somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরিয়াকে বুঝতে, প্রাক গৃহযুদ্ধ থেকে যুদ্ধোত্তর আসাদ শাষন ... ১

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ফ্রী সিরিয়ান আর্মি

বিগত বছরগুলোতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে আমরা মোটামুটি সবাই অবগত আছি। কিন্তু হঠাৎ করেই সিরিয়ায় রাশিয়া কতৃক কিছু ডেভেলমেন্টের কারনে ইচ্ছা হল, অনেক দিন ধরে মনে উঁকি মারা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে কেমন হয়। আচ্ছা কেন এই গৃহযুদ্ধ ? এখানে কারা করছে এই যুদ্ধ? আই এস আসলে কারা ?এত অল্পদিনেই তারা কিভাবে এত শক্তিশালী হয়ে গেল ? সিরিয়ান ফ্রি আর্মির নামও শোনা যায়, এই মিলিশিয়া গ্রুপটাই বা কারা? এই যুদ্ধের অভিষ্ট লক্ষ কি? শুধু কি বাশারকেই সরান, নাকি একটি গনতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলার ইচ্ছা ...? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি বিগত কয়েক দিনে। আর এর উত্তর খুঁজতে যেয়ে বিশ্বায়নের এই অবাধ অসীম ডিজিটাল যুগের তথ্য ভান্ডারে পেলাম অনেক অজানা বিষয়, পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত। পর্দার পেছনের ঘটনা, নানান কুট কৌশল আর অগুনিত কুশীলব, তাদের স্বার্থ ও স্বার্থোদ্ধারের অপচেষ্টা।


সিরিয়ান যুবাদের নিয়ে গঠিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মি

মুলত এসব নিয়েই সাজানোর চেষ্টা করেছি এই লেখাটিতে। লেখাটির মুল নিয়ামক হলো আজকের সিরিয়া কিভাবে আজকের সিরিয়া হয়ে উঠল তা, আর তথ্য উৎস হিসেবে নিয়েছি কিছু বিশ্বখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞদের লেখা, উইকিপিডীয়ার তথ্য আর কিছুটা আমার নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছু পড়ে সৃষ্ট হওয়া অনুভূতি।

আশ করছি পাঠক এই লেখা থেকে সহজ কথায় সিরিয়া সম্পর্কে অনেক কিছুর ধারনা পাবেন, জানবেন বর্তমান সিরিয়ার আদি কথা, জানবেন সাধারন সিরিয় নাগরিকদের কথা, তাদের সামাজিক আচার আচরন, বৈচিত্রতা ও সিরিয় সাধারন মানুষের আদি ও বর্তমান সমাজ সম্পর্কে। আর জানবেন মাত্রা ছাড়া যুদ্ধের ভয়াবহ হিংস্রতা, বর্বরতা আর নৃশংসতা।

তো চলুন দেখা যাক, রাজনীতি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, স্বার্থান্বেষী বিদেশীদের হস্তক্ষেপ ও লম্বা সময় ধরে চলে আসা ধর্মীয় উত্তেজনার ক্রমবর্ধমান ক্ষত থেকে সিরিয়া কিভাবে আজকের সিরিয়া হয়ে উঠল।

ভৌগলিক সিরিয়া

সিরিয়া একটি ছোট ও গরীব জনবহুল দেশ, ম্যাপে সিরিয়াকে ওয়াশিংটন স্টেট বা স্পেন এর মত লাগলেও দেশটির আবাদী জমির পরিমান এর মোট আয়তন ১৮৫ হাজার বর্গমাইলের মাত্র ২৫ ভাগ। এই অঞ্চল টাকে সিরিয়ার অর্থনৈতিক অঞ্চল বলে ধরে নিলে যা দাঁড়ায় ত হলো এই অর্থনৈতিক সিরিয়ার আয়তন, অস্ট্রেলিয়ার মেরীল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটকে জোড়া দিয়ে পাওয়া এলাকার আয়তন অথবা সুইজারল্যান্ড এর আয়তনের সমান বা কাছাকাছি একটা কিছু। সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকা জুড়েই দখল করে আছে ধুসর মরুভুমি। কিছু অঞ্চল পশুচারনের উপযোগী হলেও স্থায়ী চাষযোগ্য ভূ-পৃষ্ঠের পরিমান শতকরা ১০ ভাগেরও কম।

ভূ-মধ্যসাগর লাগোয়া একটি সরু বেল্টের মত এলাকা ছাড়া দেশটির বাকি সব অঞ্চল এর তাপমাত্রা অত্যন্ত চরম ভাবাপন্ন। যা সিরিয়ার ঘন ঘন ধুলি ঝড় এবং নিয়মিত খরার প্রধান কারন। নিকট অতীতে ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত একটানা ঘটে যাওয়া বিধ্বংসী ও বিপর্যয়কারী খরা দেশটির জনজীবনে গভীর ভোগান্তি বয়ে নিয়ে আসে। সিরিয়ার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া যাবতীয় খরার রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এই খরা। বিপর্যয়ের এটাই শেষ কথা নয়। এই খরা ছিল একটি লম্বা তালিকার একটি অনুক্রম মাত্র।



ধুলি ঝড়

২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সিরিয়া কমপক্ষে ৬০ টি উল্লেখযোগ্য ভয়াবহ রকমের ধুলি ঝড়ের কবলে পড়ে। লম্বা সময় ধরে চলমান এসমস্ত একটানা খরা আর ধুলিঝড় এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক ক্ষতিকর প্রভাব হচ্ছে এগুলো কর্ষণীয় জমি(topsoil) বা সহজ কথায় মাটির উপরিভাগের যে চাষাবাদ যোগ্য জমি তা পুরপুরি ধ্বংস করে দেয়। আর রাজনৈতিক ভাবে এটাই গৃহযুদ্ধকে উস্কে দেয়।
এখানেই শেষ নয়, প্রচন্ড রকম উচ্চ তাপমাত্রা, এহেন খরা ও বিধ্বংসী ধুলিঝড় বয়ে আনার সাথে সাথে বৃষ্টির পরিমানও উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেয়।

আমেরিকান ন্যাশনাল ওশানিক এ্যান্ড এ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর ২০১০ এর ভূ-মধ্যসাগরীয় ম্যাপে (নীচে)


লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শুধুমাত্র ইসরায়েলের কিছু অংশ, জর্ডান এবং লেবানন ছাড়া পুরো পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল ই দারুন ক্ষতিগ্রস্থ হয় (ম্যাপ এ লাল রঙে চিহ্নিত)। শুধু তাই নয় সিরিয়াতে উল্লেখিত সময় অর্থাৎ ২০১০ এ অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলোতেই বৃষ্টিপাত হয় মাত্র ২০ থেকে ৪০ সেঃমিঃ(৮ থেকে ১৫ ইঞ্চি) এর মত । যেখানে চাষাবাদ টিকিয়ে রাখতে ২০ সেঃমিঃ বা ৮ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতকে ধরা হয় পরম নুন্যতম মাত্রা, সেখানে দেশটির জাতীয় বৃষ্টিপাতের গড় ছিল ১০ সেঃমিঃ(৪ইঞ্চি) এরও কম। উপরন্ত সিরিয়াতে যতটুকুন বৃষ্টিপাতই হোক তা বেশির ভাগ ই হয় শীতকালে আর যা কিনা চাষ করা শষ্যাদির জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়। তাই যেসব এলাকাতে ৪০ সেঃমিঃ এর নীচে বৃষ্টিপাত হয় সেসব এলাকাকে পুরোপুরি সেচ ব্যাবস্থার উপরই নির্ভর করতে হয়। এদিকে এর মধ্যে একই সাথে নিকট অতীতের(২০০৬ থেকে) বছরগুলোতে চলা খরার সময় ভূ-গর্ভস্থ পানি এত পরিমান তোলা হয়ে যায় যে পানির লেভেল একজন সাধারন কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যায়। ভূ-গর্ভস্থ পানি ছাড়া সিরিয়াতে বিকল্প পানির এক মাত্র উৎস দেশটির প্রধান নদী ইউফ্রেতিস। যার পানির বেশির ভাগই তুরস্ক এবং ইরাক টেনে নেয়। ফলাফল স্বরুপ গৃহযুদ্ধ শুরুর আগের বছরে সিরিয়া শুধুমাত্র ১৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সেচ ব্যাবস্থার আওতায় আনতে সমর্থ হয়।

এ মরন লড়াই শুরু হবার পরে, বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে ২০১২ সালে সিরিয়াতে কৃষিখাত শতকরা ২০ ভাগের মত জাতীয় আয়ের(জিডিপি) জোগান দেয় এবং শতকরা ১৭ ভাগ মানুষের কাজের ব্যাবস্থা নিশ্চিত করে। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ সঙ্ঘর্ষের আগে সিরিয়ার তেল ক্ষেত্র গুলো থেকে প্রতিদিন ৩৩০,০০০ ব্যারেল তেল তোলা হয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক বিষয় এই যে তারা তার মধ্য থেকে ৭০,০০০ ব্যারেল বাদে বাকি সব তেল নিজেদের কাজেই খরচ করে ফেলে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই তারা এত পরিমান তেল খরচ করতে বাধ্য হয়। তেল বিক্রি তাদের জিডিপি’র মাত্র ২০ ভাগ যোগান দিতে সক্ষম হয় যা সিরিয়ার তৃতীয় স্থান এর রপ্তানী আয়। ইউ.এস. এনার্জি ইনফরমেশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর তথ্য অনুযায়ী উৎপাদন সাধারন অবস্থার চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগেরও কম হ্রাস পায়। সাধারনত সিরিয়ার তেলের মান নিম্নমানের, অম্ল বৈশিষ্টপুর্ন এবং রিফাইনিং এর জন্য এক্সপেন্সিভ।


সিরিয়ান গ্যাস ও অয়েল ফিল্ড

প্রধানত এনার্জি সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি যা দেশটির সক্ষম পুরুষ নাগরিকদের এক তৃতীয়াংশের কাজের ব্যাবস্থা করে এবং প্রায় সমপরিমান শতাংশ জাতীয় আয়ের যোগান দেয়। যুদ্ধ শুরুর আগে পুর্বাঞ্চলের তেল ক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা তেল ভূ-মধ্যসাগরের দিকে স্থানান্তর করা হত। যুদ্ধের কারনে আবশ্যিক ভাবেই সেই প্রজেক্ট গুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন সিরিয়ায় কিছু কটেজ টাইপের ইন্ডাস্ট্রি অবশিষ্ট আছে, যেগুলো ক্রুড অয়েল রিফাইনিং এর কাজ করছে তাদের নিজেদের ব্যাবহারের জন্য আর চোরাচালানের মাধ্যমে বিক্রির জন্য।

অপরদিকে সিরিয়া শুধু একটি দেশই নয়, একটি অত্যন্ত ঘন বসতিপুর্ণ দেশ। ২০১০ নাগাদ এর জন সংখ্যা ২কোটি ৪০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। ফলস্বরুপ দেশটির জন প্রতি কৃষি জমির পরিমান দাঁড়ায় দশমিক ২৫ হেক্টর, যা এক একরের তিন ভাগের একটু বেশি। শুধুমাত্র আবাদি সিরিয়ার হিসাব করলে এর জনসংখ্যার ঘনত্ব দাঁড়ায় ওহিও কিংবা বেলজিয়ামের ৫ গুন। কিন্তু তুলনা শুধুই লোকসংখ্যায়, ওহিও কিংবা বেলজিয়ামের আয়ের তুলনা কোনভাবেই সিরিয়ার সাথে তুলনার যোগ্য নয়। হ্যাঁ যদি সিরিয়ার লোকসংখ্যা কম হত, তাহলে হয়ত তারা মান্যেজ করতে পারত। যদিও সেই ম্যানেজ টা হত কোন মত, কখনই তা ধনী দেশগুলোর মত হত না। কিন্তু এসব কথা বাতুলতা মাত্র। একদিকে বিগত বছর গুলোতে তাদের রিসোর্স যেমন কমে গেছে আরেকদিকে জনসংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
মূল কথা যা, তা এতক্ষনে নিশ্চই আমরা বুঝতে পারছি। আর তা হোল, জনসংখ্যা আর সংস্থানের(যোগান) অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা। যদিওবা কৃষিখাতে ভাল বীজ ও অধিক কার্যকরী চাষাবাদ এর কারনে উৎপাদনে মার্জিনাল কিছু উন্নতি হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো কোন ভাবেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তুলনীয় ছিল না।
অধিকন্ত দেশে জনসংখ্যা যেমন বেড়েছে তারই সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের মত পার্থক্যও বেড়েছে। তাদের যা আছে তা বিলি বন্টন ব্যাবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে সিরিয়ান নাগরিক সমাজ কখনই একমত হতে পারেনি।

সুতরাং এখানে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে তাদের সামাজিক নিয়ম বা সামাজিক চুক্তি গুলো খুবই গুরুত্বপুর্ন একটা বিষয়। সিরিয়ান নাগরিক সমাজে একে অপরের প্রতি দৃষ্টিভংগী এবং সম্মিলিত নাগরিক সমাজের সরকারের প্রতি দৃষ্টিভংগী প্রথমে প্রকাশ পেয়েছে, নানা ভাবে বিকশিত হবার চেষ্টা করেছে। ক্রমাগত উদ্ভুত সমস্যার সমাধান খুঁজেছে এবং একসময় ব্যার্থ হয়ে তা পরবর্তিতে ভেঙে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে সবাই কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে এই যুদ্ধে। যে চরম হতাশা আর কষ্টের জীবন তারা গত ৪/৫ বছর ভোগ করছিল আসলে তা থেকে যে কোন মুল্যে মুক্তির জন্যই শুরু হয়েছে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।

সিরিয়ান ঐতিহ্য

সিরিয়ার ইতিহাস শুরু থেকেই কেবলমাত্র যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস। যখন থেকে ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে, সিরিয়াকে নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তারও আগে থেকে। মুলত বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদি শত্রুরাই এই সমস্ত যুদ্ধের প্রধান পক্ষ, বিপক্ষ। খৃষ্টীয় শতকের শুরু থেকেও যদি ধরা হয়, তবুও দেখা যায়, সিরিয়ার দখল নিয়ে যুদ্ধ করেনি এমন সম্রাট এবং সাম্রাজ্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর। প্রাচীন মিশরীয় সাম্রাজ্য, হিতিতি সাম্রাজ্য, এসিরিয়ান, পারশিয়ান, মেসিডোনিয়ান গ্রিক, রোমান সাম্রাজ্য, মঙ্গলীয়ানরা, তুর্কীরা এবং বিগত কয়েক শতকের পরাক্রমশালী বৃটিশ সাম্রাজ্য এবং ফ্রান্স যুগে যুগে এই অঞ্চল দখলে রাখার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে গেছে।
তবে শুধুমাত্র খৃষ্টীয় ৭ম ও ৮ম শতকের উমাইয়া খীলাফতের(৬৬১-৭৫০ খৃষ্টাব্দ) শাষনামল ছাড়া সিরিয়া কখনই উল্লেখিত কোন সাম্রাজ্যেরই কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়নি। ইসলামের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান (রাঃ) আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর, খীলাফত কে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হয় ৬৬১ খৃষ্টাব্দে। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবীয়া ইব্‌নে আবু সুফিয়ান এর মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলই ই ছিল এই গৃহযুদ্ধের কারন। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী পিছু হটেন এবং হযরত মুয়াবীয়ার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় এই উমাইয়া খীলাফত। মুয়াবীয়া হযরত ওসমান (রাঃ) এর খীলাফাহ তে দির্ঘদিন ধরে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন এবং গৃহযুদ্ধের আপাত বিজয়ী হিসেবে উমাইয়া খীলাফত এর গোড়াপত্তন করেন এবং দামেস্ক শহরকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষনা দেন। পরবর্তীতে এই উমাইয়া শাষনামলের পুরো সময়টাতেই দামেস্ক তথা সিরিয়া উমাইয়া সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ও মুল শক্তির উৎস হিসেবে বহাল থাকে। উমাইয়ান শাষকগন মুসলমানদের বিজয় অব্যাহত রাখতে সমর্থ হন এবং একে একে ককেশাস অঞ্চল(বর্তমানে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, জর্জিয়া, ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক), ট্রানসক্সিয়ান(বর্তমান তুর্কেমিনিস্তান ও কাজাখাস্তান এর মর্ধবর্তী অঞ্চল), সিন্ধু(সিন্ধু নদের অববাহিক অঞ্চল বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান) ও আইবেরিয়ান উপদ্বীপ অঞ্চল(বর্তমান স্পেন, আন্দোরিয়া, পর্তুগাল, জিব্রাল্টর ও ফ্রান্স) এই খীলাফতের অন্তর্ভুক্ত করতে সমর্থ হন। উমাইয়ান খীলাফত তার সর্বচ্চো সফলতায় পৌঁছায় যখন বর্তমান এশীয়া ও ইউরোপ মিলিয়ে প্রায় ১৫ মিলিয়ন স্কয়ার কিঃমিঃ(৫.৭৯ মিলিয়ন স্কয়ার মাইল)এলাকা তাদের শাষনের অধীনস্ত হয়। যা পৃথীবির ইতিহাসে এলাকা বিবেচনায় এখনো পর্যন্ত সর্ব বৃহৎ এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ৫ম বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত।


উমাইয়া খীলাফত (৬৬১-৭৫০ খৃষ্টাব্দ)

এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা হোল এই পুরো খেলাফতী আমলে খৃষ্টান, ইহুদি ও অন্যান্য স্বতন্ত্র ধর্মগোষ্ঠিগুলো একই সমাজে পাশাপাশি শান্তিপুর্ন ভাবে অবস্থান করে এবং তারা পরিচালিত হত তাদের নিজস্ব সামাজিক আইন কানুন দ্বারা । তারা স্বশাষিত ছিল এবং নিজ নিজ ধর্ম প্রধানদের দেয় বিধি বিধান মেনে চলত এবং যাবতীয় বিচার আচারও ধর্ম প্রধানদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি দ্বারা সম্পন্ন হত। উমাইয়া শাষকগন বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করেন যা হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) এর জীবদ্দশায় দিয়ে যাওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হত। হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বলে যান যে জিজিয়া কর দিতে রাজি এমন সকল আব্রাহামিক ধর্মগোষ্ঠি যার যার ধর্ম পালন করার সুযোগ পাবেন । তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের দ্বীতিয় খলীফা হযরত উমর (রাঃ) বিষয়টি অনুসরনের পাশাপাশি গরীব মুসলমান ও অমুসলমানদের কল্যানে, কল্যান রাষ্ট নিতী প্রনয়ন করেন। উমাইয়া শাষকগন পুর্ববর্তী খলীফাদের দ্বারা সুচিত চলমান এ সমস্ত নিতী অনুসরন অব্যাহত রাখা নিশ্চিত করেন।

উমাইয়া খীলাফতে অমুসলিম নাগরিকদের শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় শাষন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশি কর প্রদান করতে হত। মুসলিম ও খৃষ্টানদের সামাজিক সম্পর্ক এ সময়ে ছিল পুরপুরি স্থিতিশীল। উমাইয়ারা প্রায়শই পার্শ্ববর্তী খৃষ্টান বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত, নিজ রাষ্ট্রে বহুসংখ্যক খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী থাকা স্বত্বেও তারা শুধুমাত্র সামাজিক সম্পর্ক ভাল থাকার কারনে এসব যুদ্ধ পরিচালনা করতে সাহস পেত এবং নিজ দেশে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে কখনই চিন্তিত ছিল না। উমাইয়া শাষকগন ৬৬১ থেকে ৭৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তাদের খীলাফত কায়েম রাখতে সমর্থ হয়। সিরিয়ার ইতিহাসে এটা অল্প সময়ের শাষন কাল বিবেচিত হলেও মুসলমানরা সিরিয়ান সমাজে দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব বিস্তার করে। যে কারনে এখনো পর্যন্ত সিরিয়ার সংখ্যাগরীষ্ঠ লোক সংখ্যা মুসলমান এবং তারা ইসলামিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।

ঐতিহাসিক ভাবেই সিরিয়া বরাবর ই ছিল ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত বিভিন্ন মতের ও ধর্মের মানুষের আশ্রয়স্থল। যারা নিজেদের মধ্যে পার্থক্য করত নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস ও জাতিগত আচার আচরন ও বৈশিষ্ট দ্বারা। এদের অনেকেই ছিল পুর্ববর্তী আক্রমন এর কারনে এ অঞ্চলে আসা অথবা দেশান্তরি মানুষের সমষ্টি।
বিগত পাঁচ শতকের বেশিরভাগ সময় আজকের সিরিয়া যা তখন ছিল তৎকালীন অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে, আসলে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষের এক মিশ্রিত জনপদ। এই জনপদে যেমন ছিল গোঁড়া খৃষ্টান, ক্যাথলিক খৃষ্টান সাথে আরো অন্যান্য দল উপদলে বিভক্ত খৃষ্টান গোষ্ঠি, তেমন ছিল গোঁড়া মুসলমান, আলাবি, ইসমাইলি ও আরো অন্যান্য উপদলে বিভক্ত শিয়া মুসলমান গোষ্ঠি, ছিল ইয়াজিদি, কুর্দ, ইহুদি এবং দ্রুজ সম্প্রদায়ের মানুষ আর এদের পাশাপাশি ছিল সুন্নি আরব মুসলমান গোষ্ঠি।


অটোম্যান সাম্রাজ্য (১২৯৯-১৯২৩ খৃষ্টাব্দ)

অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাষনামলে (সিরিয়ার সবচে লম্বা সময়ের শাষনামল) এ অঞ্চলের জনগন ও তাদের মানষপটের চেতনা মুলত সংগঠিত ছিল দুইভাবে।
প্রথমত, সেখানে জাতি রাষ্ট্র হিসাবে সিরিয়াকে নিয়ে কোন ধারনা বা চেতনাই ছিল না বরং ছিল প্রাদেশিক চিন্তা চেতনা। আর প্রাদেশিক ধ্যান ধারনা গুলো গড়ে ওঠে প্রাচীন নগর গুলোকে কেন্দ্র করে । বিশেষ করে দামেস্ক ও আলেপ্পো নগরীর নাম এখানে উল্লেখযোগ্য। দামেস্ক যাকে ধরা হয় আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন স্থায়ী ও জীবিত নগরী হিসেবে।

একটি নিজস্ব রাজ্য বা প্রদেশের ধারনা যা একটি জাতিগত রাষ্ট্রের ধারনা থেকে অনেক কম সেটাও, সিরিয়ান সমাজের রাজনৈতিক ও মানসিক চিন্তা চেতনায় ১৯ শতকের শেষ ভাগের আগে পর্যন্ত ছিল না। এ অঞ্চলের বাসিন্দারা যা আজকের সিরিয়ার মধ্যে পড়ে, অটোম্যান সাম্রাজ্যের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে স্থানান্তরিত হত, এবং তাদেরকে তৎকালীন সিরিয়ান সমাজ আগন্তক বা বিদেশী হিসেবেও দেখত না। এবং এটাই ছিল স্বাভাবিক। তখনকার বয়োজেষ্ঠ কোন নাগরিক কে যদি জিজ্ঞাসা করা হত তারা কোথা থেকে এসেছে বা তাদের আদি নিবাস কোথায় ? তখন তারা সেই জায়গা, গ্রাম বা প্রদেশের নাম করত যেখানে তারা ইতিপুর্বে কর দিয়ে এসেছে।


অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রশাষনিক ম্যাপ

দ্বিতীয়ত, কয়েক শতকের অটোম্যান সাম্রাজ্যের ধরনটাই ছিল এরকম যে প্রতিটি বিষয় বস্তু তাদের নিজস্ব ধ্যান ধারনা ও রিতীনিতী অনুযায় পরিচালিত হত। শাষন বিষয়টা এমন ছিল না যে সেটা প্রজাদের দৈনন্দিন জীবনে অনধিকার প্রবেশ করতে চায়। মুসলিমরা হোক সে তুর্কী বা আরব বা কুর্দ, সাম্রাজ্যের প্রচলিত সরকারী ইসলামী নিতী ও আইন কে সমীহ করত। অন্যান্য গোত্র বা ধর্মীয় জাতি স্বত্তাগুলো স্বায়ত্ব শাষিত ছিল শুধু মাত্র বৈদেশিক সম্পর্ক এবং আর্মির বিষয়বস্তু বাদে। নীচের ম্যাপটা থেকে তৎকালীন বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতি-গোত্রের বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিটমহল গুলোর(যা আজকের সিরিয়ার রুপ নিয়েছে) মোটামুটি একটা ধারনা পাওয়া যায়।


সিরিয়ার তৎকালীন ধর্ম বা গোত্রের ভিত্তিতে ভাগ করা ছিটমহল

তবে ম্যাপে যেটা দেখা যাচ্ছে না, তা হলো এই সব দল বা উপদল গুলো প্রধানত মুসলিম নগরীগুলোতে স্থানান্তরিত হত এবং নগরীর কোল ঘেঁষে আলাদা আলাদা ভাবে বর্তমান দুনিয়ার চায়না টাউন টাইপের মিনি টাউন গড়ে বসবাস করতে পছন্দ করত। ছিটমহলে হোক বা মুসলিম প্রধান নগরীগুলোর আশেপাশে হোক, সকল অমুসলিমরা তাদের নিজস্ব ঢং এর পোষাক আশাক পরত এবং নিজেদের ভাষায় কথা বলত। তারা সবসময় তাদের তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মকর্তাদের হয় নিয়োগ দিত অথবা নির্বাচন করে নিত যারা আসলে সরকার কে দেয়(প্রদত্ত) কর তাদের মধ্যে সঠিক ভাবে ভাগ করে দেয়ার দায়িত্ব নিত, তাদের স্কুল চালাত এবং যতটুকুন তাদের সাধ্যে কুলায় চিকিৎসা সেবা ও সমাজ কল্যান মূলক কাজকর্ম করত । যেহেতু এইরুপ ব্যাবস্থার উল্লেখ কোরআন ও হাদীসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত, সেহেতু অমুসলিম গোত্রগুলোর এসমস্ত কর্মকান্ড গুলোকে সন্মান করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। ফলস্বরুপ আজকের সিরিয়া যখন আজকের সিরিয়া হিসেবে আকৃতি নেয়, তখন এটি একটি সমৃদ্ধ, বিচিত্র, এবং সহনশীল সামাজিক ঐতিহ্য উত্তরাধিকারসূত্রে আপনা আপনিই পেয়ে যায়।


ফ্রেঞ্চ সিরিয়া

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোম্যান সম্রাট জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার পক্ষ নেয়ায় গ্রেট বৃটেন ও ফ্রান্স অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং কঠিন ও ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কিন্তু চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার অনেক আগেই বৃটেন ও ফ্রান্স ১৯১৬ সালে একটা সমঝোতায় আসে এবং পুরো মধ্য প্রাচ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। ইতিহাসে যা সাইক্স-পিকট এগ্রিমেন্ট হিসেবে পরিচিত। বৃটেন পরবর্তীকালে আরব বিদ্রোহের নেতাদের সাথে (যারা কিনা অটোম্যান সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়ছিল), বেশ কিছু লেনদেন বা চুক্তি করে যে গুলো ছিল ফ্রান্সের সাথে করা এই এগ্রিমেন্টের সাথে অনেক সাংঘর্ষিক এবং যা এগ্রিমেন্টকে পরিবর্তিত করে ফেলার মত। কিন্তু ফ্রান্স তার বেশির ভাগ টার্মস এবং কন্ডিশনের বিষয়েই স্ট্রীক্ট থাকে। পরবর্তীতে ফ্রান্স বৃটেন এর কাছে হেরে যায় ও সুন্নি আরব মুসলিম ,ও কুর্দি অধ্যুষিত এক বিশাল এলাকা যা উত্তর ইরাক হওয়ার কথা ছিল তা হারায়।


ফ্রান্স নেয় বেশির ভাগ সিরিয়ায় পড়েছে যে পাশে A দ্বারা চিহ্নিত সেই দিকটা আর বাকিটা বৃটিশদের অর্থাৎ B দ্বারা চিহ্নিত এলাকা।
কেউ কি এখানে প্রশ্ন করার আছে, তোমাদের এই ভাগাভাগির অধিকার কে দিয়েছে ???? কেউ থাকুক বা না থাকুক আসলে প্রশ্ন এই দুদেশের নাগরিকদের মনেই ছিল, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দুই পরাশক্তির দখলদারী বৈদেশিক নিতী ও তাদের মিলিটারি পাওয়ার তাদের এই দখলদারিত্বের বৈধতা নিশ্চিত করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আরব বিদ্রোহের নেতারা দামেস্কে একটি রাজ্য স্থাপিত করে এবং প্যারিস পিস কনফারেন্স(যা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জয়ী সহযোগী দেশ গুলোর একটা অধিবেশন। এটি ১৯১৯ সাথে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়, মুলত বিভিন্ন দেশের কুটনৈতিকরা এই অধিবেশনে যোগ দেন। মুল এজেন্ডা ছিল পরাজিত দেশ গুলোর বিরুদ্ধে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং বিশ্ব জুড়ে এই জয়ী দেশ গুলোর পরবর্তী দাদাগিরি বিষয়ক পদক্ষেপ গুলোর সিদ্ধ্বান্ত গ্রহন। পৃথিবীর ৩২ টারও বেশি দেশ ও জাতি এতে অংশগ্রহন করে) এ তাদের নতুন রাজ্যের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দাবি করে। কিন্তু ফ্রান্স বৃটেনের সাথে করা তার পুর্ববর্তী চুক্তির বাস্তব রুপদান দেখতে ছিল বদ্ধপরিকর। সুতরাং পরবর্তিতে ফ্রান্স ১৯২০ সালে দামেস্ক আক্রমন করে এবং দামেস্কের শাষন ক্ষমতা কুক্ষীগত করে নেয় ও পুরো সিরিয়াকেই অবৈধ ভাবে নিজেদের কলোনি হিসেবে ঘোষনা করে। বিষয়টা তখনকার লিগ অব নেশন (আজকের জাতিসংঘের আদলের সংস্থা) শর্ত সাপেক্ষে বৈধতা দেয়। শর্ত ছিল এই যে ফ্রান্স সিরিয়াকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে তুলবে। কিন্তু বিষয়টাতে ফ্রান্সের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব ছিল। তারা পরবর্তী তিন বছরে দেশটাকে পুরপুরি করায়ত্ত করতে ব্যাস্ত থাকে। পাশাপাশি এই অঞ্চল এর পরবর্তী রুপান্তর পক্রিয়া নিয়ে এগুতে থাকে। নিকটবর্তী প্রাক্তন স্বায়ত্বশাষিত মাউন্ট লেবানন ও বৈরুত কে নিয়ে প্রথমে তারা বৃহত্তর লেবানন গঠন করে।

যার উদ্দ্যেশ্য ছিল বৈরী পূর্ব ভু-মধ্যসাগরীয় এলাকায় নিজেদের ভরসাপুর্ন জায়গা নিশ্চিত করা। তাদের মূল লক্ষ ছিল এই অঞ্চলে খৃষ্টান আধিপত্য বিস্তার করা এবং বৃহত্তর লেবানন কে ততখানি বড় করা যতখানি হলে এটা একটা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের এই লক্ষগুলো ছিল অসংগত। কেননা তারা পার্শ্ববর্তী দামেস্ক থেকে যাদেরকে এনে এখানে বসতি গড়ে তোলে তাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। লেবানন সমাজকে একটা অসম সমাজে পরিনত করে তারা তাদের পূর্বের লক্ষে ক্ষ্যান্ত দেয়। ১৯২১ সালে তারা সিরিয়াকে খন্ডিত করে বিচ্ছিন্ন প্রশাষনিক ইউনিট স্থাপন করে। তারা উত্তর পশ্চিমে আলেকজান্দ্রিয়াকে আলাদা করে দেয় যা আবার পরবর্তীতে তুরস্কের সাথে সংযুক্ত হয়। তারা লাটাকিয়া পোর্টকে ভাগ করে আলাউয়ি প্রদেশ বানায় এবং দক্ষিন পশ্চিমে দ্রুজ(বর্তমানে জাবাল আদ-দ্রুজ) এলাকাকে তাদের কলোনীর একটি স্বায়ত্বশাষিত অংশ বানায়। পরিশেষে তারা দুই প্রধান নগরী দামেস্ক ও আলেপ্পোকেও আলাদা প্রদেশ করে দেয় এবং এই দুই প্রতিবেশী শহরকে দুই প্রদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষনা দেয়।


১৯২৪ সালের ফ্রেঞ্চ সিরিয়া প্রদেশগুলোর মানচিত্র

কিন্তু তাদের এই ভাগাভাগি আসলে কোন সত্যিকার প্রশাষনিক সুবিধার মুখ দেখেনি। ফলস্বরুপ ফ্রান্স আবারো এ অঞ্চলে একটি বড় পরিবর্তনের সুচনা করে। এবার তারা ভাগ করার বদলে পুরো অঞ্চলকেই একটি মাত্র রাষ্ট্র(সিরিয়া) হিসেবে একীভুত করে দেয়। লিগ অব নেশন্সের ম্যানডেট অনুযায়ী যেমন রাষ্ট্র হবার কথা ঠিক সেভাবেই তারা সিরিয়াকে পুনর্গঠিত করে। কিন্তু এর পেছনেও তাদের একটা কু-মতলব ছিল। তারা দেশকে টুকরো করার পথ থেকে ফিরে এলেও এবার তারা এ অঞ্চলের সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাদের নতুন নীতি প্রথমেই এ অঞ্চলের সাধারন ভাষা আরবীকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নেয়। আইনগত বিষয় আষয় এ আরবীর স্থানে ফ্রেঞ্চ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করা হয়।

ইসলাম কে ছেঁটে ফেলার জন্য খৃষ্টান ক্যাথলিক মতের প্রচার ও প্রসারের জন্য সচেষ্ট হয়। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের আনুকূল্য প্রদান করা শুরু হয় যাতে মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ নাগরিকদের সহজেই নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হয়। এই সমস্ত পদক্ষেপ ও বিষয় বস্তুর অনুপ্রবেশের ফলে স্থানীয় সিরিয়ার সামাজিক ও নাগরিক জীবনে প্রথমে বিদেশীদের নিয়ে একধরনের আতংকের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া তৈরী করে এবং যা পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয়ান ধাঁচের জাতীয়তাবাদে রুপ নেয়। এই পুরো বিষয়টা একরকম অপরিহার্যই ছিল।

এই সময়কালটা হচ্ছে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ যেখান থেকে আমরা সিরিয়ান জাতীয়তাবাদের ধারনা নিয়ে কথা বলা শুরু করতে পারি। আসলে নিজস্ব রাস্ট্র বা জাতীসত্তার একটা অনুভুতি যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে শুরু হয় এবং ফ্রান্সের অধীনস্ত থাকাকালীন সময়ে জনপ্রিয় ও বাস্তব আকার ধারন করতে থাকে।
ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক প্রশাসন যখন দেখতে পেল যে তাদের নেয়া নতুন নীতি আসলে কোন কাজে আসছেনা এবং বিকল্প রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে সিরিয়ান সমাজে দিনকে দিন জাতীয়তাবাদের ধারনাটাই আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তখন তারা পুনরায় তাদের পুরনো নিপিড়নের নীতিতে ফিরে যায়। বস্তুত সিরিয়াতে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাষনামলের পুরোটাই ছিল প্রাক্তন অটোম্যান সাম্রাজ্যের ঢিলেঢালা শাষন ব্যাবস্থার চেয়ে কঠোর ও সংঘর্ষময়। এই ঔপনিবেশিক শাষন চলাকালীন সময়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য ফ্রান্স একাধিক বার দামেস্ক নগরীতে বোমা হামলা করে। সিরিয়াকে নিজেদের কলোনী হিসেবে ঘোষনার পর থেকে ফ্রান্স মোট চার বার সিরিয়ার শাষন ব্যাবস্থায় পরিবর্তন আনে। ১৯২০, ১৯২৫, ১৯২৬ ও ১৯৪৫ ইংরাজী সালে এই শাষন পরিবর্তনের ঘটনা গুলো ঘটে। শান্তি বজায় রাখার দোহায় দিয়ে বেশিরভাগ সময়েই ফ্রান্স এই অঞ্চলে মার্শাল ল জারি করে রাখে। বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার সংবিধান প্রনয়ন ও রহিত করা হয়। শাষকগোষ্ঠি যখন ই নিজেদের অনিরাপদ ও নিয়ন্ত্রনহীন মনে করতেন তখনই তারা এ সমস্থ পদক্ষেপ নিতেন। প্রতিশ্রুত স্বাধীনতা সিরিয়ানদের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। সমস্ত প্রতিশ্রুতি কালের পর কাল প্রতিশ্রুতি হিসেবেই থেকে যায়।

এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানী উত্তর ফ্রান্সের(এক পর্যায়ে পুরো ফ্রান্সের প্রায় অর্ধেকের বেশি) অনেক এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৪০ সালে জার্মানি ফ্রান্সে তাদের দখলকৃত এলাকায় এবং ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক কলোনিগুলোর প্রশাষনিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ভিসি(vichy) শহর কে কেন্দ্র করে এক পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে। স্বাভাবিক ভাবেই সিরিয়া এই সরকারের নিয়ন্ত্রনে রয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯৪১ সালে বৃটিশরা ফ্রান্স থেকে জার্মান দখলদারদের উৎখাত করতে আক্রমন করে এবং ভিসি প্রশাষন কে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বৃটিশরা ফ্রান্সের বেদখল হয়ে যাওয়া ভুমি জার্মানী দখলদার সৈন্যদের হাত থেকে মুক্ত করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে এবং পেছনে রেখে যায় মুক্ত ফ্রান্স। পরবর্তীতে মুক্ত ফ্রান্স ভিসি শাষন চলমান রাখে। বস্তত সিরিয়ানরা প্রতিশ্রুত স্বাধীনতা পায় ঠিকই , কিন্তু সেটা ঠিক ফ্রান্স থেকে নয়। বৃটিশ আর্মি কতৃক ফ্রান্সকে জার্মান দখলদার থেকে মুক্ত করার ধারাবাহিকতায় সেটা বৃটিশদের পক্ষ থেকেই আসে। অবশেষে ফ্রান্সের শেষ সৈন্যটিও সিরিয়া ত্যাগ করে ১৯৪৬ সালের ১৭ই এপ্রিল। আর এই দিনটিই সিরিয়ার জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে।

শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ফ্রান্স ২৬ বছর ধরে সিরিয়া শাষন করলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল সামন্যই। অন্ধকারময় এবং হতাশাজনক এক অচলাবস্থা তৈরি করা ছাড়া তারা আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। অপর পক্ষে বিদেশীশত্রু মুক্ত মাতৃভুমি প্রতিষ্ঠার লক্ষই সিরিয়ানদের জাতীয়তাবাদ এর বোধ লালন করতে সাহায্য করে এবং আজ পর্যন্ত এটাই সিরিয়ানদের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে

সিরিয়ার স্বাধীনতা

যদি শুধুমাত্র শিক্ষিত সিরিয়ানদের কথাও ধরা হয় তাহলেও দেখা যায়, সিরিয়ান জাতীয়তাবাদ নাগরিক আবেগের নিমিত্তে সন্তুষ্টজনক হলেও সেটা আসলে কোন সাংগঠনিক নীতি হিসেবে গ্রহনযোগ্য উপাদান স্বরুপ প্রমানিত হয় নি। যার ফলে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রনের বিষয়টি সামাজিক প্রেক্ষাপটে উদ্দিপনার সৃষ্টি করলেও নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রনের বিষয়টা সিরিয়ান নাগরিক সমাজ সম্পুর্ন ভাবে উপলব্ধি করতে ব্যার্থ হয়।

ভিনদেশি ফ্রান্স সৈন্যদের সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করার পরের বছরগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থানের স্বৈরাচারী নেতারা সিরিয়ান জাতীয়তাবাদ নিয়ে বাগড়ম্বর পুর্ন বক্তৃতা দিয়ে চললেও সত্যিকার অর্থে তাদের সমর্থক গোষ্ঠি তথা সমগ্র সিরিয়ানদেরকেই একটি সুন্দর, শান্তিপুর্ন, প্রগতিশীল জীবন এনে দিতে ব্যার্থ হয়।
অবেশেষে ১৯৫৮ সালে দেশের একমাত্র শক্তিশালী, গতিময় ও সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেশটিকে প্রতিবেশী দেশ মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের হাতে তুলে দেয়। সিরিয়ান নাগরিক সমাজে গামাল প্রশংসিত ও বিশ্বাসযোগ্য আরব নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। উল্লেখ্য গামাল আব্দেল নাসের মিশরীয় সমাজকে তখন এক নতুন প্রগতির ছোঁয়ায় নিয়ে আসতে সফল হন। তাঁর প্রেসিডেন্সিতে মিশরের সাধারন মানুষ শিক্ষা, আবাসন ও স্বাস্থ্য খাতে এমন পরিসেবার আওতায় চলে আসে যা তাদের জীবনে এর আগে আর কখনই ঘটেনি। সিরিয়ানরা এই ভেবে বিশ্বাস ও আশায় বুক বাঁধে যে, মিশর যে কিনা বরাবরই আরব বিশ্বে সর্দার হিসেবে বিবেচিত ও গামাল আব্দেল নাসের যাঁর হাতে মিশর আধুনিক মিশরে পরিনত হচ্ছে তাদেরকে একটা স্থিতিশীল জীবনের দিশা দেবে। সুতরাং পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের জন্য সিরিয়া ইউনাইটেড আরব রিপাবলিকের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

এদিকে সিরিয়ানরা তাদের একটি উন্নত ও সুসংগঠিত জীবনের আশায় নিজেদেরকে মিশরের হাতে সঁপে দিলেও অপরপক্ষে গামাল আব্দেল নাসের আদতে সিরিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। যদিও গনমাধ্যমের দৃষ্টিতে বিষয়টি এমন ছিল না। সেটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন নাসের সেনাবাহীনিকে রাজনীতি থেকে প্রত্যাহার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গনভোটের আয়োজন সহ এমন কিছু অগ্রহনযোগ্য শর্তাদি উল্লেখ করেন যাতে মিশরের সাথে একীভুত থাকা সিরিয়ান সেনা নেতৃত্ব ভিন্নমত পোষন করেন। ফলস্বরুপ ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং ১৯৬১ সালে সিরিয়ানরা পুনরায় তাদের নিজস্ব সংস্থানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একজন সিরিয় হওয়ার অর্থ কি হতে পারে তারা সেই মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হয়।

যারা মুলত সিরিয় নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচিতি পায় তারা বেশিরভাগই ছিল আরবী বলা সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়। যেহেতু ঐতিহাসিক ভাবে বৈশ্বিক সফলতা আরবী বলা মুসলিম সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্রের হাত ধরেই আসতে থাকে সেহেতু সিরিয় সমাজে আর সমস্ত এশীয় সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মতই ইসলাম ধর্ম গ্রহন ও আরবী ভাষায় কথা বলা তাদের কাছে একটি বিশেষ আকর্ষনীয় বিষয় ছিল। যারা কিনা ইতিমধ্যেই এই সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে উঠতে পারেনি তাদের কাছে বিষয়টি তখনও পর্যন্ত আকর্ষনীয়ই বিবেচিত হয়ে আসছিল। তখনকার সিরিয় সমাজের প্রতি ১০ জনের ৭ কিংবা ৮ জনই ছিল আরব মুসলমান। ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদের প্রভাবে তখন সিরিয় পরিচয়ের সংজ্ঞা হিসেবে আরব মুসলমান হয়ে ওঠায় ছিল সিরিয়দের মুখ্য বিবেচ্য বিষয়।

এখানে ব্যাতিক্রম ছিল প্রতি ১০ জনের বাকি ২ কি ৩ জন যারা বিষয়টিকে একই দৃষ্টিকোন থেকে দেখছিল না। তারা পূর্ববর্তী অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই স্বয়ংসম্পুর্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বসবাস করে আসছিল। তারা বেশিরভাগ সিরিয় নগরী ও শহরগুলোর কোল ঘেঁষে তাদের বসতি গড়ে তুলেছিল।
জাতীয়তাবাদীরা এই বৈচিত্রতাকে তাদের প্রাথমিক দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে এবং পুরো সিরিয় জনগোষ্ঠিকে একটি একক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোতে একত্রিত করন কে তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহন করে।

কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা মতাদর্শগত কারনে গভীরভাবে বিভক্ত ছিল। প্রধান ইসলামিক আন্দোলন এর নেতৃত্বদানকারী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড মনে করত জাতি হিসেবে সিরিয়া পরিচিত হবে শুধুমাত্র আরব সুন্নি (অথবা গোঁড়া) মুসলমানদেরকে নিয়ে। অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যারা পূর্ববর্তী অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমল থেকেই রক্ষিত বা আশ্রিত সম্প্রদায় হিসিবে পরিগন্য হয়ে আসছে তারা ছাড়া অন্য কোন মুসলমান গোত্রের বা সম্প্রদায়ের কোন স্থান সিরিয়াতে হবে না। এই ধারনা ও বিশ্বাস কে নীতি হিসেবে নিয়েই তারা লড়াই করে আসছিল।

আরো রক্ষণশীল, সমৃদ্ধিশালী, এবং পশ্চিমা জাতীয়তাবাদীদের বিশ্বাস ছিল যে, না, কোন ধর্মীয় বিষয় বস্তুর উপর ভিত্তি করে নয়, একটি জাতিসত্তা নির্মিত হতে হবে একটি এলাকার ভিত্তিতে। যেটা একক রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদ(আরবীঃ বাতেনিয়া) হিসেবে পরিচিত। মুলত সিরিয়া রাষ্ট্র নির্মাণে এই একক রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদই মুখ্য ভুমিকা পালন করে। দুঃখজনক ভাবে জাতীয়তাবাদীদের এই অংশও জাতি হিসেবে সিরিয়দের সফলতায় নেতৃত্ব দিতে ব্যার্থ হয়। তাদের ব্যার্থতা অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের পুনঃসঙ্গায়নের পথ খুলে দেয়। একক রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদের পথ থেকে সরে এসে সমগ্র আরব (আরবীঃ কওমিয়া) বা লোক জাতীয়তাবাদের যে প্রাচীন ধারনা সেই কওমি জাতীয়তাবাদ এর ধারনা সামনে আসে। সিরিয়ার বাথ পার্টি এই ধারনা জনসম্মুখে নিয়ে আসে। তাদের মতে সিরিয়াকে একটি আলাদা জাতি রাষ্ট্রা হিসেবে চিন্তা না করে এটিকে সমগ্র আরব দুনিয়ার অংশ হিসেবে এবং ঘরোয়া ভাবে নিজেদের একটি একত্রিত, সুসংগঠিত ও ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তত আংশিকভাবে পশ্চিমা রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করতে জনগনকে উৎসাহী করার প্রয়াস শুরু হয়। বাস্তবে এটি ছিল খুবই কঠিন একটা কাজ। কেননা প্রভাবশালী মুসলমান সম্প্রদায় শুরুতে ফ্রেঞ্চ অপশাষন ও পরবর্তীতে ঘরোয়া দাঙ্গা হাংগামা এবং পুনরায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপের কারনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে সিরিয় ইহুদিদেরকে প্রকৃত ও সম্ভাব্য অবিশ্বস্ত এবং পক্ষত্যাগী হিসিবে অভিহিত করে।

এদিকে সিরিয় রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়াতে ও প্রভাব বিস্তার করতে শক্তিশালী ও আমেরিকান মদদপুষ্ট ইসরায়েল পুরো বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়কালে ভুমিকা রাখতে থাকে। ১৯৪৮ সাল থেকে সিরিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে নিয়মিত যুদ্ধ শুরু হয়। এটা এমন একটা সময়ে যখন কিনা এই দুই রাষ্ট্র তাদের পুর্ন স্বাধীনতাই অর্জন করে উঠতে পারেনি। তারা একাধিকবার যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটায় ১৯৬৭ সালে ও ১৯৭৩ সালে। সীমান্ত অঞ্চলে সংঘর্ষ, সাময়িক যুদ্ধ বিরতি, অঘোষিত হানাহানি দুই দেশের মধ্যে লেগেই থাকে। ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইল সিরিয়ার প্রায় ১২০০ স্কয়ার কিঃমিঃ (৪৬০ স্কয়ার মাইল) যা গোলান হাইটস নামে পরিচিত নিজেদের দখলে নিয়ে রাখে। যেটা পরবর্তিতে ১৯৮১ সালে নিজেদের রাষ্ট্রে সংযুক্তি হিসেবে ঘোষনা দেয়। যদিও তাদের এই ঘোষনার বৈধতা দিতে আমেরিকা ও অন্যান্য রাষ্ট্র অস্বীকার করে তবুও ইসরায়েল তাদের ২০ হাজার নাগরিক কে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করায়।
এদিকে গোপন শান্তি আলোচনা অব্যাহত থাকে যদিও তা কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। ১৯৭৪ সালে একটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করা হলেও দুই দেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ এখনো পর্যন্ত চলমান।

সিরিয়াকে বুঝতে, প্রাক গৃহযুদ্ধ থেকে যুদ্ধোত্তর আসাদ শাষন ...২
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৪৩
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজনীতির পন্ডিত, ব্লগার তানভীর জুমারের পোষ্টটি পড়েন, জল্লাদ আসিফ মাহমুদ কি কি জানে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৯



সামুর রাজনীতির ডোডো পন্ডিত, ব্লগার তানভীর ১ খানা পোষ্ট প্রসব করেছেন; পোষ্টে বলছেন, ইউনুস ও পাকিসতানীদের জল্লাদ আসিফ মাহমুদ ধরণা করছে, "সেনাবাহিনী ও ব্যুরোক্রেটরা বিএনপি'কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নীল নকশার অন্ধকার রাত

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:১৬


কায়রোর রাস্তায় তখন শীতের হিম হাওয়া বইছিল। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুইটা বড় সংবাদপত্র অফিস: আল-আহরাম এবং আল-মাসরি আল-ইয়াউম—হঠাৎ করেই আগুনে জ্বলে উঠলো। কিন্তু এই আগুন কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদি ভাই, ইনসাফ এবং একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের গল্প

লিখেছেন গ্রু, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৮



ইদানিং একটা কথা খুব মনে পড়ে। হাদি ভাই।

মানুষটা নেই, কিন্তু তার কথাগুলো? ওগুলো যেন আগের চেয়েও বেশি করে কানে বাজে। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি? ক্ষমতা? গদি? নাকি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×