১ম পর্ব - Click This Link
---বাবা আপনার নাশতা রেডি। খেতে আসেন।
রত্নার ডাকে বাস্তবে ফিরে এলেন সালাউদ্দিন।
----তোমাকে কতবার বললাম বউমা আগে সজলকে খাইয়ে বিদেয় করতে। ছেলেটার অফিসের দেরি হয়ে যাবে যে।
----দেরি হবে না বাবা। আপনি খাওয়া শুরু করুন। তারটাও এই হয়ে গেলো বলে।
সালাউদ্দিন মনে মনে ভাবেন, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। শ্বশুরকে না খাইয়ে স্বামীকে সে কিছুতেই খাওয়াবে না। তিনি সকালে রুটিটা খেতে পারেন না। খিচুড়ি খান। তো এই মেয়ে আগে তার জন্য খিচুড়ি করবে তারপর সজলের জন্য রুটি।
সালাউদ্দিন আর কথা না বাড়িয়ে খেতে বসলেন। সজলও অফিসের জন্য রেডি হয়ে টেবিলে এসে বসলো। রত্না চটপট হাতে রুটি বেলতে লাগলো। সেই ফাঁকে বাপ ছেলে টুকটাক কথা বলে নিচ্ছেন। রুটি বেলতে বেলতে রত্নার মনটা সজলের জন্য মমতায় ভরে উঠে। সজল পাতলা পাতলা রুটি খেতে ভালবাসে। তাই যতটা সম্ভব রুটিগুলোকে পাতলা করে বেলছে রত্না।
এমন না যে রুটি মোটা হলে সজল রাগারাগি করবে। বরং রুটি একটু মোটা হলেও ও চুপচাপ খেয়ে নেয়। কোন কথা বলে না। তাও রত্না রুটিটা একদম পাতলা করে বেলবে গভীর মমতা নিয়ে। কারন এই পাতলা রুটিটা থেকে ছোট ছোট টুকরা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে আলু ভাজি পুরে মুখটায় দিতেই সজলের মুখটায় যে একটা মোলায়েম হাসি ফুটে ওঠে, সেই হাসিটাকে রত্না বড্ড ভালবাসে। সেই হাসিটা দেখার জন্যই প্রতিদিন মমতা মাখিয়ে এই পাতলা পাতলা রুটি বেলার প্রাণান্ত প্রয়াস ওর। যত দিন যায় রুটিটা যেনো তত বেশি করে পাতলা হয়। সজলের মুখের হাসিটাও তত বেশি মোলায়েম হয়।
-------
তওফা ফুড প্রোডাক্ট। মোহনপুরের বিখ্যাত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় আটাশ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। শুরুটা হয়েছিল একটি ম্যাঙ্গো জুস দিয়ে। ধীরে ধীরে তওফা ম্যাঙ্গো জুস জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যায়। সারা দেশব্যাপী এর নাম ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে আর পেছন ফেরে তাকাতে হয়নি। বাড়তে থাকে প্রোডাক্ট। বাড়তে থাকে শাখা প্রশাখা। এখন প্রায় পঁচিশটিরও বেশি খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন করে এরা।
তওফা ফুডের দুই কর্ণধার ফারুক হোসেন ও তাহের মাহমুদ হাসতে হাসতে কেবিনে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। আলাদা কেবিন থাকলেও বেশির ভাগ সময় দুই বন্ধু এক কেবিনেই থাকেন। দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল কোন একটা ডিল নিয়ে।
----যাক ডিলটা শেষ পর্যন্ত ফাইনাল হয়ে গেলো।
বললেন ফারুক হোসেন। তাহের মাহমুদ বললেন,
----হ্যাঁ, তা তো হলো। কিন্তু ফুড ইন্সপেক্টর বেটা বড্ড ঝামেলা করছে কদিন ধরে।
----যত লাগে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দাও। কী আর করবে। সময়টাই যে এখন ঘুষখোরদের। ঈদে আমাদের প্রোগ্রামটার কী হলো বলো তো? সবাই কিন্তু আশা করে বসে আছে।
----আমাদের দুজনের ফেমিলিতে সব মিলিয়ে সদস্য বিশজন। বিশজনের জন্য স্টার সিনেপ্লেক্সের টিকেট সংগ্রহ করা কি চাট্টিখানি কথা! তাও ঈদের আগ মুহূর্তে! ওরা বলছে সব টিকেট বুকড।
----তাহলে কি প্রোগ্রাম বাতিল?
----বাতিল হবে কেন? এইটা বাংলাদেশ। এখানে নাই বলতে কিছু নাই। ব্ল্যাক মার্কেট আছে না। টাকাটা একটু বেশি লাগছে এই যা।
----শালার ঘুষখোর আর কালোবাজারিতে দেশটা ছেয়ে গেলো। চারিদিকে শুধু করাপশন আর করাপশন।
----তা যা বলেছ।
----আচ্ছা শোনো, আমাদের এই ডিলটা কিন্তু খুব ইমপরট্যান্ট। সজলকে সব ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে। ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে। অফিসিয়াল কাজ বুঝাতে বুঝাতেই দেড় মাস চলে গেলো। এখন সময় এসেছে ফেক্টরির কাজ বুঝিয়ে দেয়ার।
ফারুক হোসেন ইণ্টারকমে সজলকে কেবিনে আসতে বললেন। একটু পরেই সজল কেবিনে এসে ঢুকলো। ফারুক হোসেন সজলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
----শোন, এই ডিলটা খুব ইমপরট্যান্ট আমাদের জন্য। সুতরাং খুব সতর্কতার সাথে সব খেয়াল রাখবে।
----স্যার, একটা কথা বলি।
----হুম, বলো।
----স্যার আমরা যে প্রোডাক্ট তৈরি করছি তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকর। আমাদের জুস গুলোতে পঁচানব্বই শতাংশই ঘনচিনি আর স্যাকারিন থাকে।
----সারা দেশজুড়ে আমাদের প্রোডাক্টের নাম। আর তুমি বলছ সেগুলো ক্ষতিকর?
----স্যার, ঘনচিনি স্যাকারিন এসব স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। তাছাড়া আমাদের জুসে ব্যবহার করা হচ্ছে মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সোডিয়াম সাইক্লামেট, কাপড়ের রং, সাইট্রিক এসিড ও সোডিয়াম বেনজোয়িক এবং পটাশিয়াম। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে খেলে কিডনির সমস্যাসহ নানা ধরণের রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। এমন কি ক্যান্সারের ঝুঁকিও মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে চলেছে এই জুসগুলো।
----তোমাকে এইসব জ্ঞান দেয়ার জন্য চাকরিতে রাখা হয়নি। লেকচার বন্ধ করো আর যে কাজ দেয়া হয়েছে সেই কাজ গিয়ে ঠিকমত করো।
----জ্বী স্যার।
বলে মাথাটা নুইয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো সজল। তার বিবেক তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে দংশন করে চলেছে। কিন্তু বহু কষ্টে পাওয়া এই চাকরিটা সে ছাড়তেও পারছে না।
----আগেই বলেছিলাম এমন আদর্শবান বাপের ছেলেকে কাজে রেখো না। এখন দেখো পরিণাম।
----আরে এই সব আদর্শ কোথায় ভেসে যায় দেখো। নতুন তো। বয়সটাও কম। রক্তটা একটু টগবগে। নতুন বিয়ে করেছে। সংসারটা একটু বাড়ুক। দায়িত্ব বাড়ার সাথে সাথে এই সব সততা পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেটা খুব ব্রাইট। আমাদের অনেক কাজে লাগবে। আমি ওকে বুঝেই রেখেছি।
------
এম পি বোরহান উদ্দিন চৌধুরীর গাড়ির বহর এসে থামলো মোহনপুরের আলিশান চৌধুরী ভিলার সামনে। কয়েকজন ছেলে দৌড়ে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে অতিশয় বিনয়ী ভঙ্গিতে দরজার পাশে দাঁড়ালো। পেছন থেকে ভীড়ের ধাক্কায় বার বার পড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছে। কিন্তু পড়তে পড়তেও ঠিকই নিজেদের ভারসাম্যটা বজায় রেখে চলেছে তারা, সেই সাথে বিনয়ীভাবেরও এতটুকু নড়চড় হচ্ছে না। আরেকদল ছেলে ধমকে ধমকে ভীড়টাকে দুই পাশে সরিয়ে বোরহান উদ্দিনকে পথ করে দিচ্ছে। বোরহান উদ্দিন ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলেন। তার ঠোঁটের কোণে লেগে আছে অমলিন হাসির রেখা। ডান হাতটা উঁচিয়ে সমাগত জনতার উদ্দেশ্য নাড়লেন তিনি। হাত নাড়তে নাড়তেই একটু ঝুঁকে পি এ আজাদের কানের কাছে মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে বললেন,
----ত্রিশজনের একটা লিস্ট করে টাইম দিয়ে দাও। বাকিগুলোকে কাটিয়ে দাও। আমি একটু আরাম করতে এখানে এসেছি। ছাগল ঠেলতে না। বুঝে শুনে লিস্ট বানিয়ো।
কথাগুলো বলছেন ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার তখনো সম্মুখে জনতার দিকে আর মুখের হাসিখানা অক্ষত।
রচনাকাল- ১৮-০৪-২০১৮
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:০১