসি'র কূটনৈতিক পাড়ায় বাংলাদেশকে ব্যতিক্রমী ধারায় তুলে ধরবে যা আগামী দিনে বাংলাদেশকে অনেক আমেরিকানের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসবে। খরা, বন্যা ও দুর্যোগের নেতিবাচক শিরোনামে অভ্যস্ত এখানকার অনেককে কেবল ইতিবাচক অভিজ্ঞতা ও আত্মিক স্পর্শ দিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা পাল্টে দেওয়া সম্ভব হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০০৯ সকাল ৭:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




