somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : ‘ফিরে ফিরে আসে’

২৫ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
অনেক আগে থেকেই রাহেলা কানে কম শোনেন। বিশেষ করে বাম কানে। রাহেলা তাঁর মার নিকট থেকে জেনেছেন, ছোট বেলায় তাঁর মারাত্মক টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল; সেই জ্বরের পর থেকেই তাঁর কানে কম শোনার সমস্যা শুরু হয়। কানে কম শোনার সমস্যা সমাধানের জন্য ছোট বেলায় রাহেলার বাবা-মা রাহেলাকে অনেক গ্রাম্য ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছেন। কিন্তু কানে কম শোনা সংক্রান্ত সমস্যার কোন সমাধান হয়নি। রাহেলা কানে কম শোনেন বলে, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাঁর সাথে ছোটবেলা থেকেই চিৎকার করে কথা বলে। বিষয়টি রাহেলা মানসিকভাবে মেনে নিয়েছেন এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে নিজেকে সেভাবেই অভ্যস্ত করে নিয়েছেন।
কিন্তু এই শেষ বয়সে এসে কিযে হলো রাহেলার! সামান্য ঠান্ডা-সর্দি-কাশি-জ্বড় হলেই হঠাৎ করে কানে বেশি শুনতে শুরু করেন। বেশি মানে, ভালোই বেশি। সচরাচর যে সব শব্দ রাহেলার কানে আসলেও বুঝতে পারে না, সে সকল শব্দই তখন সে শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারে। ঠান্ডা- জ্বর ভালো হয়ে গেলে আবার যা হওয়ার তাই। যথারীতি কানে কম শোনার সমস্যা ফিরে আসে। গত চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল এই সমস্যার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শীতের শুরু ও গরমের শুরুর দিকে এই সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে।
বেশি শোনার সমস্যা ফিরে আসলে রাহেলার খুব অস্থির লাগে। বিশেষ করে মাথায় খুব খারাপ লাগে। সকল শব্দ যেন ধারালো ছুরি হয়ে তাঁর কানের মধ্যে আঘাত করে। সেই আঘাত খুবই মর্মান্তিক এবং কষ্টদায়ক। মাঝে-মধ্যে মনে হয় রাহেলা পাগল হয়ে যাবেন।
রাহেলার বয়স কত হবে! বাষট্রি-তেষট্রি। তবে বয়স অনুপাতে তাঁর শরীর স্বাস্থ্য ভালো। দেখে মনে হয় না রাহেলার বয়স ষাট অতিক্রম করেছে। বছর পনেরো আগে ডায়াবেটিস ধরা পড়লেও, রাহেলার অতিরিক্ত স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে তাকে তেমন দুর্বল করতে পারেনি। রাহেলার তিন ছেলে-মেয়ে। আসাদুল, নার্গিস ও ছোট ছেলে কামরুল। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে কানাডায় থাকেন। মেয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেছেন। বিয়ে করেছেন তারই এক ব্যাচ মেট ডাক্তারকে। বর্তমানে তারা ঢাকায় থাকেন। ছোট ছেলে কামরুল সোনালি ব্যাংকের ম্যানেজার। টাঙ্গাইলে পোস্টিং। রাহেলা ছোট ছেলের সাথে টাঙ্গাইল শহরে থাকেন।
বছর তিনেক আগে হঠাৎ করে তার স্বামী ফখরুদ্দিন মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই রাহেলার জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। রাহেলা দিনকে-দিন কেমন দুর্বল হয়ে পড়ছেন। সামান্য সর্দি-কাশি-জ্বর ভালো হতেও এখন অনেক সময় লাগছে।
গতবছর শীত শুরু হওয়ার সময় রাহেলার হঠাৎ করে ঠান্ডা লেগে যায়। সেই ঠান্ডা লাগা আর ভালো হতে চায় না। ঠান্ডা লাগার কয়েকদিন পরেই হঠাৎ করে একদিন রাহেলার কানে বেশি শোনার সমস্যা প্রথম দেখা দেয়। কানে বেশি শোনার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রাহেলা তাঁর ছোট ছেলে কামরুলকে নিয়ে ঢাকায় মেয়ের বাসার থেকে নাক-কান-গলার বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন। ডাক্তার বলেছে, রাহেলার কানের পর্দায় সমস্য। ঠান্ডা লাগলে রাহেলার কানে ইনফেকশন হয়, তখন কোন এক অজানা কারণে তাঁর শ্রবণ শক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যেহেতু রাহেলা দীর্ঘদিন যাবৎ কানে কম শুনছেন, তাই স্বাভাবিক কানে শোনাটাই তাঁর কাছে বেশি শুনছেন বলে মনে হচ্ছে। এজন্য তিনি কষ্ট পাচ্ছেন।
ডাক্তার বলেছে অপারেশন করলে রাহেলার কানের এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তিন ছেলে-মেয়েই রাহেলকে অপারেশন করানোর জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু রাহেলা রাজি হয়নি। অপারেশনের কথা শুনলে রাহেলার ভয় লাগে। এই শেষ বয়সে এসে কানে শোনা সংক্রান্ত সমস্যার জন্য আর অপারেশন করাতে চান না। রাহেলার আগ্রহ নেই দেখে ছেলে-মেয়েও তাকে আর তেমন জোড় করেনি।
২.
এবছর শীত যেন একটু তাড়াতাড়িই পড়ে গেল! সকালের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। কাঁথা গায়ে দিতে হয়। এমন আবহাওয়ায় গত বছরের মতো এবছরও শীত পড়ার শুরুতেই রাহেলার ঠান্ডা লেগে গেল। তাও বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল ঠান্ডা লেগেছে রাহেলার। মাথা ভার হয়ে থাকে। হালকা কাশিও আছে। ছোট ছেলে কামরুল জোর করে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো ঔষধও খাচ্ছে। কিন্তু এবারের ঠান্ডা লাগা সহজে ভালো হচ্ছে না রাহেলার।
গতকালকে জোরে কাশি দিয়ে গলার কফ পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ করে কানের তবদা ভাবটা কেটে গেল। আর তারপরে থেকেই রাহেলা আবার কানে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। পরিষ্কার শুনতে পারাটাকেই তাঁর মনে হচ্ছে কানে অনেক বেশি শুনছেন। পাশের রুমে থাকা ছোট ছেলে কামরুল ও ছেলের বউ মেঘলার মধ্যেকার কথাবার্তাও রাহেলা এখন পরিষ্কার শুনতে পারছে। যেটা সে সচরাচর শুনতে পায় না।
ছোট ছেলে কামরুলের বিয়ে হয়েছে তাও বছর দুয়েক হয়ে গেল। ওদের পছন্দের বিয়ে। কামরুলের এই বিয়েতে রাজি ছিল না রাহেলা । সবার আগ্রহের কারণে বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয়েছে রাহেলাকে। এখনও ছোটবউয়ের কোন সন্তান হয়নি। সেজন্য তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। কিন্তু কেন যেন কামরুলের বউ মেঘলাকে রাহেলার পছন্দ না।
রাহেলার জন্য সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, ছোট বউয়ের সাথে সামান্য ঝগড়া হলেই সে রাহেলার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ডাকলেও জবাব দেয় না। অথচ ঝগড়া না করলে, শাসন করতে না পাড়লে কিংবা অন্যও কারও নামে দুর্নাম করতে না পারলে রাহেলার সময় ভালো কাটে না। এটা রাহেলার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
ছোটবউকে শায়েস্তা করার জন্য ছেলে কামরুলের কাছে তাঁর বউয়ের আচরণ সম্পর্কে বানিয়ে-বানিয়ে অনেকবার মিথ্যা নালিশ করেছে রাহেলা। এমনভাবে বউয়ের দুর্নাম করেছে যে, মায়ের কথা বিশ্বাস করে কামরুল তাঁর বউয়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে। সেজন্য রাগ করে ছোটবউ বেশ কয়েকবার তাঁর বাবার বাড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। কিন্তু তাঁর জেদ কমেনি। এতকিছুর পড়েও ছোটবউ রাহেলার শাসনে নত হয়নি।
কামরুল ব্যাংকে চলে যাবার পর, কাজের মেয়ে ফরিদাসহ তিনটি মেয়ে মানুষ সারাদিন বাসায় থাকে। প্রয়োজনে কাজের মেয়ে ফরিদার সাথে দু’একটি কথা বাদে সারাদিন কথা বলার মতো রাহেলার কেউ নেই। রাহেলার বয়স হয়েছে। নানা বিষয় নিয়ে বউদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এখানেতো আর কেউ থাকে না। আর ছোট বউ থেকেও নেই। সেতো তাঁর সাথে কথাই বলে না ঠিক মতো।
রাতে কামরুল বাসায় ফিরলে তাঁর সাথে দু-একটি কথা হয়। এছাড়া সারাদিন মুখ বুজে পড়ে থাকতে হয়। এইভাবে মুখ বুজে পড়ে থাকতে কারইবা ভালো লাগে! তাছাড়া কানে বেশি শোনার সমস্যা দেখা দেওয়ার পর মেজাজটা কেমন খিটমিটে হয়ে থাকে রাহেলার। কিছুই ভালো লাগে না। শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না।
মন ভালো না থাকায় একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আজ সন্ধ্যার সময় ছোট বউয়ের সাথে ঝগড়া করলো রাহেলা। অনেক দিনের জমানো ঝগড়া যেন একসাথে উগড়ে দিল। বউকে ইচ্ছামতো বকাঝকা করল। তারপর এসে লাইট বন্ধ করে তাঁর রুমে শুয়ে পড়ল। শুয়ে-শুয়েই ছোটবউয়ের নামে নালিশ করার জন্য মেয়ে নার্গিসকে ফোন দিল। নার্গিস ফোন ধরলো না। ইদানীং মেয়েও তাঁর ফোন ঠিকমতো ধরে না। রাহেলা বুঝতে পারছে না যে, শুধুমাত্র ছোট বউয়ের নামে নালিশ করার জন্য ফোন করাটা মেয়ে আর পছন্দ করছে না। বড় ছেলে, ছেলের বউ সাত দিন কিংবা পনেরো দিন পর-পর দেশের বাইরে থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও কল দেয়। এই ভিডিও কলের একটি বড় অংশ জুড়েই থাকে ছোট ছেলে কামরুল এবং তাঁর বউয়ের নামে বিভিন্ন অভিযোগ। বড় ছেলে আসাদুলও এখন অনেকদিন পরপর তাকে ফোন দেয়। রাহেলা এগুলো বুঝতে পারে না।
রাত নয়টার মতো বাজে। অন্যদিন হলে এই সময়ে রাহেলা ড্রইংরুমে বসে টেলিভিশনে খবর দেখতো। আজ জোর করে শুয়ে আছে। শুয়ে-শুয়েই রাহেলা তাঁর রুম থেকে কামরুলের বাসায় ঢোকার শব্দ শুনতে পেল। তাঁর মানে তাঁর কানের বেশি শোনার সমস্যা ভালোভাবেই ফিরে এসেছে। কামরুল বাসায় ঢুকেই সরাসরি বাথরুমে চলে যায়। বামরুমে ঢোকার আগমুহূর্তে কামরুল তাঁর বউকে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে তোমার? মেঘলা কোন উত্তর দিল না। কাজের মেয়ে, ফরিদার গলা শোনা গেল। ফরিদা বলল, খালাম্মার সাথে ঝগড়া হয়েছে। কামরুল বলল, আবার ঝগড়া? কি নিয়ে? কামরুলের এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিল না। কামরুল বাথরুমে ঢুকে গেল। রাহেলা তার রুম থেকেই আজ সবকিছু পরিষ্কার শুনতে পেল। রাহেলা এই প্রথম কানে বেশি শোনার সুবিধা বুঝতে পাড়ল এবং অবাক হয়ে গেল। এত দূরের শব্দও সে কেমন পরিষ্কার শুনতে পাড়ছে! রাহেলা কান খাড়া করে অপেক্ষা করলো, ছোটবউ তাঁর নামে কামরুলের কাছে আরও কি কি বলে।
ছেলে কামরুল বাথরুম থেকে বের হলো। বের হয়ে অন্যান্য দিন গামছা দিয়ে মুখ মুছতে-মুছতে মায়ের রুমে ঢুকে, মায়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। আজ রাহেলার রুমে না ঢুকে চলে গেল বউয়ের রুমে। কামরুল ঢোকামাত্র এই প্রথম মেঘলার গলা শোনা গেল। মেঘলা চিৎকার চেচামেচি করে বলল, আমি আর পারছি না। এই বাসায় হয় তোমার মা থাকবে, নইলে আমি। তারপর সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বলতে শুরু করল ছোটবউ। রস-কস মিশিয়ে ছোটবউ অনেক সত্য-মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাঁর মায়ের নামে কামরুলের কাছে নালিশ করল। সবকিছু পরিষ্কার শুনতে পেল রাহেলা। রাহেলা তাঁর রুম থেকে উঠে গিয়ে যে বউয়ের কথার প্রতিবাদ করবে, সেই কথা ভুলে গেল। তাকে যেন আজ শোনার নেশায় পেয়ে বসেছে। ওদের রুম থেকে কামরুল রাহেলার রুমের দিকে আসছে। রুমে ঢুকে রাহেলার অন্ধকার ঘরের লাইট জ্বালালো কামরুল নিজেই। তাকে চিৎকার করে ঢাকলো। সে ভয় পেয়ে গেল। রাহেলাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, কামরুল তাঁর মায়ের সাথে বউয়ের সাফাই গেয়ে অনেক কথা বললো। খারাপ ব্যবহার করলো। বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় অথবা অন্য কোথাও চলে যেতে বলল। রাহেলা কোন কথা বলল না । কোন জবাব দিল না। শুধু চুপ করে শুনল। এই প্রথম ছোট ছেলে মায়ের সাথে এরকম ব্যবহার করলো। রাহেলা কেমন চুপ করে পড়ে থাকলো বিছানায়। কামরুল ইচ্ছামতো মাকে দোষারোপ করে একসময় রাহেলার রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আজ না খেয়েই রাহেলা শুয়ে থাকলো। এক বুক অভিমান রাহেলার বুকে চেপে বসেছে। ছোট ছেলে ও বউয়ের ওপর যতটুকু না অভিমান হচ্ছে, তাঁর থেকে নিজের ওপরই নিজের অভিমান হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
৩.
অনেক রাত হয়েছে। তবু রাহেলার ঘুম আসছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে একবার বাথরুমে গেল। বাথরুম থেকে ফিরে কামরুলের জ্বালানো লাইট আবার বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আশে-পাশের কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশের পরিবেশও কেমন নীরব। দূরে কোথাও একটি কুকুর ডাকার শব্দ শোনা গেল। কুকুরের সেই ডাক রাহেলার কাছে খুব করুন মনে হলো। এই করুন ডাক শুনে রাহেলার মনে মৃত্যু চিন্তা ভর করল। তার স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছে। লোকটা রাহেলকে খুব পছন্দ করতো। বিয়ের পর থেকে প্রকৃত স্বামী হিসেবে যা যা করা উচিত, তাই করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তাঁর স্বামী। রাহেলা যা বলেছে, তাই অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছে। কিন্তু সে কি ফখরুদ্দিনের যত্ন নিতে পেড়েছে! স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছে। আরও কত কথা মনে পড়ছে আজ।
রাহেলা মুন্সি বাড়ির মেয়ে ছিলেন। বাবা আলতাফ মুন্সি কৃষি কাজ করতেন। অনেকগুলো ভাই বোন ছিল তারা। লেখা পড়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাহেলার তেমন লেখা-পড়া হয়নি। তাছাড়া মুন্সি বাড়ির মেয়ে বলে পর্দা প্রথার বেড়াজালে স্কুলেও যাওয়া হয়নি তার। অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বাড়ির কাছের একটি মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত দাখিল পরীক্ষাটাও দেওয়া হয়নি। রাহেলা দেখতে খুবই সুশ্রী ছিলেন। দেখতে-শুনতে সুন্দরী বলে অল্প বয়সেই রাহেলার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ে হয় পাশের গ্রামের ফখরুদ্দিন তালুকদারের সাথে। ফখরুদ্দিন টাঙ্গাইল শহরের একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিলেন। বিয়ের পরেই রাহেলা স্বামীর সাথে টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন।
টাঙ্গাইল শহরে আসার পর শহরের কলেজ রড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন। তাঁর স্বামী ফখরুদ্দিন খুব মা ভক্ত ছিলেন, তাই বিয়ের পড়ে গ্রামের বাড়ি থেকে মাকেও সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাদের টাঙ্গাইলের বাসায়। বিয়ের পর রাহেলার শাশুড়ি রাহেলাকে রান্না-বান্না থেকে শুরু করে হাতের কাজসহ সংসারের সকল কাজ হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বড় ছেলে আসাদুল জন্ম নেওয়ার পরে বলা যায় রাহেলার শাশুড়িই বড় করেছেন।
রাহেলার শাশুড়ি খারাপ মানুষ ছিলেন না। তবে খুব কড়া স্বভাবের মানুষ ছিলেন। রাহেলাকে সব সময় শাসনের উপর রাখতেন। এই শাসন রাহেলার ভালো লাগতো না। তাই আসাদুলের জন্মের তিন বছর পড় যখন রাহেলার দ্বিতীয় সন্তান নার্গিসের জন্ম হলো, তখন সে আস্তে-আস্তে শাশুড়ির একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করতে শুরু করেন। রাহেলা স্বামী ফখরুদ্দিনের কাছে নিয়মিতভাবে মায়ের নামে অভিযোগ করতে শুরু করেন। বানিয়ে-বানিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করতে করতে একসময় ফখরুদ্দিন রাহেলার কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। শাশুড়িকে জব্দ করতে পেরে রাহেলা বেজায় খুশি হয়ে ওঠেন। তাঁর শাশুড়ি রাহেলার কুটজালে জব্দ হয়ে যান। শেষ সময়টা তাঁর ভালো কাটেনি। বলা যায়, রাহেলার কারণে অবহেলায় মারা যান শাশুড়ি। চল্লিশ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল। সেই একই ঘটনা ঘটল আজ রাহেলার সাথে ঘটল। সেদিন রাহেলা ছিলেন মেঘলায় জায়গায় আর তার শাশুড়ি ছিলেন রাহেলার জায়গায়। পার্থক্য শুধু সময়ের। রাহেলার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে কান্না যেন থামতেই চায় না। কেন এরকম অন্যায় হলো। নিজের উপর নিজের খুব ঘেন্না হচ্ছে।
হঠাৎ করে রাহেলার খুব অস্থির লাগছে। শরীর ঘামছে। রাহেলার বুকের মধ্যে খুব ব্যথা করছে। মারাত্মক ব্যথা। কামরুল, মেঘলাকে অনেক ডাকার চেষ্টা করলো রাহেলা। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারল না। পরের দিন যখন জ্ঞান ফিরলো। রাহেলা দেখল সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে অনেক লোকজন। কামরুল ও নার্গিসকে চিন্তে পারলো। কিন্তু মেঘলাকে দেখতে পেল না। মেঘলাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে এবং বলতে ইচ্ছে করছে, ‘মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার জীবনে যেন এমন দিন না আসে।’ কারণ সব কিছু ফিরে ফিরে আসে...

(আমার লেখা এই ছোটগল্পটি ফরিদপুর শহর কেন্দ্রিক সাহিত্য আড্ড ও বইপাঠের সংগঠন ‘বইঘাটা/ঘাঁটা’ থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগ “সাঁতার” এর একুশে বইমেলা-২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস-পরীক্ষার হলে দেরিঃ পক্ষ বনাম বিপক্ষ

লিখেছেন BM Khalid Hasan, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



বর্তমানের হট টপিক হলো, “১ মিনিট দেরি করে বিসিএস পরীক্ষার হলে ঢুকতে না পেরে পরীক্ষার্থীর স্বপ্ন ভঙ্গ।” প্রচন্ড কান্নারত অবস্থায় তাদের ছবি ও ভিডিও দেখা যাচ্ছে। কারণ সারাজীবন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭



ছবি সৌজন্য-https://www.tbsnews.net/bangla




ছবি- মঞ্চে তখন গান চলছে, মধু হই হই আরে বিষ খাওয়াইলা.......... চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী গান।

প্রতি বছরের মত এবার অনুষ্ঠিত হল জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা-২০২৪। গত ২৪/০৪/২৪... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

×