somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প: নিঠুর নিয়তি

০১ লা মার্চ, ২০২০ সকাল ১১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






উপজেলা অফিস থেকে আসার পথে জনসভাটি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। প্রধান অতিথির ভাষণ চলছে। প্রধান অতিথি একাত্তরের স্মৃতিচারণে মগ্ন। আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে বলে চলেছেন যুদ্ধ দিনের কষ্টের কাহিনী, অস্ত্র হাতে তার বীরত্বের সব কথা, কীভাবে শত বাঁধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা। আবেগে তার চোখ ভিজে উঠলো। বক্তব্য শেষ করে চশমাটা খুলে তিনি চোখ মুছলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে ভরে উঠলো চারিদিক।

তার চোখের কোণেও জল জমতে শুরু করলো। স্মৃতির পটে জেগে ওঠে এক টগবগে তরুণের ছবি। কলেজের সব চেয়ে তুখোড় ছাত্র নেতা শফিকের ছবি। সকলের প্রাণপ্রিয় শফিক ভাই। যেমন পড়াশোনায় ভাল ছিল তেমনি গান বাজনা নাটক রাজনীতি সবকিছুতেই ছিল তার দাপুটে পদচারণা। প্রেমও হয়ে গিয়েছিল কলেজের সবচেয়ে মিষ্টি মেয়েটির সাথে।

মেয়েটির নাম ছিল মিতালি। তার এক ক্লাস জুনিয়র ছিল মিতালি। ডাগর ডাগর চোখ, ঘন কালো চুল আর মিষ্টি চেহারার মিতালির প্রেমপ্রার্থীর অভাব ছিল না। তাদের মধ্যে একজন ছিল শফিকেরই সহপাঠী জামিল। জামিল অনেকদিন ধরেই লেগে ছিল মিতালির পেছনে। কিন্তু মিতালির মন জয় করতে পেরেছিল একমাত্র শফিকই। জামিল মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেও শফিকের দাপটের কাছে হার মানে আর প্রতিহিংসার আগুণে জ্বলতে থাকে। তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করে শফিক আর মিতালি। এক সময় তাদের বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে যায়। ছেলের রাজনীতি আর সমাজসেবার প্রতি এত আসক্তি দেখে একরকম জোর করেই বিয়েতে রাজী করান শফিকের বাবা।

শফিকের তখন বিয়েতে মন নেই। সময়টা তখন একাত্তর। দেশে তীব্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। কিন্তু বাবার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজী না হয়ে পারে না শফিক। বিয়ের তারিখ ঠিক হয় ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। কিন্তু সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর দেশের ভেতর অস্থিরতা বাড়তে থাকে। সেই সাথে অস্থির হয়ে ওঠে শফিক। গোপণ সভা আর বৈঠক চলতে থাকে। এরপর আসে পঁচিশে মার্চের সেই কালো রাত। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। শফিক তার দল বল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে।

এদিকে মিতালির সাথে শেষ দেখাটিও হয়ে ওঠে না। শুধু একটি চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে আসে। চিঠিতে শুধু এটুকুই লিখা ছিল "জানি না ফিরে আসতে পারবো কি না। পারলে ক্ষমা করে দিও আমায়।" মিতালি সেই চিঠির উত্তরও দিয়েছিল -"তোমার হাতে হাত ধরে স্বাধীনতার লাল সূর্য দেখার প্রতীক্ষায় রইলাম। তুমি আমার গর্ব, আমার অহংকার।"

শুরু হয় শফিকের দুর্গম পথ চলা। গ্রামের ভেতর দিয়ে রেললাইন ধরে, আলের পর আল মাড়িয়ে, খাল-বিল-ডোবার নোংরা কাদায় পা ডুবিয়ে, কখনো সাঁতরিয়ে, এগোতে থাকে সামনে, মুক্তি পাগল এক সাহসী যুবক। এক এক করে কত যে হায়েনা খতম হলো তার হাতে। কত যে ব্রীজ উড়িয়ে দিলো ডিনামাইট দিয়ে। কত যে পাকি ক্যাম্প উড়িয়ে দিল গ্রেনেড আর গোলাবারুদের আঘাতে। কতবার মরতে মরতে বেঁচে গেলো শত্রুদের হাত থেকে। যুদ্ধের ভেতরই মাঝে মাঝে বাবা মা ভাই বোনের খবর পেতো। খবর পেতো মিতালিরও। খবর পেতো আরো অনেক কিছুর।

সেভাবেই জামিলের রাজাকার হওয়ার খবরও পেয়েছিল শফিক। আরো খবর পেয়েছিল জামিল আর মিতালির বিয়ের। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল সেদিন। বড় কষ্টে নিজেকে সামলেছিল ও। এও জেনেছিল মিতালি স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেনি। তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। তাই মিতালির উপর তার কোন ক্ষোভ নেই। এমনিতেও শফিকের নিজের জীবনের কোন ভরসা ছিল না তখন। প্রতিটি মুহুর্ত মরণের সাথে যুদ্ধ করে কাটছিল তার।

শুধু কষ্ট হত খুব এই ভেবে যে মিতালির মত একটি ভাল মেয়ের কপালে জুটলো একটা রাজাকার স্বামী। বুকের ভেতরটা জ্বালা করতো খুব। এই জ্বালা বুকে নিয়েই আরো আক্রোশ আরো ক্ষোভ নিয়ে যুদ্ধ করে যেতো সে অবিরত। এভাবেই কেটে গেলো নয়টি মাস। মরণপণ যুদ্ধ শেষে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে ফিরে এলো শফিক। কিন্তু আফসোস স্বাধীনতার সেই লাল সূর্য মিতালির হাতে হাত রেখে দেখা হলো না তার।

ফিরে আসে শফিক। অস্ত্র জমা দেয়। কিন্তু থেমে থাকে না। মিতালিকে হারানোর ক্ষত বুকে নিয়েই সে তার কাজ করে যেতে থাকে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। যুদ্ধ করেই তো দায়িত্ব শেষ হয় না। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে এবার। দেশটাকে আবার নতুন করে গড়তে হবে। নয়তো এই যুদ্ধের কোন দাম থাকবে না। তাই কোমর বেঁধে লেগে যায় দেশের সেবায়, মানুষের সেবায়। সবার বিপদে-আপদে, সব রকমের সমস্যায় সবার আগে শফিক ভাই। এই ভাবেই তিন চার বছর কেটে যায়।

দেশে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা। ঠিক তখনই শফিকের বাবা শফিকের বিয়ে দিয়ে দিলেন। নতুন বউ, ছোট্ট সংসার, ছোট্ট ব্যবসা, রাজনীতি আর সমাজ সেবা সবই চলছিল সমান তালে। কিন্তু শফিক জানতো না সামনে তার ঘোর অমানিশা। বিয়ের মাত্র ছ'মাস তখন। বউ অন্তঃসত্তা। শফিকের মনে তখন খুশির জোয়ার। অনাগত সন্তানকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে সে, কত যে ছবি আঁকে। এদিকে দেশে বুঝি গৃহযুদ্ধ শুরু হলো। দেশীয় কিছু হায়েনা সপরিবারে হত্যা করলো প্রাণপ্রিয় নেতাকে।

চারিদিকে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল। এমন সময় মিথ্যে অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হলো শফিক। সে নাকি যুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দেয়নি। শুধু শফিক না, শফিকের মত আরো অনেক নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হলো। ছয় মাস জেলের ভেতর চললো আমানুষিক নির্যাতন।

হাত পা বেঁধে উপুর করে শুইয়ে রাখা হত। তারপর মোটা রড দিয়ে পায়ের গুড়ালি থেকে শুরু করে সারা শরীরে ক্রমাগত পেটানো হত। ততক্ষণ পর্যন্ত পেটানো চলতো যতক্ষণ না পা ফেঁটে রক্ত বের হত। হাতের আঙুলগুলো দুইটি লোহার দণ্ডের মাঝখানে রেখে সজোরে চাপ দেয়া হত। শফিকদের আহাজারিতে জেলখানার বাতাস ভারী হয়ে উঠতো, তবু ঐ নরপিশাচদের দয়া হত না। বলা হলো অপরাধ স্বীকার করলে শাস্তি কমানো হবে। কিন্তু শফিক কিছুতেই স্বীকার করে না। যে অপরাধ সে করেনি সেটা কেন সে স্বীকার করবে? অত্যাচার আরো বেড়ে গেলো। যুদ্ধের পর এ যেন আরেক যুদ্ধ। আরো ভয়াবহ। আরো কষ্টের।

সবাইকে ভয় দেখানো হলো যেন শফিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। শফিক সবার প্রাণ। সবাই ভালবাসে শফিককে। কী করে তারা শফিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে! কিন্তু ভয়ে কেউ তার পক্ষেও সাক্ষ্য দিতে এলো না। অবশেষে সাহস করে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ এলেন এবং শফিকের পক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। মুক্তি পেলো শফিক। ফিরে এলো ঘরে। কিন্তু জেলের ভেতরের সেই অমানুষিক অত্যাচার কেড়ে নিলো তার এক পা।

সময় ধীরে ধীরে বদলে গেলো। সবার প্রিয় শফিক ভাই হারিয়ে যেতে লাগলো কালের গহ্বরে। বীরের মত যুদ্ধ করে যে শফিক ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়, দেশের খাতিরে দিয়েছিল নিজের ভালবাসার বলিদান, সপে দিয়েছিলো নিজেকে পঙ্গুত্বের হাতে, সেই বীর নেতা জীবন যুদ্ধে হারতে লাগলো। দারিদ্রের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো। একদিন সবাই ভুলে গেলো সেই টগবগে দাপুটে নেতাকে। আজ সামান্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতার জন্য দৌড়াতে হয় তাকে অফিসে অফিসে। জুতোর তলা খসে যায় তবু ভাতা মিলে না। কারণ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়ই যে নাম নেই আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকের।

জনসভার ভীড়ে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শফিক এসবই ভাবে আর হাসে। যে কিনা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে কেবল লড়েই গেলো সে কিনা আজ পথের ভিখারী। আর যে ছিল দেশের বিশ্বাসঘাতক দালাল, সেই রাজাকার জামিল আজ প্রধান অতিথি হয়ে ভাষণ দেয় সভায় সভায় আর মেকি আবেগে চোখের জল মুছতে মুছতে মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া স্মৃতিচারণ করে বেড়ায়। চকচক করে তার চেহারা। চকচক করে তার দামী ফ্রেমের চশমা আর দামি সিল্কের পাঞ্জাবি। চকচক করে তার বিলাস বহুল মার্সিডিস গাড়ি।

©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২০ সকাল ১১:৫০
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×