আগের পর্ব - Click This Link
বজলুর রশীদ ভালোভাবে তৈরী হয়ে ওদের তিনজনকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। শুরু করলেন তানিকে দিয়ে।
---মিসেস তানি আপনার শেষ কোন ইচ্ছা থাকলে বলুন।
বিধ্বস্ত তানি ভীত কণ্ঠে কোন রকমে বলল,
---মানে?
---মানে আপনার ফাঁসির দড়ি তো রেডি।
---কী বলছেন এসব? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কেন ফাঁসি হতে যাবে?
---কারণ আপনার স্বামী তার জবানবন্দীতে সব স্বীকার করে ফেলেছেন। এখন আপনাকে আর আপনার মাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
তানির সমস্ত শরীর অসার হয়ে এলো। কোন রকমে ঢোক গিলে বলল,
---কী বলেছে সে?
---বলেছে খুন দুইটা আপনি আর আপনাার মা মিলে করেছেন। উনি কেবল ব্যাপারটা গোপণ রেখেছেন। এখন উনি যেহেতু জবানবন্দীতে সব স্বীকার করেছেন উনার বড়জোর কয়েক বছর জেল হতে পারে। কিন্তু আপনাদের নির্ঘাত ফাঁসি হবে।
তানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু তবু হার না মেনে বলল,
---এসবই আপনাদের চাল। আমরা সবাই নির্দোষ তো এসব কথা কোত্থেকে আসবে।
---তাহলে এটা কী ম্যাডাম? এই দেখুন জবানবন্দী? আর এই আপনার স্বামীর সই। দেখুন তাকিয়ে, এটা আপনার স্বামীর সই
কিনা?
তানি তাকিয়ে দেখলো কাগজটায় ঠিকই আবীরের সিগনেচার। পড়ে দেখলো পুলিশ ঠিকই বলছে। কিন্তু আবীর কি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে ওর সাথে। ও বিচলিত হয়ে পড়লো। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলল,
---এই সিগনেচার নকল সিগনেচার। সব আপনাদের চাল আমি জানি।
---তাহলে আপনার বাসায় যে কঙ্কালটা পাওয়া গেছে সেটা যে দীনার আর যেটা দীনার কবরে আছে সেটা যে কুলসুমের সেটা আমরা কী করে জানলাম বলুন।
তানি যেন ভেবে কোন কোল পাচ্ছিল না। হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়লো। ভাবার সব শক্তি হারিয়ে ফেলল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বজলুর রশীদ ভাবলেন লোহাটা গরম হয়েছে বাড়িটা এখনই মারা দরকার। তারপর শান্ত স্বরে বললেন,
---আপনার জন্য কষ্ট লাগছে ম্যাডাম। একটা উপায় কিন্তু আছে বাঁচার।
তানি চোখ মুছে বলল,
---কী উপায়?
---সব স্বীকার করে ফেলুন। তাহলে অন্তত ফাঁসি থেকে বেঁচে যেতে পারেন। কে জানে হয়তো যাবজ্জীবন থেকেও বেঁচে যেতে পারেন। হয়তো কয়েক বছরের জেল হবে শুধু।
এই অবস্থায়ও তানির চতুর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করেনি। ও খুব ভেবে চিন্তে বলল,
---জেল কেন হবে? আমরা তো কিছুই করিনি যা করার ঐ আবীরই করেছে। আমরা শুধু চুপ করেছিলাম এটাই আমাদের অপরাধ।
---তাহলে আপনি সব খুলে বলতে রাজী?
---হ্যাঁ। রাজী।
বজলুর রশীদ মনে মনে হাসলেন। শিকার অবশেষে ফাঁদে পা রাখলো।
তেইশ
---আবীর সাহেব, সত্যি কষ্ট হচ্ছে আপনার জন্য।
---আমার জন্য আপনার কষ্ট হচ্ছে! হাসালেন আমায়।
---না মানে, মানুষ হিসেবে তো আপনি খুব খারাপ নন। আমি তো দেখেছি কীভাবে শাশুড়ি আর স্ত্রীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেলেন এতদিন ধরে। কিন্তু যাদের জন্য করলেন চুরি তারাই এখন আপনাকে চোর বলছে। তাই একটু কষ্ট লাগছে আর কী!
---কী বলছেন এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
---আপনার ফাঁসি এখন সময়ের ব্যাপার মি: আবীর।
---আমার কেন ফাঁসি হতে যাবে কেন? কী করেছি আমি?
---আসলে কেইসটা সলভ হয়ে গেছে। সব সাক্ষী প্রমাণ এখন আমাদের হাতে। এখন শুধু কোর্টের ব্যাপার আর রায়ের জন্য অপেক্ষা। টানাহেঁচড়ার আর কোন সুযোগ নেই।
আবীরের ভেতরটা ছটফট করে উঠলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না। কণ্ঠ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
---কী প্রমান পেয়েছেন আপনারা?
---আপনার স্ত্রী আর শাশুড়ি সব স্বীকার করেছেন। ওরা বলছেন খুন দুইটা আপনিই করেছেন। ওরা শুধু ব্যাপারটা গোপণ রেখেছেন।
মিথ্যে কথা। এ সব আপনার চালাকি। ওরা এসব কিছুই বলেনি।
বজলুর রশীদ রেকর্ডিংটা প্লে করলেন।
---আপনার স্ত্রীর কণ্ঠ চিনতে পারছেন তো আপনি?
আবীর সবটা শুনলো। শুনে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল।
--- শুধু এটাই না। আরো রয়েছে আবীর সাহেব। ডি এন এ টেস্টে সব প্রমাণিত হয়ে গেছে। আপনার বাড়িতে যার কবর ছিল সেটা মিসেস দীনার আর আপনার স্ত্রীর কবরে যে ছিল সে হলো কুলসুম। আপনার বাঁচার আর কোন স্কোপই নেই।
আবীর সব শুনে একেবারে মোষড়ে পড়লো। কিন্তু কোন কথা বলল না। নির্বাক হয়ে বসে রইল। বজলুর রশীদ আবীরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে বললেন
---এখন একটা রাস্তাই খোলা আছে। যদি আপনি স্বীকারোক্তিমূলক একটা জবানবন্দী দেন তাহলে হয়তো জজ সাহেব কিছুটা সদয় হতেও পারেন। ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবনও হতে পারে আপনার। দেখুন ভেবে কী করবেন।
আবীর তারপরেও চুপ। কোন কথা বলল না। শুধু বিষণ্ণ দৃষ্টিতে মুখটা নত করে বসে রইলো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বজলুর রশীদ বসা থেকে উঠতে উঠতে বললেন,
---ঠিক আছে আবীর সাহেব আমি আসি। আমার আর কিছু করার নেই।
আবীর এবার মুখটা তুলল। বজলুর রশীদের দিকে তাকিয়ে বলল,
---আমি জবানবন্দী দিতে রাজী।
------
আমি সারাদিন অফিসে থাকতাম। বিকেলে বাড়ি ফিরতাম। আশে পাশে কোন বাড়ি নেই। কথা বলার মানুষ নেই। এত বড় বাড়িটায় দীনার তাই খুব একা একা লাগতো। তাই ওর ইচ্ছেতেই ঠিক করলাম দুতলাটা ভাড়া দেবো। দুতলা ভাড়া নিয়ে আসলো তানি এবং ওর মা। তানির স্বামী থাকতো বিদেশে। শ্বশুর বাড়ির সাথে ওর বনতো না। মা থাকতেন ভাইয়ের সংসারে। ওখানে উনারও ছেলে বউয়ের সাথে বনিবনা ছিল না। তাই মা মেয়ে দুজনে মিলে ঠিক করলো ওরা একসাথে অন্য কোথাও ভাড়া নিয়ে থাকবে। সেই উদ্দেশ্যেই ওরা ভাড়া নিয়ে আসলো আমাদের দুতলায়।
তানির মোহনীয় রূপে প্রথম দেখায়ই আমি মোহিত হয়ে গেলাম। তানির চোখেও আমার জন্য ভাল লাগা দেখতে পেলাম। বিকেল বেলা দীনা বাগান নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতো। তিতলি ওর সাথে সাথেই থাকতো। সেই সুযোগে আমি আর তানি গল্পে মেতে উঠতাম। গল্পে গল্পে কখন প্রেম হয়ে গেলো বুঝতেও পারলাম না। দুজন দুজনের জন্য অধির আকুলতায় সময় কাটাতাম।
রাত গভীর হয়ে এলে দীনা আর তিতলি ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলে আমি চুপি চুপি চলে যেতাম দুতলায়। আমার জন্য দরজা খোলাই রাখতো তানি। ওর মা সবই জানতেন। দুজনে দিনের পর দিন দীনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে উন্মত্ততায় মেতে থাকতাম । এভাবেই একদিন উন্মত্ততায় মেতে ছিলাম আমরা। হঠাৎ দেখি দরজা হাট করে খোলা। আর সেখানে নিষ্পলক চোখে দাঁড়িয়ে আছে দীনা। সেদিন থেকে দীনা একদম চুপ মেরে গেল।
কিন্তু সব কাজ ঠিক ঠাক করে যেতো। তিতলির দেখাশোনা করতো। শুধু চোখে থাকতো এক উদাস দৃষ্টি। অনেকটা যেন রোবটের মত। কাউকে চেনে কি চেনে না বোঝার উপায় ছিল না। সেদিনের পর থেকে একটি কথাও ওর মুখ দিয়ে বের হত না। এমন কী ওর আত্মীয় স্বজন এলেও না। রাতের বেলা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে ঘুমোতো। সবাই ভাবতে লাগলো ও পাগল হয়ে গেছে।
ও কয়েকবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করলো। কিন্তু ও মরে যাক এটা আমি কখনোই চাইনি। তাই ওকে বার বারই সুস্থ করে তুলতে লাগলাম। এদিকে ওর এই ব্যবহার আমাদের জন্য শাপে বর হলো। ওকে নিয়ে আমাদের আর কোন চিন্তা রইল না। কিন্তু এক সময় এই লুকোচুরির খেলায় হাঁপিয়ে উঠলাম আমরা। তানি বলল,
---এভাবে আর কতদিন?
আমি বললাম,
---মানে?
ও বলল,
---আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাই।
আমি বললাম, এটা কিভাবে সম্ভব?
ও বলল,
---সম্ভব। তুমি তোমার বউকে ডিভোর্স দাও। আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিবো। আর কোন সমস্যাই রইলো না।
আমি বললাম,
----এটা সম্ভব না। সমাজে আমার একটা সম্মান আছে।
ও বলল,
----তাহলে অন্য কোন ব্যবস্থা করো। আর না হলে আমার আশা ছেড়ে দাও। আমি এই লুকোচুরির খেলা আর খেলতে পারবো না।
ও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলো। কিছুতেই আমার সাথে কথা বলতে চাইতো না। আমি পাগল হয়ে উঠলাম। মনে হলো তানিকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। দীনা যেদিন খুন হয় সেদিন রাতের ঘটনা। তানির কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে নিচে নেমে এলাম আমি। ঘরে ঢুকে দীনার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালাম। আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। আক্রোশে ফেটে পড়লাম আমি। মনে হলো সব বিপত্তির মূল হলো ও। ওকে আমি এই দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেবো।
শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই হাতে ওর গলা টিপে ধরলাম। দীনা ছটফট করতে লাগলো। হাত পা ছুঁড়তে লাগলো। ওর চোখ বেরিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু আমি ওকে ছাড়লাম না। আমার শরীরে তখন পশুর শক্তি। আমি তানিকে কিছুতেই হারাতে পারবো না। আরো বেশি করে গলা টিপে ধরলাম আমি। এক সময় ওর হাত পা নিথর হয়ে এলো। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলাম শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। কব্জি চেক করে দেখলাম পালস থেমে গেছে।
তিতলি তখন গাঢ় ঘুমে। কিছুই টের পেলো না। কিছুক্ষণ আমি স্থবির হয়ে বসে রইলাম দীনার লাশের পাশে। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। এক সময় সম্বিত ফিরে পেলাম। খুব হাঁসফাঁস লাগছিল। শরীর ঘামছিল। খুব বেশি নার্ভাস ফিল করছিলাম। কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে বড় অসহায় আর বেকুব মনে হচ্ছিল।
একসময় ছুটে গেলাম দুতলায়। মনে হল এই ঘোর বিপদের দিনে তানি ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। তানি আর তানির মাকে খুলে বললাম সব। সব শুনে তারা একটুও ঘাবড়ালো না। বরং তানি বলল,
--ভয়ের কিছু নেই। সবাই জানে ও পাগল হয়ে গেছে। তুমি বলবে সকালে উঠে ওকে ওর রুমে পাওনি। সবাই ভাববে কোথাও চলে গেছে। কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না। আমি বললাম,
---কিন্তু লাশটা কী করবো?
তানি বলল,
---বাগানে কবর দিয়ে দিতে হবে।
তিনজনে মিলে বাগানে মাটি খুঁড়ে দীনাকে কবর দিয়ে দিলাম। মাটিটা একদম সমান রাখলাম যাতে উঁচু মাটি দেখে কারোর সন্দেহ না হয়। উচ্ছিষ্ট মাটিগুলো পুকুরে ফেলে দিলাম যাতে কুলসুমের কোন সন্দেহ না হয়। তানি বলল, কদিন পর এই জায়গাটা পাকা করে একটা চাতাল বানিয়ে নিবে। এতে কোনদিন লাশটা বেরিয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা থাকবে না।
হঠাৎ আমার চোখ গেলো ব্যালকনিটার দিকে। দেখি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তিতলি। ও সব দেখেছে। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। তানি বলল, ও একটু আগেও ঘুমে ছিল আমি দেখেছি। ছোট মানুষ ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝবে না। আর যদি বুঝে থাকে কিছু তখন দেখা যাবে। আমরা ঘরে এলাম। কিন্তু তিতলি একবারও ওর মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলো না। তানি ওকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলো। ও বাধ্য মেয়ের মত গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। যে মেয়ের মুখে কথার খৈ ফোটে সেই মেয়ে এত বড় ঘটনা দেখেও বেমালুম চুপ মেরে গেলো। আমরা ভাবলাম অন্ধকারে ও কিছুই দেখতে পায়নি। কিন্তু সেদিন আসলে মনে হয় ও সব দেখেছে। ওর অবচেতন মনে আজও সেই স্মৃতি রয়ে গেছে।
পরের দিন সকাল বেলা দেখলাম ও জেগে বসে আছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কখন উঠেছে। কিন্তু ও আমার কথার কোন জবাব দিলো না। অন্য সময় হলে হড়বড় করে অনেক কথা বলে ফেলতো। আমার একটু সন্দেহ হলো মেয়েটা কিছু দেখে ফেলেনি তো! যদি কাউকে বলে দেয়। নানা চিন্তা আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগলো। তানিও বলল,
---যদি ও কিছু দেখে থাকে আর কাউকে বলে দেয়।
আমি বললাম,
---ও এখন কিছু বলছে না যখন পরেও বলবে না। ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে। দীনার কথাও।
তানি আর কিছু বলল না।
সকাল দশটার দিকে কুলসুম আসলো। এসেই ও দীনার কথা জানতে চাইল। আমি বললাম, সকাল থেকে দীনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। এতবড় একটা ঘটনার পর আমি কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মত হয়ে পড়েছিলাম। ও আমার হাবভাব দেখে সন্দেহ করলো। আমরা ওর সামনে দীনাকে খোঁজাখুঁজির অভিনয় করতে লাগলাম। কিন্তু তাতেও ওর সন্দেহ যাচ্ছিল না। বার বার তিতলিকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো দীনার কথা। কিন্তু তিতলি চুপ। তিতলিকে এই রকম চুপ করে থাকতে দেখে ওর সন্দেহ আরো বেড়ে গেলো।
ও বাগানে পুকুর পাড়ে সবখানে খুঁজতে লাগলো দীনাকে। ও বাগানের গাছ গাছালির দেখাশোনাও করতো। সব ওর চেনা জানা। দীনাকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছে ওখানকার মাটি নরম দেখে ওর সন্দেহ হলো। ও ঐ জায়গাটা খুঁড়ার জন্য ঘর থেকে কোদাল নিয়ে যাচ্ছিল। তানি আর আমি এসে ওকে আটকে ফেললাম। ওকে ভাল করে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। মুখের মধ্যে কাপড় পুরে মুখটাও ভাল করে বেঁধে রাখলাম যাতে শব্দ না করে। তানির মা তিতলিকে নিয়ে উপরে চলে গিয়েছিলেন যাতে ও এসব না দেখে। আমি বললাম,
---এখন উপায়।
তানি বলল,
---একটা খুন যা দশটা খুনও তা। বাঁচতে হলে ঐ কুলসুমকেও শেষ করে ফেলতে হবে।
আমি বললাম,
---- কিন্তু ওর বাড়ির লোকজন?"
তানি বলল,
----ওর বাড়িতে তেমন কেউ নাই। শুধু এক বুড়ো নানি। ওকে বলে দেবো কুলসুম কাজ করে চলে গেছে। গরীব মানুষ। আর কোন ঝামেলা করবে না। আর যদি কিছু করে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া যাবে। আমি একটা প্ল্যান করেছি, শোন।
আমি বললাম,
--কী প্ল্যান?
তানি বলল,
----দীনার তো আত্মহত্যার প্রবণতা আছে। আমরা বলবো ও গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেউ অবিশ্বাস করবে না।
আমি বললাম,
---কিন্তু সেজন্য তো লাশটা আবার কবর থেকে তুলতে হবে।
তানি বলল,
--- তুলতে হবে না। আর ওর লাশ দিয়ে আত্মহত্যা সাজালে ধরা পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পোস্ট মর্টেম হতে পারে। পোস্ট মর্টেমে ওকে শ্বাস রোধ করে মারা হয়েছে সেটা বেরিয়ে আসতে পারে। আমাদেরকে কোন জীবিত মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে ব্যাপারটা সাজাতে হবে। আর এটা সম্ভব কুলসুমের দ্বারা। সাপও মরলো লাঠিও ভাঙলো না।
আমি ভেবে দেখলাম কুলসুমকে না মেরে উপায় নেই। তানি যা বলছে তা ঠিকই। আমরা ওকে বেঁধে রেখে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত যখন গভীর হলো ঝড় শুরু হলো। এতে আমাদের জন্য সুবিধা হলো। ব্যাখ্যাটা আরো সহজ হয়ে গেলো। তিতলিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। তারপর কুলসুমকে আমরা রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম। ভাল করে বেঁধে সারা শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। চোখের পলকে ও পুড়ে একেবারে ঝলসে গেলো।
চব্বিশ
আবীর ও তানির ফাঁসির রায় হলো। রওশন আরার হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। জেরার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত তানি আর রওশন আরা দুজনেই নিজেদের দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রওশন আরা কেঁদে চলেছেন অনবরত। আবীর আর তানি নতমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের অবৈধ বাসনার ছুরি কেড়ে নিয়েছিলো তিনটি নিষ্পাপ প্রাণ। মানুষ পাপ করে গোপণে। কিন্তু পাপ কখনো গোপণ থাকে না, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। একদিন না একদিন পাপ তার খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসেই। একদিন না একদিন সেই পাপের শাস্তি ভোগ করতেই হয়।
বিচারক রায়টা পড়ে শুনাচ্ছিলেন। রায় শুনতে শুনতে রীণার দুটো চোখ জলে ভরে গেলো। মি: আশরাফের দুটো চোখও ছলছল করে উঠলো। দীনা, টুনটুন আর কুলসুমের আত্মা আজ থেকে শান্তিতে ঘুমোবে। বিচারকের রায় পড়া শেষ হলে মি: আশরাফ রীণার দিকে তাকালেন। রীণার চোখ তখনও সামনের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। মি: আশরাফ নীরবে নিজের একটা হাত রাখলেন রীণার হাতে। রীণা সেই স্পর্শ পেয়ে নিষ্পলক দুটি চোখের পাতা এক করলো। সাথে সাথে চোখের ভেতর জমে ওঠা জলগুলো অঝরধারায় বইতে লাগলো।
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:৫৩