লেজার ফিজিক্সে অবদান রাখার জন্য এবার তিন ভিন্ন দেশের তিনজন পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন।
তবে সবার আগে শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক লেজার জিনিসটা কী।
লেজার (LASER) যার পূর্ণরূপ হল Light Amplification by Stimulated Emission of Radiation. অর্থাৎ আক্ষরিক বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়- উত্তেজিত বিকিরণের সাহায্যে আলোর বিবর্ধন। লেজার এমন একধরণের যন্ত্রবিশেষ যা আলোক বিবর্ধন প্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের উদ্দীপিত বিকিরণ নিঃসরণ করে।
লেজার রশ্মি একপ্রকার আলো, তবে বিশেষ আলো। সাধারণ আলো থেকে এটি ভিন্ন, কারণ এর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণ আলোতে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ থাকে। সাধারণ আলো যদি একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যেরও হয়, তবু এরা বিভিন্ন তলে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে চলাচল করে। কিন্তু লেজার যন্ত্র থেকে নির্গত সকল আলোক তরঙ্গই একই তলে চলাচল করে কিংবা এরা সবগুলোই একই মাপের তরঙ্গ হয়। এরা মাত্র কয়েক মাইক্রন চওড়া হওয়ায় (১ মাইক্রন = ১০-৩ মিলিমিটার) এতে প্রচন্ড তাপশক্তি একত্রিত করা যায়। এজন্য বলা হয় লেজার সুসংগতভাবে আলো নিঃসরণ করে। সুসংগত উৎস হল, আলোর এমন দুটি যা থেকে নির্গত তরঙ্গদ্বয় এদের মধ্যকার বিদ্যমান দশা পার্থক্য বা নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। এছাড়াও লেজার রশ্মি একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একীভূত থাকতে পারে। সাধারণ আলোর মত ছড়িয়ে পড়েনা বলে বিশাল দূরত্বেও এটি সমান্তরাল ও সরূ থাকতে পারে। একটি বিন্দুতে একে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে একীভূত করে প্রচন্ড শক্তিশালী করা যায় বলে এই রশ্মির সাহায্যে কোনও কিছু কেটেও ফেলা যায়।
লেজারের বিভিন্ন ধরণের ব্যবহারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবহারগুলো হল- লেজার প্রিন্টার, লেজার সার্জারি, বারকোড স্ক্যানার, অপ্টিক্যাল ডিস্ক ড্রাইভ, ফাইবার অপটিক, ধাতব ঝালাই, শূন্যস্থানে আলোক যোগাযোগ, বিনোদনের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লেজার রশ্মির আলোকীয় কারিশমা ইত্যাদি।
এখন কথা হল- আলোক পালস কী?
প্রায় এক পিকোসেকেন্ড (1 Pico= 1/〖10〗^(-12) ) বা তার চেয়ে কম সময়ে তড়িৎচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের স্পন্দনকে আলোক পালস বলা যায়। আর ডোনা ও মৌরৌ কর্তৃক আবিষ্কৃত লেজার পালস-এর স্পন্দনকাল হল- ১ ফেমোসেকেন্ড, অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের ১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভগ্নাংশ সেকেন্ডকে আরও ১ মিলিয়ন ভাগে ভাগ করলে যে ভগ্নাংশ সেকেন্ড পাওয়া যায়, সেই সময়!
এখন, ২০১৮ সালের লেজার ফিল্ডে পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানের নোবেলবিজয়ীগণ হলেন-
১। আর্থার অ্যাশকিন (মার্কিন বিজ্ঞানী) ২। জেরার্ড মৌরৌ (ফরাসী বিজ্ঞানী) ৩। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড (কানাডিয়ান বিজ্ঞানী)।
শুরু করি মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী আর্থার আশকিনকে দিয়ে। তিনি লেজার ফিজিক্সে লেজার টুইজার্স নামক একধরনের প্রযুক্তি আবিষ্কার করে নোবেলের খাতায় নাম লিখাতে পেরেছিলেন। প্রশ্ন হল- এ প্রযুক্তিটি কি?
ধরুন, চিমটিজাতীয় কোনও বস্তু দিয়ে আপনি ছোটখাটো কোনও বস্তু, যেমন- পরে থাকা গ্লাসের টুকরো, হাতঘড়ির ছোট ব্যাটারি, সূচ, বা সহজে হাত দিয়ে ধরা যায়না এমন ক্ষুদ্র কিছু ধরতে পারেন। কিন্তু ধরুন আণবিক জগতে যখন আমরা কোনও ভাইরাস, কোনও ধরণের জীবাণু, কণা, এমনকি জীবন্ত কোষ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে যাব, সেক্ষেত্রে এমন আণবিক ‘চিমটি’ কোথায় পাব?
এই অসাধ্য কাজটিই সাধন করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানী আর্থার আশকিন। ১৯৮৭ সালে সর্বপ্রথম তিনি লেজার টুইজার্স পদ্ধতিতে একটি ব্যাকটেরিয়াকে চিমটি দিয়ে যেভাবে ধরে রাখা যায়, সেভাবে আটকে রাখতে সক্ষম হোন ব্যাকটেরিয়াটির কোনোরূপ ক্ষতিসাধন ছাড়াই। অনেকটা বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে বর্ণিত কাল্পনিক প্রযুক্তির মতো! তাঁর এ আবিষ্কার এখন জৈব গবেষণা যেমন- ভাইরাস বা অণুজীব বিষয়ক গবেষণায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন করবে।
এদিকে ফরাসী বিজ্ঞানী মৌরৌ এবং কানাডিয়ান বিজ্ঞানী ডোনা যৌথভাবে আরও সামনে এগুতে শুরু করেন লেজার প্রযুক্তি নিয়ে। তাঁরা এক্ষেত্রে আল্ট্রা-শর্ট অপটিক্যাল পালস আবিষ্কারে সক্ষম হোন।
সাধারণত আলোক সঞ্চালনের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে দূরবর্তী স্থানে সঞ্চালন করা দুঃসাধ্য ছিল। কারণ, অতি উচ্চতীব্রতার পালস তৈরি করায় যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা ছিল। আর এই দুঃসাধ্য কাজটিকেই সাধ্য করেছেন ডোনা ও মৌরৌ।
প্রথমে তাঁরা লেজার পালসকে বিবর্ধিত করেন পালসের তীব্রতা কমানোর জন্য। এরপরে একে হঠাৎ সংকুচিত করেন। যদি লেজার পালসকে সময়মতো বিবর্ধিত করে হঠাৎ সংকুচিত করা হয়, তাহলে প্রচুর পরিমাণ আলোক শক্তি অতি ক্ষুদ্র স্থানে বা বিন্দুতে একীভূত হয়ে পড়ে, আর এতেই নাটকীয়ভাবে পালসের তীব্রতা বেড়ে যায়। এই পালস বিবর্ধন প্রযুক্তি এখন চক্ষু সার্জারিতে ব্যবহৃত হবে, যেখানে শুধু উচ্চ তীব্রতার লেজার রশ্মি ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি ক্যান্সার নিরাময়েও সক্ষম হবে।
উচ্চ তীব্রতার লেজার প্রযুক্তি এখন আরও তীব্র হয়েছে এবং এর পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে। এই প্রযুক্তি কোষ কিংবা ধাতুর কোনোরূপ ক্ষতিসাধন ছাড়াই কার্যসিদ্ধি করতে সক্ষম। একে বলা হয় পালস বিবর্ধন প্রযুক্তি বা সিপিএ। সার্জারি ছাড়াও এ-প্রযুক্তি বিজ্ঞানের আরও অসংখ্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, যা দেখার জন্য গোটা দুনিয়াবাসী অধীর আগ্রহ নিয়ে এখন অপেক্ষা করছে।



অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


