পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটু বেলা করে। বেলকনিতে গিয়ে দেখলাম আজ একটা ক্রুইজ শিপ এসেছে হ্যাভেনসাইট ডকে। আমাদের বেলকনি থেকে যে ডকটা দেখা যায়, ওটাই হ্যাভেনসাইট ডক।
আরো একটা ডক আছে এখানে ক্রুইজ শিপ ভেড়ার জন্য। শিপের গায়ে কার্নিভ্যাল ক্রুইজের সাইন দেখা যাচ্ছে এতো দূর থেকেও। সারাদিন এই শিপের যাত্রীরা আজ এই দ্বীপে ঘুরাঘুরি করবে। এরপর সন্ধ্যার দিকে আবার রওনা হবে নতুন কোন গন্তব্যে, নতুন কোন দ্বীপপানে। একবার এরকম একটা ক্রুইজ শিপে করে গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে কয়েকদিনের জন্য।
সেদিনের প্রথম গন্তব্য হ্যাভেনসাইট মল। হ্যাভেনসাইট ডকের সাথেই লাগোয়া হ্যাভেনসাইট মল। ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের শপিং মলগুলোর মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ মল নাকি এটাই। এজন্য সেইন্ট থমাসকে এই দ্বীপাঞ্চলের ‘শপিং মক্কা’ বলা হয়। ক্রুইজ শিপ থেকে নেমে যাত্রীরা প্রথমেই এই মলে পা রাখেন। মোটামুটি সব ধরনের ব্র্যান্ডেড জিনিসপাতি পাওয়া যায়। দাম অবশ্যই মেইনল্যান্ড থেকে অনেক বেশি।
স্যুভেনিয়রের খোঁজে এই দোকান সেই দোকান ঘুরতে ঘুরতে খুব মজার একটা জিনিস পেয়ে গেলাম। ম্যাজিক টি শার্ট। সাদা রঙের টি শার্টের উপর কালো রঙে আঁকা ছবি। রোদে নিলে দুই মিনিটে রং পরিবর্তিত হয়ে নানা রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। খুব মজা পেলাম এটা দেখে। মলে ঘোরাঘুরি ও স্যুভেনিয়র সংগ্রহ শেষে চলে এলাম প্যারাডাইস পয়েন্টে। হ্যাভেনসাইট মলের কাছেই পাহাড়ের উপর এটা আরেকটা লুকআউট পয়েন্ট তথা রেস্টুরেন্ট। সেখান থেকে ক্যাবলকারে চড়ে নিচে আসা কিংবা নিচ থেকে উপরে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
সেন্ট থমাসের যে কয়টা লুকআউট পয়েন্ট আছে, তার মধ্যে এই প্যারাডাইজ পয়েন্টই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। দিনটাও ছিল অনেক উজ্জ্বল আর রোদেলা। পাহাড়ের উপর থেকে সেই একই নীল সমুদ্র আর সবুজ দ্বীপের অসাধারণ দৃশ্য। তবু এই দ্বীপের অন্য যে কোন লুকআউট পয়েন্টের চেয়ে এই পয়েন্ট থেকে দেখা দৃশ্যই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে।
স্বর্গ তো দেখিনি। তবে স্রষ্টার তৈরি এই মর্ত্যলোক যদি এতো সুন্দর হয়, স্বর্গ কেমন হবে তা কিছুটা হলেও অনুমেয়। প্যারাডাইজ পয়েন্ট নামটা যথার্থই মনে হলো আমার সেই মুহূর্তে। হ্যাভেনসাইট ডকে ভেড়া কার্নিভাল ক্রুইজ শিপ এখান থেকেও দেখা যাচ্ছে। অবশ্য স্কাইরাইড নামক বস্তুখানি চলাচলের জন্য স্থাপিত ক্যাবল লাইন প্যারাডাইজ পয়েন্টের সৌন্দর্য অনেকখানিই ম্লান করে দিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
সমুদ্র আর সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা দ্বীপের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে রেস্টুরেন্টে বসে পেট পূজো আর গলা ভিজিয়ে নেয়ার সুযোগও নেয়া গেল। এরপর স্কাইরাইডে চড়ার পালা। প্যারাডাইজ পয়েন্টের স্কাইরাইড। ট্রিপ এডভাইজর রিকমেন্ডেড। স্বল্প সময়ে এরিয়াল ভিউ দেখার জন্য ক্রুইজ শিপ অভিযাত্রীদের জন্য মাস্ট ডু। আমরা স্কিপ করতেই পারতাম। এতোবার পাহাড় বেয়ে ড্রাইভ করে উঠেছি আর নেমেছি যে, পাহাড়ের উপর থেকে এরিয়াল ভিউ, সমুদ্র ভিউ সব দর্শন হয়ে গিয়েছে ইতোমধ্যে।
লাঞ্চ ও স্কাইরাইড শেষে ওখানেই বসলাম খানিক শিথিল হতে, আর মন ভরে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করতে। আমার মেয়ে আমীরাকেও ছেড়ে দিলাম বাঁধন আলগা করে। এতক্ষণ সে তার বাবার বুকে ক্যারিয়ার ব্যাগে বাঁধা ছিল। এরই মধ্যে দেখি, আকাশে মেঘ করেছে। ঝলমলে রোদেলা দিন খুব দ্রুতই তার চেহারা পাল্টে ফেলেছে। বাতাসও আস্তে আস্তে জোরদার হচ্ছে।
এখানে এসে আমরা একদিনও আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখিনি। চেক করে দেখলাম, বজ্রবৃষ্টি আসন্ন, ঝড় হওয়ারও জোরদার সম্ভাবনা আছে। আমার অনেকদিনের লালিত গোপন ইচ্ছা, যে সমুদ্রে ওই মেঘের জন্ম, সে সমুদ্রেই তার বিসর্জনের সাক্ষী হবো। সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে সাগরের বুকে বৃষ্টি হতে দেখবো, আর সেই বৃষ্টিতে ভিজবো। সেই সুযোগ আর বৃষ্টি দুইটাই আসন্ন বুঝে আর দেরি করলাম না। পাহাড় থেকে আরো পাহাড় ডিঙিয়ে রওনা হলাম ‘হাল বে’ নামের আরেকটা সৈকতের উদ্দেশ্যে।
পথিমধ্যে কোনো এক পাহাড়ে উঠার পরই দেখি চারদিক থেকে ধোঁয়াটে ভেজা মেঘ আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই দ্বীপের পাহাড়ি রাস্তাগুলো এমনিই খুব বেশি নিরাপদ নয় ড্রাইভের জন্য। তার উপর আমাদের গাড়িও বেশি সুবিধার না, ড্রাইভও করতে হয় রাস্তার উল্টোদিকে। তাই একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু পাভেলোর বেশি অসুবিধা হলো না। নিরাপদেই নেমে এলাম ‘হাল বে’তে।
‘হাল বে’তে এসে একটা মজার জিনিস দেখলাম। ছোট বড় অ্যাকুরিয়ামে লাল-নীল কত মাছই তো দেখেছি। স্টিং রেও দেখেছি কত! কিন্তু সরাসরি সমুদ্রপাড়ে এই প্রথম দেখলাম। স্নোর্কেলিং করলে হয়তো আরো আগেই দেখতে পেতাম। কিন্তু সাহসের অভাবে কখনো করা হয়নি। কিন্তু এখানে একদম পাড়ে দাঁড়িয়েই সব দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছু স্টিংরে দেখলাম ঘোরাফেরা করছে। সাথে রঙবেরঙ্গের অনেক ছোট ছোট মাছ। বাচ্চাদের মতো খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে গেলাম আমি।
অবশ্য পাভেলোর মতে, আমি সবসময়ই খুশি হলে বাচ্চাদের মতো উৎফুল্ল হই। মেরিন লাইফ দেখতে দেখতে দেখলাম এক যুগল তাদের পাওয়ার বোট নিয়ে ফেরত আসছে। এরকম একটা বোটে চড়তে খুব ইচ্ছা হয় আমার। তাই পাভেলোকে বললাম, ওই বোটে বসে একটা ছবি তুলি অন্তত, চড়তে না পারি। ছবি তুলতে গিয়ে ওই যুগলের সাথে কিছুটা আলাপ পরিচয় হলো। তারা লিভ টুগেদার করছেন প্রায় বছর দুয়েক।
ছেলে সঙ্গীটি আমাদের শহর, মানে আটলান্টা থেকেই জব ছেড়ে দিয়ে এখানে সেইন্ট থমাসে মুভ করেছেন মাস ছয়েক আগে। নিজেদের শহরের মানুষের সাথে এতো দূরে এসে পরিচিত হয়ে বেশ ভালো লাগলো। মেয়ে সঙ্গীটির এখানে একটা স্টোর আছে, বাসাও আছে। যখনই মন চায় তারা বেরিয়ে পড়েন বোট নিয়ে সমুদ্রে। সাথে থাকে দামি হুইস্কির বোতল। পাড় মাতাল হয়ে ফিরে আসেন। সেদিনও মেয়ে সঙ্গী মাতালই ছিলেন। বিরক্তও হচ্ছিলেন কিছুটা তার সঙ্গীর উপর আমাদের সাথে বেশি আলাপ করছে দেখে।
বোটে বসে ছবি তুলতে গিয়েও টের পেলাম ড্রিংকস এর কড়া গন্ধ। খালি বোতল পড়ে আছে একটা। মনে হলো, জীবনের সব আনন্দ বুঝি এদেরই জন্য। ছয় মাস ধরে এদের অবকাশ চলছে, এখনো শেষ হয় না। বাধা-বিপত্তি আর উদ্বেগবিহীন জীবন। কারো প্রতি দায়বদ্ধতাও নেই। ইচ্ছে হলো, আর কাজ ছেড়ে দিয়ে দূর দ্বীপে এসে পড়লো! কিছুটা লোভও হলো এদের এমন জীবন দেখে।
এসেছিলাম সমুদ্রপাড়ে বৃষ্টি দেখতে। কিন্তু বাতাস আর মেঘ বলছে ঝড় আসন্ন। ঝড় শুরুর আগের সেই থমথমে মুহূর্ত! বাতাসে হালকা বৃষ্টির ঝাঁপটা। ঠিক এই মুহূর্তটা আমি ভীষণ ভালোবাসি। এদিকে কন্যার মনেও ঝড়ের ঘনঘটা। কোন এক অজানা কারণে সে ‘হাল বে’তে আসার পর থেকেই একটু পর পর কাঁদছে। মুড আরও বিগড়াতে পারে যে কোন সময়! তাই সাগরের বুকে বৃষ্টি বিসর্জন দেখা কিংবা সাগরপাড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, কোনটারই ঝুঁকি নিতে পারলাম না। তার উপর পাহাড়ি পথ, অচেনা রাস্তা। দীর্ঘলালিত গোপন ইচ্ছা অপূর্ণ রেখেই তাড়াতাড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ হলো।
ফিরে যেতে যেতে দেখলাম, দূরের পাহাড়ের চূড়ায় মেঘ ঘন থেকে ঘনতর হয়েছে। পরম মমতায় মেঘ ছুঁয়েছে পাহাড়কে, আর পাহাড় ছুঁয়ে আছে মেঘকে। এ যেন তাদের কতকালের পরম আরাধ্য মুহূর্ত! মেঘ আর পাহাড়ের গভীর মিতালি! কিন্তু এ বন্ধন তো চিরদিনের নয়। বিরহের সুর বেজে উঠেছে ইতোমধ্যে। একটু পরেই পাহাড়ের কান্না হয়ে ঝরে পড়বে এই মেঘ, আর চিরকালের জন্য বিলীন হয়ে যাবে সাগর স্রোতে। আবার নতুন কোন মেঘের সাথে মিতালী হবে পাহাড়ের।
ভাবুক হয়ে গেলাম দেখতে দেখতে। ব্যাথাতুর হয়ে উঠলো হৃদয়। প্রিয়জন হারানোর বেদনা উথলে উঠেছে আমার অন্তরেও। কোন এক কালে আমার পানে আর্দ্র নয়নে অপলক চেয়ে থাকা মুখটি আজ মনে পড়ছে ভীষণ। কখনো মনের কথা মুখ ফুটে বলতে না পারা সে মায়াবি মুখখানি।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি শুরু হলো। কোন এক জায়গায় এতো বেশি বৃষ্টির মুখোমুখি হলাম যে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন বৃষ্টির সাথে প্রথম সাক্ষাত হয়েছিলো একবার ফ্লোরিডা থেকে আটলান্টা ফিরে আসার সময়। কিন্তু তখন সমতলে ছিলাম। আর এখন পাহাড়ে, দূরের অচেনা এক দ্বীপে। তাই প্রমোদ গুণলাম মনে মনে। আলহামদুলিল্লাহ, কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই নিরাপদে ফিরে আসলাম রিসোর্টে। পাভেলোকে অনেক ধন্যবাদ, বারবার বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারার জন্য।
মেয়েকে নিয়ে তার বাবা চলে গেলো রুমে। আর আমি একা বৃষ্টিতে ভেজার জন্য নেমে পড়লাম রিসোর্টসংলগ্ন নিভৃত পাহাড়ি নিকুঞ্জে। বৃষ্টিস্নাত সেই একাকী মুহূর্তটা ভীষণ প্রিয় হয়ে আছে আমার সেইন্ট থমাসে কাটানো মুহূর্তগুলোর মাঝে। কতকালের পরম আরাধ্য ছিল যেন ওই সময়টাই। মাঝে মাঝে শুধু নিজেকেও কিছুটা সময় দেয়া দরকার বৈকি।
রুমে ফিরে আসার পর শুরু হলো আসল ঝড়। অন্ধকার আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চিড়ে দিচ্ছে বিজলি। সেই সাথে মুহূর্মুহু বজ্রপাত। ওই রাতটা একটা বিশেষ রাত ছিল আমাদের জন্য। অনেক মিষ্টি-মধুর স্মৃতি। পরদিন আমাদের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। আমীরাকে ঘুম পাড়িয়ে ধূমায়িত গরম কফি নিয়ে বসলাম দু'জনে ব্যালকনিতে। রাতের প্রথম প্রহর ব্যালকনিতে বসে ঝড় দেখতে দেখতে কাটলো আমাদের। ক্যারিবিয় সাগরের বুকে ঝড় উঠেছে। আর আমরা সেই ঝড় উপভোগ করছি ক্যারিবিয়ানেরই এক দ্বীপের ব্যালকনিতে বসে নিরাপদ আশ্রয়ে। সত্যিই অনন্য অভিজ্ঞতা!
পরদিন আমাদের ভ্যাকেশনের শেষদিন। তার একদিন পরেই আমরা ফিরে যাবো আমাদের আসল দুনিয়াতে।
চলবে...
প্রথম পর্বের লিঙ্ক - ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডসঃ প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক - ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডসঃ দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক - ক্যারিবিয় স্বর্গ ভার্জিন আইল্যান্ডসঃ তৃতীয় পর্ব
শেষ পর্বের লিঙ্ক - যথাসময়ে যোগ করা হবে।
এই ভ্রমণকাহিনী সম্পর্কিত আরও ছবি দেখতে হলে ক্লিক করুন -
কৃষ্ণচূড়ার দ্বীপ... Saint Thomas, USVI
আমার ভ্রমণ সংক্রান্ত ইউটিউব ভ্লগ ও ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন নিচের লিঙ্কে -
Bangladeshi American Travel and Lifestyle
আমাকে ফেসবুকে ফলো করতে ক্লিক করুন - Sofia Nishi
আমাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করতে ক্লিক করুন - Sofia Nishi
আগ্রহী হলে দেখতে পারেন আমার কয়েকটি ভ্রমণ ভ্লগ -
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:১৪