"বুুম" করে বিকট একটা আওয়াজ হতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম। মনে হলো গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তারপর ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পেলাম। আরো কয়েকবার বুম বুম করে শব্দ হলো। এবার আর ভয় পেলাম না। বুঝতে পারলাম কেউ বাজি ফুটাচ্ছে। আজ দোল পূর্ণিমা। হলি খেলার দিন। তাই হইহুল্লর করছে লোকেরা।
কিন্তু বুকের ভেতর এখনও দ্রীম দ্রীম শব্দ বেজে যাচ্ছে। কোন রকমে বিছানা থেকে নেমে সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। তারপর ঢক ঢক পুরোটা পানি গলায় ঢাললাম। কিছুটা শান্ত হলো ভেতরটা। কী যে হয়েছে আজকাল। সামান্য হইচই কিংবা শব্দ হলেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভেতর ঢং ঢং ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকটা হওয়ার পর থেকেই এমনটা ঘটছে। মৃত্যু ভয়টা বড় বেশি হয় আজকাল। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। মরণেরই তো বয়স। মানুষের গড় আয়ু সত্তর। বেশিরভাগ মানুষ সত্তরের কাছাকাছি বয়সে মারা যায়। তবু মরতে ইচ্ছে করে না। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে, ছেলে মেয়ে, নাতি-নাতনি এদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।
ছেলেটা আজ দেশে ফিরেছে। ছয়মাস পর পর এসে আমাকে দেখে যায়। নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চায়। ওর জোরাজুরিতে গিয়েছিলাম কয়েকবার। কিন্তু কিছুতেই বিদেশে মন টেকে না আমার। তিল তিল করে গড়ে তোলা বাড়ি, এই বাগান, এই গাছগাছালি এগুলোর জন্য বড় মন কেমন করে। কাজের লোকজন নিয়ে একা একা থাকি। বাড়িটাকে দেখাশোনা করি, মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা নাতিনাতনি, বউ, জামাই নিয়ে আসে। কলকাকলিতে ঘর ভরে ওঠে। এই বেশ লাগে।
জ্বর জ্বর লাগছে খুব। কাশিতেও ধরেছে। মাথা ব্যথা করছে প্রচণ্ড। কম্বলটা দিয়ে শরীরটা, ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। একটি কম্বলে শীত মানছে না কিছুতেই। উঠে গিয়ে যে আরেকটা কম্বল গায়ে জড়াবো সেই শক্তিও নেই। হঠাৎ করে জ্বর আসলো কেন কে জানে। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ছেলেটাও জ্বর নিয়ে এসেছে। সাথে সর্দি কাশি। এয়ারপোর্ট থেকেই হালকা কাশছিল। ঘরে আসতেই জ্বরটা ছেয়ে ধরে। ঔষধ খাওয়ার পর অবশ্য জ্বরটা নেমে গিয়েছিল। ভাইরাস জ্বরই হবে।
ভাইরাস জ্বর ভাবতেই আরেক আতঙ্ক ছেয়ে ধরলো। করোনা ভাইরাস নয়তো। বাংলাদেশেও নাকি ধরা পড়েছে। লক্ষণগুলো তো এমনই। বুকের ভেতরটা আবার কাঁপতে শুরু করেছে। নাহ, কালই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। ছেলেকে নিয়েই যাবো। নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়া ভালো। নয়তো আতঙ্কেই মরে যেতে হবে। মেয়েটা ছয়মাস পর পরিবার নিয়ে দেশে আসবে। ওদের না দেখেই চলে যাবো তা কি হয়। চোখ বন্ধ করলাম। মনে মনে পত্রিকার নিউজটার কথা ভাবতে লাগলাম। "আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নাই। করোনা মানেই মৃত্যু না।"
কিছুটা শান্ত হয়ে এলো মন। চোখের পাতাটাও ভারী হয়ে এলো। আধো ঘুম আর আধো জাগরণে দেখতে পেলাম এক ঝাঁক হলুদ বাঁদুর ধেয়ে আসছে আমার দিকে। ওদের আক্রমন থেকে বাঁচতে আমি প্রাণপনে ছুটছি। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। ঝাঁকে ঝাঁকে বাঁদুর আমাকে ছেয়ে ধরলো। এমন সময় ঘুমটা আবার ভেঙে গেলো। সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত চলছে। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছে। অনেকক্ষণ লাগলো স্বাভাবিক হতে। ফজরের আজান পড়ছে। ভোর হয়ে এলো। কোন রকমে বিছানা থেকে নামলাম নামাজের জন্য।
সকালের দিকে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। ডাক্তাররা দীর্ঘ সময় পরীক্ষা নিরীক্ষা করলো। একেকটা মুহূর্ত যেন একেকটা ভারী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সময়টা কিছুতেই কাটতে চাইছিল না। কখন ডাক্তাররা চুড়ান্ত কিছু বলবেন সেই প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুনছিলাম। প্রতিটা অপেক্ষার প্রহরই কষ্টের হয়। আর প্রতীক্ষাটা যখন এমন ভয়াবহ কিছুর ফলাফলের জন্য হয় তখন সেটা কষ্টের চাইতেও আরো অধিক কঠোর কিছু হয় যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো প্রতীক্ষা করতে করতেই মরে যাবো।
যাই হোক, এক সময় ডাক্তাররা চুড়ান্ত রিপোর্ট দিলেন। আমাদের কারোর শরীরেই করোনা ভাইরাস নেই। সাধারণ সর্দি জ্বর। আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। শরীরটা বড় বেশি দূর্বল লাগছিল। ছেলে হাতে ধরে চেয়ার থেকে খাড়া করালো। আমার বুকের ভেতরটা এখনও কাঁপছে। কোন রকমে ছেলেকে ধরে ধরে এক পা দু পা করে এগোলাম। হাসপাতালের গেটের বাইরে পা রাখতেই কোথা থেকে যেন এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে এসে ছেয়ে ধরলো আমাদেরকে। সবার হাতেই মাইক্রোফোন। এরা সবাই রিপোর্টার। এরা কী করে খবর পেলো কে জানে। আমার শরীরে এতটুকু শক্তি ছিল না। ওরা একসাথে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলো। আমি দিশেহারা বোধ করলাম।
আপনাদের নাকি করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে?
আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন?
ভাইরাস নিয়েই এসেছেন নাকি এখানে এসে ধরা পড়েছে?
অবস্থা কি খুব সিরিয়াস?
আপনাদের অবজার্ভেশনে না রেখে ছেড়ে দিলো কেন?
আমার মাথাটা ভন ভন করে ঘুরতে শুরু করেছে। আমার সমস্ত পৃথিবী দুলছে। আমি আর খাড়া থাকতে পারছি না। সমস্ত শরীর যেন শূন্যে ভাসতে লাগলো। সংবাদকর্মীদের জটলা দেখে আশপাশের উৎসাহী জনগণ ভীড় করতে শুরু করলো। কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে। কেউ ছবি তুলছে। আমার বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগছে খুব। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। একটু বাতাস প্রয়োজন। আমি হাঁ করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি না কিছুতেই। আমি কি মরে যাচ্ছি? আর কিছু ভাবতে পারছি না। ঢলে পড়লাম নিচে। ছেলে মা মা বলে আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখলো। আমার চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। ছেলের কান্নাভেজা কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
আপনাদের পায়ে পড়ি, একটু পথ দিন। গেটটা খালি করে দিন। আমার মা মরে যাচ্ছেন। উনাকে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যেতে হবে।
ছেলের কণ্ঠ ছাপিয়ে একজনের কণ্ঠ কানে এলো,
এইমাত্র করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দুই জনের সন্ধান পাওয়া গেলো। একজনের বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমি উনাদের পাশেই আছি। এই যে লাইভ ভিডিওতে যাদের দেখা যাচ্ছে তারাই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। দেখুন বয়স্ক এই মহিলার অবস্থা। খুব কষ্ট লাগছে। দেখি উনাদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কিনা।
----
(অযথা আতঙ্ক ছড়াবেন না, আতঙ্কিত হবেন না। গুজব না রটিয়ে সঠিক খবর পরিবেশন করুন। আপনার একটি অসত্য সংবাদ একজন দূর্বল মনের মানুষের জন্য প্রাণঘাতী পারে। আপনার অতি ঔৎসুক্য অন্য একজনের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং নিজে সতর্কতা অবলম্বন করুন। অন্যকে সতর্ক করুন। সঠিক তথ্য দিয়ে সতর্ক করুন। ক্ষতির কারণ না হয়ে সুরক্ষা কবচ হোন।
আইইডিসিআর-এর পরামর্শ:
আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, নতুন করে আক্রান্তের হার আগের তুলনায় কমে এসেছে। তাই অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ ফ্লু হলে যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয় সে ধরণের ব্যবস্থা নিলেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে, যেখানে সেখানে হাঁচি বা কাশি দেয়া যাবে না।
হাঁচি-কাশি দিতে রুমাল, টিস্যু বা কাপড় ব্যবহার করতে হবে।
বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
সঠিক তথ্য প্রচার করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং চিকিৎসক সবাইকেই নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে।
রোগির ব্যক্তিগত তথ্য ছড়িয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। নচেৎ তার ও তার পরিবারের সামাজিকভাবে হেয় হবার আশঙ্কা তৈরি হবে।)
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৫৮