খেলা যাঁরা পরিচালনা করেন, ফুটবলে রেফারি আর ক্রিকেটে আম্পায়ার, মানুষ বলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মাঝেমধ্যে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়েই যায়। খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতা দেখিয়ে সেসব ছোটখাটো ভুল মেনে নিয়েই খেলে যেতে হয় এবং প্রায় সবাই খেলেনও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সব সময় এসব ভুল আর ছোট ভুল থাকে না, কখনো কখনো তা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে বেশ বড় খেসারত দিতে হয় কোনো কোনো খেলোয়াড় বা দলকে। আর সব খেলার মতো ক্রিকেটের বেলায়ও এটা সত্যি। তো এ অবস্থায় কী করা যায়? ভেবে-চিন্তে ঠিক করা হলো আম্পায়াররা যেহেতু ভুল করছেন তাঁদেরকে প্রযুক্তি দিয়ে কিছুটা সাহায্য করা যাক। ভুলের হার যদি তাতে কিছুটা কমে! এবং সেই ভাবনা থেকেই নানা প্রযুক্তির পর এলো ইউডিআরএস। মাঠের আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত যদি ঠিক মনে না হয় ব্যাটসম্যান বা ফিল্ডিং দল সেটা পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন। আম্পায়ার তখন টিভি আম্পায়ারের সাহায্য নিয়ে দেখবেন সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না সঠিক। ভুল মনে হলে তিনি সেটা বদলাতে পারেন আর সঠিক মনে হলে তো আগের সিদ্ধান্তে স্থির থাকবেনই। মাঠের আম্পায়ারকে সাহায্য করার জন্য টিভি আম্পায়ারকে দেওয়া হয়েছে আল্ট্রা স্লো মোশন, স্টাম্প মাইক্রোফোন, বল ট্রেকিং, হট স্পট ক্যামেরা, হক-আইয়ের মতো সর্বাধুনিক ক্রিকেট প্রযুক্তিগুলো। কিন্তু এত কিছুও কি কমাতে পারছে ভুলের হার বা বন্ধ করতে পারছে বিতর্ক?
বোধহয় না। ২০০৯ সালে ডুনেডিনে নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তান প্রথম টেস্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করার পর থেকেই ইউডিআরএস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। প্রথমে ক্রিকেটাররা স্বাগত জানিয়েছেন ঠিকই। গ্রায়েম সোয়ানের মতো কেউ কেউ বলেছেন, এর ফলে বোলারদের উইকেট পাওয়ার হার বাড়বে, কারণ, আম্পায়ারদের ভুলে অনেক সময়ই উইকেট বঞ্চিত হন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই সব আম্পায়ার স্বাগত জানাননি। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার তো বলেই দিয়েছিলেন, এটা আম্পায়ারদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেবে। আবার এর উল্টো মতও আছে। আইসিসির এলিট প্যানেল আম্পায়ার আলিম দারের যেমন বিশ্বাস এর ফলে আম্পায়াররা নিজেদের ভুল-ত্র“টি সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। পক্ষে-বিপক্ষে এ বিতর্কে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রশ্ন উঠে এসেছে এবং সেটা হলো আসলেই কতটুকু নির্ভুল করা যাচ্ছে সিদ্ধান্তগুলো এবং পদ্ধতিটা আসলেই ঠিক কি না।
বিশ্বকাপে হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ড-ভারত টাই ম্যাচ থেকেই একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যুবরাজ সিংয়ের বলে পরিষ্কার এলবিডাব্লিউ হয়েছেন ভেবে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা শুরু করেছেন ইয়ান বেল। কিন্তু আম্পায়ার বিলি বাওডেন আউটও দিলেন না। সে অবস্থায় রিভিউ চাইলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। রিপ্লে দেখে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন বাওডেন। কারণ কী? এ রকম এলবিডাব্লিউর ক্ষেত্রে এখনকার নিয়ম হচ্ছে ব্যাটসম্যান যদি স্টাম্প থেকে ২.৫ মিটার বা এর বেশি বাইরে থাকেন তাহলে বল একেবারে মিডল স্টাম্পে লাগার মতো হলেও আউট হবে না। রিভিউর পর তাই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন বাওডেন। আর ১০ জন আম্পায়ারের মতো তিনিও তো নিয়মের দাস। এ নিয়মের সহায়তা পেলে ইয়ান বেল ব্যাট করে যাবেন সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু ধোনিসহ অনেকেই ইউডিআরএস নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। নিয়মটা কতটা সঠিক, ২.৫ মিটারকে কেন প্রমাণ দূরত্ব হিসেবে বেছে নেওয়া হলোÑএসবের কোনো পরিষ্কার জবাব অবশ্য এখনো দিতে পারেনি আইসিসি। কেভিন পিটারসেনের মতো যেসব ব্যাটসম্যানের অভ্যাসই হচ্ছে ক্রিজ থেকে একটু বাইরে দাঁড়ানো কিংবা পেসারদের বোলিংয়ের সময় যেসব ব্যাটসম্যান একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ান তারা তো সব সময় এই সুবিধাটা পেয়ে যাবেন। আর এ সুবিধা নিলে তাঁদের এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলাও অসম্ভব হয়ে যাবে। বোলারদের প্রতি এটা কি এক ধরনের অবিচার নয়?
জবাবটা আইসিসির কাছে। এজন্যই হয়তো ইউডিআরএসকে এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্থায়ী করে নেয়নি তারা, চালাচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে। সে পরীক্ষায় গিনিপিগ হয়ে আপাতত কিছুটা খেসারত দিতে হচ্ছে ক্রিকেটারদের। ভালো কিছু পেতে হলে এটুকু ত্যাগ স্বীকার তো করতে হবেই!
এক নজরে
*আম্পায়ার্স ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম (ইউডিআরএস) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যবহার করা হয় ২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর ডুনেডিনে শুরু হওয়া নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তান প্রথম টেস্টে।
* ওয়ানডে ক্রিকেটে (ইউডিআরএস) ব্যবহার শুরু করা হয় এ বছরের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সিরিজে।
* এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত প্রথম ম্যাচে তামিম ইকবালকে করা শ্রীশান্তের প্রথম ওভারের চতুর্থ বলটিতে এলবিডাব্লিউর আবেদন করেছিলেন শ্রীশান্ত। আম্পায়ার আউট না দেওয়ায় রিভিউ চেয়েছিলেন ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। রিভিউর পরও সিদ্ধান্ত বদলায়নি। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেটাই প্রথম ইউডিআরএসের ব্যবহার।
*রিভিউ চাইতে হয় আম্পায়ারের দিকে দুই হাতে ইংরেজি টি অক্ষরের মতো চিহ্ন দেখিয়ে। ব্যাটিং বা ফিল্ডিংয়ের সময় একটা দল দুবার করে রিভিউ চাইতে পারবে। তবে সিদ্ধান্ত নিজেদের পক্ষে গেলে প্রতিটি সফল রিভিউর আবেদনের জন্য আরো একটি করে রিভিউয়ের সুযোগ পাবে তারা। কিন্তু দুটি ব্যর্থ রিভিউর পর কোনো দল আর রিভিউ চাইতে পারবে না।
*সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত মাঠের আম্পায়ারই নেন, তবে আল্ট্রা স্লো মোশন, স্টাম্প মাইক্রোফোন, বল ট্রেকিং, হট স্পট ক্যামেরা, হক-আই ব্যবহার করে তাঁকে সাহায্য করেন টিভি আম্পায়ার।
সূত্রঃ কালের কন্ঠ
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ১১:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




