somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাসনা ছুরি - ০২

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১ম পর্ব - Click This Link

দুই

তিনকোণা শরীরটা লাঠি হাতে ত্রিভূজাকৃতি ধারণ করেছে। কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। ত্যানা ত্যানা ময়লা শতচ্ছিন্ন শাড়িখানা কোনরকমে দুই প্যাঁচে শরীরটাকে ঢাকতে পেরেছে। খটখটে হাতখানা শক্ত করে ধরে রেখেছে লাঠিটাকে। লাঠিতে ভর দিয়ে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে হাতখানা অবিরত কাঁপছে। হাতের কাঁপনে লাঠিটাও তাই স্থিরতাবজায় রাখতে পারছে না। দুইদিকে হেলেদুলে বুড়ির সাথে সাথে এগোচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে গেলো শরীরটায়। কোমরটায় বড় ব্যথা। নাহ, আর হাঁটা যাচ্ছে না। এবার একটু না জিরোলেই নয়। চোখের উপরে হাত দিয়ে ছায়ার সৃষ্টি করে অদূরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে বুড়ি। কপালটা কুঁচকে আন্দাজ করে বটগাছটা আর বেশি দূরে নেই। এবার ঐ বিশাল বটগাছটার ছায়ায় বসে একটুখানি জিরোবে সে। আর মাত্র কয়েক কদম। একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা শুরু করলো বুড়ি।

কোনরকমে বটগাছটার নিচে এসে আরাম করে ছায়ায় বসলো। একটা নেড়ি কুকুর মাটি শুঁকে শুঁকে কুঁইকুঁই শব্দ করতে করতে এসে বসলো বুড়ির পাশে। বুড়ি নেড়িটার শরীরে হাত বুলিয়ে দিলো। বুড়ি হাত বুলিয়ে দিতেই নেড়িটা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই পায়ের উপর মাথাটা রেখে একেবারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। একটুখানি বসতেই দপ করে যেন নিভে গেলো দিনের আলোটা। বিকেলটা মরে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো বুঝি। আর বসা যাবে না । উঠতে হবে এবার। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে ডেরায়। বুড়ি কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠি ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। বুড়িকে উঠতে দেখে কুকুরটাও উঠে দাঁড়ায়।

আজকাল সন্ধ্যা হলেই সব অন্ধকার লাগে মায়া বুড়ির। আগে একটু যাও দেখতো, এখন তাও দেখে না। সন্ধ্যা হলেই সব আলো নিভে আসে বুড়ির চোখে। তবু লাঠি দিয়ে ঠাহর করে করে হাঁটতে থাকে বুড়ি। সাথে সাথে হাঁটে নেড়ি কুকুরটাও। বুড়ি হাঁটতে হাঁটতে কুকুরটার সাথে কথা বলে।
---হগলতে তো আমারে ছাইড়া চইলা গেলো। তুইও চইলা যা।
কুকুরটা হাই তুলে বুড়ির দিকে তাকায়। একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ তোলে।। বুড়ি আবার বলে,
--- জানি রে, জানি। তুরও বড় দুশ্ক অন্তরে। মুইর লাহান।
কুকুরটার চোখ দুটো যেন ছলছল করে। কুউউউউউউ কুউউউউউ করে কান্নার মত একটা শব্দ করে কুকুরটা। সন্ধ্যার কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে এরই মধ্যে। মায়া বুড়ির চোখের আলোও সেই সাথে নিভে গেছে।


আন্দাজ করে করে করিম মিয়ার দোকানের পেছনের বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালো বুড়ি। আজকাল এখানে ঠাঁই হয়েছে ওর। বস্তি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পর মাথা গুঁজারও একটা ঠাঁই ছিল না। শেষ পর্যন্ত ঐ করিম মিয়া দয়া করে শুধু রাতটা এই বারান্দায় কাটানোর অনুমতি দিয়েছে বুড়িকে। বুড়ি বারান্দার কোণা থেকে ভাজ করা দুটি চটের বস্তা, একটা ছেঁড়া কাঁথা আর একটা তেল চিটচিটে বালিশ বের করে। এই হলো বুড়ির সম্পত্তি। একটা বস্তা বারান্দার এক কোণায় নিজের জন্য বিছায়। আরেকটা বস্তা কিছুটা দূরে কুকুরটার জন্য বিছিয়ে দেয়। কুকুরটা সেই বস্তায় হাঁটু মুড়ে বসে মাথাটা হাঁটুতে রাখলো আবার। ওর চোখে এখনো জল চিকচিক করছে। বুড়ি অন্ধের মত চোখ পিটপিট করে হাতড়ে হাতড়ে ঝুলি থেকে একটা পলিথিন বের করলো। পলিথিনে কিছু ভাত আর বাসি তরকারি। বুড়ি আবার থলির ভেতরে হাত দিলো। বেরিয়ে এলো একটা রঙচটা, জঙ ধরা, বহু পুরোনো এলুমিনিয়মের থালা। পলিথিনের খাবারগুলো ঐ থালায় ঢাললো সে। আবার থলের ভেতরে হাত দিতেই বেরিয়ে এলো কয়েকটা বিস্কুট আর ব্রেড। সেখান থেকে দুইটা বিস্কুট কুকুরটাকে দিলো। আর কয়েকটা বিস্কুট সকালের জন্য রেখে দিতে দিতে বলল,
---বিস্কুটটা কে দিসে জানস? তিতলি বুজান। মাইয়াডা বড় ভালা। আমারে ম্যালা আদর করে।

কুকুরটা ঘড়ঘড় শব্দ করে মাথা তুলে বিস্কুটটা খেলো। আবার হাঁটুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বুড়ি থালাটা হাতে নিয়ে ভাতটা খেয়ে নিলো। মায়া বুড়ির চোখ দুটো দিয়ে অনবরত জল ঝরছে। বুড়ির চোখদুটো দিয়ে কাঁদলেও জল ঝরে, না কাঁদলেও জল ঝরে। মনে হয় চোখে বড় কোন সমস্যা হয়েছে। চোখের জল মুছতে মুছতে বুড়ি বলে,
---মরার চউখ। কানতে কানতে জীবনটা শেষ হইল। অহন আর কান্দন নাই। দিলটা শুকায় গেসে। তারপরেও চউখ কান্দন ভুলে নাই। আমি না কান্দলেও চউখ দুইটা ঠিক অই কাইন্দা যায়।
কুকুরটা আবার কেঁদে উঠে, কুউউউউ, কুউউউউ। বুড়ি খাওয়া শেষ করে ছেঁড়া কাঁথাটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলে,
---কান্দিস না। কাইন্দা কী হইবো ক বাছা। সবই হইল কপাল। আমরা যারে আকড়াইয়া ধইরা বাছতে চাই হেই আমরারে ছাইরা চইলা যায়। এইডাই জীবনের নিয়ম। এই যে সব হারাইয়া আইজ তুই আমারে আকড়াইয়া ধরসস আর আমি আকড়াইয়া ধরসি তরে, কয়দিন পরে হয় আমি মইরা যাইমু না হয় তুই আমারে ছাইড়া চইলা যাইবি। বুঝলি?"

নেড়িটা কী বুঝে কে জানে। মাথাটা তুলে বুড়ির দিকে তাকায়। তারপর আবার কুউউউউ কুউউউউ করে কাঁদে। বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেড়িটার জন্য। এই তো কদিন আগেই ছয়টা বাচ্চা প্রসব করে নেড়িটা। শফিক মিয়ার বাড়ির পাশের ঝোপটায়। বাড়ির লোকেরা বাচ্চা ছয়টাকে বস্তায় ভরে নিয়ে ফেলে আসে একটা খালের পাশে। সেদিন সারাদিন বৃষ্টি পড়ছিল থেমে থেমে। ছানাগুলো সব ভিজে একাকার। নেড়িটার তখন পাগল হবার দশা। একবার ছানাগুলোর কাছে আসে তো আরেকবার ছানাগুলোর জন্য একটা ছাউনি খুঁজতে চলে যায়। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে জায়গা। শেষ পর্যন্ত এই বারান্দাটা খুঁজে পায়। একটা একটা করে মুখ দিয়ে কামড় দিয়ে ধরে ছানাগুলোকে এখানে নিয়ে আসে। তারপর সারাটিক্ষণ জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে গরম করতে থাকে ছানাগুলোকে। বুড়ি চটের বস্তাটায় তুলে রাখে ছানাগুলোকে। বুড়ির আর নেড়িটার সেবায় একসময় ঝরঝরে হয়ে উঠে ছানাগুলো। কিন্তু পরের দিন দুটি ছানা মরে যায়। হয়তো ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই লেগেছিল। তখন নেড়িটার সে কি কান্না। ঐ মরা ছানা দুটোকে যক্ষের ধনের মত আগলে রেখে বসে বসে পাহারা দিতে লাগলো আর কাঁদতে লাগলো।

তারপর সময় খেতে চলে গেলো কোথাও। সেই ফাঁকে বুড়ি মরা বাচ্চা দুটোকে মাটির নিচে কবর দিয়ে দিলো। নয়তো পঁচা গন্ধে বুড়ির টিকা দায় হবে। পরের দিন বুড়ি ভিক্ষে করতে চলে যায়। ফিরে এসে দেখে বাকি ছানাগুলোও বারান্দায় নেই আর নেড়িটার আবার সেই পাগলের মত দশা। একবার এদিকে যাচ্ছে তো আরেকবার ওদিকে যাচ্ছে আর অনবরত কুউউউউ কুউউউউ করে কেঁদে চলেছে। আবার কখনও ভেউ ভেউ করে চিৎকার করে পাড়াটা মাথায় তুলছে। হয়তো শয়তান ছেলের দল চুরি করে নিয়ে গেছে বাচ্চা গুলোকে। সেই থেকে কেঁদে চলেছে নেড়িটা। রাত যত গভীর হয় কুকুরটার কান্নাও তত গভীর হয়। কুকুরটার বুকের হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস।

মায়া বুড়ির বুকের ভেতরটা তখন মোচড় দিয়ে ওঠে। বুড়ির বুকের মধ্যেও যে সেই একই কান্না দলা দলা হয়ে পাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ করেই বুড়ি বিলাপ করে কেঁদে ওঠে।
---কুলসুমরে কুলসুম, বুজান আমার কই গেলি তুই আমারে ফালাইয়া। তরে ছাইড়া আমি ক্যামনে বাঁচুম ক।
একদিকে বুড়ি কাঁদে আর একদিকে নেড়িটা কাঁদে। ওদিকে রাত গড়ায়।
----
তিন

---মা, আমি আর পারছি না। এই মেয়েটা যত দিন যাচ্ছে তত অদ্ভুত হয়ে উঠছে।
---এখন এসব কথা বলে কী হবে শুনি। তখন তো আমার কথা কানে তোলনি।
বললেন তানির মা রওশন আরা। বিকেলবেলা খাবার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে কথা বলছিল ওরা।
---তখনকার কথা বাদ দাও তো মা। এখন কী উপায় তা বলো।
---ওকে অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সবাই জানে ও স্বাভাবিক না।
---কিন্তু যত দিন যাচ্ছে ও আমার জন্য একটা অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে।

এমন সময় তিতলি এসে ঘরে ঢুকল। তিতলি এসে ঘরে ঢুকতেই দুজন চুপ হয়ে গেলো। তানি এটা সেটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তানি কাজ করছিল ঠিকই কিন্তু অনুভব করছিল এক জোড়া শীতল দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

রচনাকাল - ১৪-০৩-২০১৮
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:০৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×