somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ নাবিলা কাহিনী ১ - পরিণয়!

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নাহিদ হাত ঘড়ির দিকে তাকাল, এগারোটা বেজে দশ মিনিট। মেয়েটা তো এখানে আসতে কোন দিন এত দেরী করে না? ও আজকে কি ভার্সিটিতে আসেনি? হায় হায়, বেছে বেছে আজকেই আসেনি? এমনই কপাল খারাপ হয় কারো? ও মনে মনে ঠিক করে এসেছিল মেয়েটার সাথে আজকে কথা বলবেই! আরও কিছুক্ষন দেখা যাক, ড্যাসের ক্যাফেটেরিয়ার সামনের নীচু বাউন্ডারি ওয়ালের উপর অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে রইল নাহিদ…….

এক
সিঙ্গাড়াটা কামড় দিয়ে নাবিলা সাথে সাথেই বুঝলো বিরাট ভূল হয়ে গেছে, তাড়াহুড়ো করা ঠিক হয়নি। যথেষ্ট গরম এখনও, মুখের ভিতর গরম আলু গুলির উত্তাপ হারে হারে টের পাচ্ছে ও। এত ছেলেমেয়েদের সামনে মুখ থেকে বের করে ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না! কি বিপদ?
-আপনি চাইলে আমি ফু দিয়ে সিঙ্গাড়াটা ঠান্ডা করে দিতে পারি?
নাবিলা হতভম্ব হয়ে সামনে দাড়ান ছেলেটার দিকে তাকাল। এই চিজ আবার কোথা থেকে আসল? চরম বিরক্তি নিয়ে নাবিলা মুখের ভিতরের গরম সিঙ্গাড়ার অংশটুকু গিলে ফেলে সামনের ছেলেটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখল।
-আপনাকে এই জনহিতকর কাজটা কে করতে বলেছে?
-কেউ না, আপনার খেতে কষ্ট হচ্ছে, সেজন্য বললাম। এভাবে মুখে খাবার নিয়ে দাড়িয়ে থাকলে নেক্সট ক্লাস নিশ্চিত মিস করবেন, এমনিতেও সিঙ্গাড়া খেতে আসতে আজকে লেট করেছেন!

কথা অতিশয় সত্য, ক্লাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই মিথিলার সাথে দেখা। দাড়িয়ে কথা বলতে যেয়ে আসলেই দেরী হয়ে গেছে কিন্তু এই ছেলে আমার ডেইলি রুটিন জানলো কিভাবে? এটাতো অতিব চিন্তার বিষয়! এই ছেলের তো কিছু খোঁজ খবর নেয়া দরকার, ওকে ফলো করছে নাকি?
-আপনি কি আমাকে চেনেন?
-জী, চিনি, বেশ ভালো ভাবেই চিনি!
-তাই, আচ্ছা, বলুন দেখি আমার পরিচয়?
-আপনি নাবিলা, পুরো নাম নাবিলা হক। তৃতীয় বর্ষ মনোবিজ্ঞানে পড়ছেন। বাসা শ্যামলি আদাবরে। বাবা আরেফিন হক, সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ে ডেপুটি সেক্রেটারি, মা রাশেদা হক, গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে আপনিই বড়, ছোট মৃদুলা হক, হলিক্রসে পড়ে, ফার্স্ট ইয়ার সাইন্সে। আরও কিছু শুনতে চান?

কি তাজ্জব ব্যাপার? এই ছেলে আমার বায়োডাটা পেল কোথা থেকে? যা বলেছে এতেই তো ওর মাথা ঘুরে পরে যাবার মতো অবস্থা! আবার বলছে আরও কিছু শুনতে চান নাকি? নাবিলা খুব দ্রুত চিন্তা করা শুরু করলো, ঘটনা কি? কিভাবে সম্ভব এটা? এই ছেলেকে কি ওর বিয়ের জন্য সিভি দেয়া হয়েছে? মনে হচ্ছে না! এরকম কিছু হলে অবশ্যই আগে ওকে বাসায় জানাতো! এই প্রবলেম সলভ না করে নেক্সট ক্লাসে যেয়ে কোন লাভ হবে না, কিছুই মাথায় ঢুকবে না।

নাহিদ নিজের উপর খুব খুশি হলো। পারফেক্ট স্টার্টিং, ঠিক এমনটাই ও চেয়েছিল। পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে নাবিলা এখন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ঘোর না কাটা পর্যন্ত নাবিলা ওকে নিয়ে ভাবতে থাকবে। এই মেয়ে নিজেকে অতিশয় বুদ্ধিমতি মনে করে। এখন দেখা যাক এর বুদ্ধির ঢেঁকি আসলে কত বড়!

-আমার বায়োডাটা আপনাকে কে দিয়েছে?
-আমি বানাচ্ছি তবে এখনো পুরাপুরি শেষ হয়নি।
-কি? আপনি আমার বায়োডাটা বানাচ্ছেন? কেন?
-আমার ইচ্ছা, তাই। ইচ্ছে করলে আপনিও আমাকে সাহায্য করতে পারেন, তাহলে কাজটা আমার জন্য আরও সহজ হয়ে যাবে।
-আমার বায়োডাটা দিয়ে আপনি কি করবেন?
-আপনি না মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী? বুঝতে পারছেন না? পড়াশুনা করেন নাকি ফাঁকিবাজি করে বেড়ান?
-আপনি আমার বায়োডাটা বানাচ্ছেন, আমি স্টুডেন্ট কেমন সেটা জানেন না?
- জী, জানি। সেজন্যই তো বললাম। মনোবিজ্ঞান ক্লাসের ফার্স্ট স্টুডেন্টের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে তো আসলেই ভয়াবহ ব্যাপার?

নাবিলা কিছুটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল। এই ছেলে ইচ্ছে করেই ওর সাথে মাইন্ড গেম খেলছে। ওকে ঘাটাঘাটি করার সাহস পেল কোথা থেকে? সবাই তো ওর সাথে কথা বলার আগে দশবার ভেবে চিন্তে কথা বলে, আর এই ছেলে কিনা গায়ে পড়ে লাগছে। ব্যাপারটা ইন্টেনশনাল। এই ছেলে গভীর পানির মাছ। এই সাবজেক্টের মেয়েদের দেখলে ছেলেরা এমনিতেই দৌড়ের উপর থাকে! আচ্ছা, এই ছেলে কত বড় চীজ এটা ওর বের করতেই হবে!
-দেখিতো আমার বায়োডাটা, কতটুকু করতে পেরেছেন?
-আপনাকে দিতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু এটা যে অবস্থায় নিবেন ঠিক সেই অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তা আগে দিতে হবে।
-কেন, এমন কিছু কি লিখেছেন যে পড়ার পর ফিরত নাও দিতে পারি? লিখছেন তো আমার বায়োডাটা? এর মধ্যে কি আবার অন্য কিছু ঢুকিয়েছেন নাকি?

নাহিদ খুব সুন্দর একটা হাসি উপহার দিল নাবিলাকে, রহস্যময় হাসি। নাবিলা সাথে সাথেই বুঝল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। এই জিনিস ওকে যেভাবেই হোক দেখতেই হবে। এই ছেলেকে খেপালে এই জিনিস দেখা যাবে না।
-উলটা পাল্টা কোন কিছু না পেলে অবশ্যই ফেরত পাবেন।

নাহিদ কয়েক সেকেন্ড নাবিলার দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে একটা ছোট লেদার কাভারের ডায়েরি বের করে নাবিলার হাতে দিল। নাবিলা ডায়েরিটা নিয়ে সাথে সাথেই ওর ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল। প্রায় সব মেয়েদের চরিত্রের একটা বিশেষ দিক হল, যেই মুর্হূতে তারা অপর পক্ষের গভীর আগ্রহ টের পায়, সেই মুর্হূতে তারা হুট করে নিভে যায়। এরা মনে প্রানে বিশ্বাস করে ছেলেদের বেশি পাত্তা দিতে হয় না, দিলেই মাথায় উঠে যাবে।
-এখন দেখবেন না?
-আমার যখন সময় হবে তখন দেখব!
-কবে আর কিভাবে ফিরত পাব?
-আগে পড়ে দেখি এর ভিতরে কি আছে?

নাবিলা বেশ অবাক হলো যখন দেখল ছেলেটা আর কোন কথা না বলে চলে গেল। মাইন্ড করল নাকি? ধ্যাত, করলে ওর কি যায় আসে? সিঙ্গাড়াটা ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেছে, নাবিলা মনোযোগ দিয়ে সেটা খেতে শুরু করল। পরপর আরও দুইটা ক্লাস আছে, খালি পেটে ক্লাসে পুরোপুরি মনোযোগ দেয়া যাবে না……

দুই
সেদিন সকাল বেলা কলাভবনের গেইট দিয়ে ঢুকেই অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা ওর ডিপার্টমেন্টের করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কিছু দূরে তাকিয়ে দেখি নাবিলা কয়েকটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। একটা লাল রঙের শাড়ি পড়েছে আজকে। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? একবার দেখলে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে! কি সুন্দর করে যে হাত পা নেড়ে নেড়ে কথা বলে! ইচ্ছে করে মেয়েটার খুব কাছে আসতে, ওকে না বলা ভালোবাসার কথা গুলি বলতে, ইচ্ছে করে ভালোবাসতে, ওর ভালোবাসা পেতে….। ওর ব্যস্ত ঠোঁট, বড় বড় দুইটা চোখ আর ওর মুখের খুব সুন্দর হাসিটা দেখে সাথে সাথেই আমার মনটা উদাস হয়ে গেল।

মিষ্টি মিষ্টি হাসি দিয়ে তুমি পাগল করে দিলে
তোমায় নিয়ে হারিয়ে যাব ঐ আকাশের নীলে,
তোমার জন্য আমার বুকে অনেক অনেক আশা
সারাজীবন ধরে শুধুই চাই তোমার ভালোবাসা।
মনটা আমার দিলাম তোমায় যতন করে রেখ
বুকের মাঝে ভালোবেসে আমার ছবি এঁকো,
অনাগত স্বপ্নগুলি আর সাঁজিয়ে দিলাম আশা
ফিরিয়ে কি দেবে তুমি আমার ভালোবাসা?


সেইদিন রাত এগারোটার সময় এই অংশটুকু পড়ে রীতিমত ভিমরি খেল নাবিলা। হতভম্ব হয়ে কবিতাটা দ্বিতীয় বার পড়ে আবার একটা বিষম খেল ও! এত দেখি রীতিমতো এক প্রেমিক কবি এসে হাজির, সর্বনাশ! বেডে শুয়ে ঘুমানোর আগে কেবল ছেলেটার ডায়েরিটা খুলেছে ও। ডায়রিটার প্রথম অংশে সাদামাটা ভাবে ওর বায়োডাটা লেখা। ছন্নছাড়া ভাবে বিভিন্ন তথ্য বিভিন্ন জায়গায় লেখা, মনে হচ্ছে ভালই কষ্ট আর সময় লেগেছে জোগাড় করতে। কিন্তু এত মেয়ে থাকতে নাবিলা কেন? এটাই আগে বের করা দরকার! ডায়রির পিছনে আরও অনেক কিছু লেখা। সেখান থেকে র‍্যানডম একটা পেজ বের করে নাবিলা কেবল পড়া শুরু করেছিল। হাফ পেজ পড়েই ওর এই অবস্থা! আল্লাহই জানেন, না জানি ভিতরে আর কি কি আছে! এখন তো মনে হচ্ছে ওকে এই লেখাগুলি পড়ানোর জন্যই সকাল বেলা এই অতিশয় বুদ্ধিমান ছেলেটা সিঙ্গাড়ার ফু কাহিনী তৈরি করছে। ভালোই বেকুব বানিয়েছে ওকে, রীতিমত শকিং এক্সপেরিয়েন্স! ডায়রির দ্বিতীয় পেজে ছেলেটার নাম লিখা, নাহিদুল ইসলাম, ডাক নাম নাহিদ। ডায়রিতে লেখা প্রেমের কিছু কিছু ডায়ালগগুলি আসলেই কঠিন। নাহ, সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, কোন ভাবেই তাড়াহুড়া করা যাবে না……..

তিন
নাবিলার খালার বাসার ছাদেই প্রথম নাবিলাকে দেখে নাহিদ। পাশের বিল্ডিংটাই ওদের। বিকেল বেলা হাতে কোন কাজ নেই দেখে ছাদে এসে বসতেই ও শুনতে পেল অসম্ভব সুন্দর করে কে যেন ওর সবচেয়ে পছন্দের কবিতাটা (মহাদেব সাহার মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, বইঃ ধূলোমাটির মানুষ) আবৃত্তি করছে। কান খাড়া শুনল নাহিদ। চমৎকার আবৃত্তি, অসাধারণ কন্ঠস্বর। নিস্তব্ধ পরন্ত বিকেল বেলায় মনোমুগ্ধকর এই আবৃত্তি নাহিদের মনটাকে সাথে সাথেই ব্যাকুল করে দিল। ছাদের একদম কিনারায় এসে দেখতে পেল ওর দুই প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীকে এক অপরূপা কবিতা আবৃত্তি করে শুনাচ্ছে। সেই দিন টানা চারটা কবিতার আবৃত্তি শুনল নাহিদ। নিজে লেখালিখি করলেও আবৃত্তি করার কন্ঠ নেই ওর। শুধু মনে হচ্ছিল এই অপরূপাকে দিয়ে যদি ওর সেরা কিছু কবিতা একবার আবৃত্তি করানো যেত, ইস! শেষ বিকেলের আলো যেন মেয়েটাকে অন্যরকম একটা অপার্থিব সৌন্দর্য্য দিয়ে ঘিরে রেখেছিল। এই অপার্থিব সৌন্দর্য্য এড়িয়ে যাবার ক্ষমতা নাহিদের ছিল না। কাউকে ভালোবাসা বাসির জন্য অনন্তকালের প্রয়োজন নেই, এক মুহূর্তই যথেষ্ট! কোন কিছু বুঝার আগেই নাহিদ নাম না জানা এই অপরূপা আবৃত্তিকারের প্রেমে পড়ে গেল!

অল্পকিছুদিন ধরেই ওর বাসায় বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিল। বুয়েটে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর নাহিদ এখন বাইরে চলে যাচ্ছে হায়ার স্টাডিজের জন্য। নাবিলাকে দেখে সাথে সাথেই ওর মাথা নষ্ট অবস্থা। সেইদিনই রাতের বেলা নাহিদ সোজা নাবিলার খালার কাছে যেয়ে হাজির। উনার দুই ছেলেমেয়েকেই ও পড়াত একসময়। উনি খুব ভাল করে চেনেন নাহিদকে। পাত্র হিসেবে ও খুবই যোগ্য ছেলে কিন্তু চরম একটা দুঃসংবাদ শুনল নাহিদ। লেখাপড়া শেষ করার আগে কোন ভাবেই বিয়ে করবে না নাবিলা। ছাত্রী হিসেবে খুবই ভালো রেজাল্ট, বাসায় এজন্য এটা মেনে নিয়েছে। বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে কনর্ফাম রিজেক্ট হবে। একমাত্র অপশন হলো এই মেয়েকে প্রথমে রাজি করাতে হবে। মেয়ের সাবজেক্ট আর দৃঢ়চেতা স্বভাবের কথা শুনে একটু ভয় পেল নাহিদ। কিন্তু, প্রেমের জন্য মানুষ কি না পারে? ওর হাতে আছে মাত্র দেড় মাস। এর মধ্যেই নাবিলার মন জয় করে ওকে বিয়ে করে ফেলতে হবে। এই মেয়েকে দেশে রেখে গেলে কোনদিনও ফিরে এসে পাওয়া যাবে না। ভার্সিটির পিএল ফর এক্সাম ফাইটের মতো প্রিপারেশন নিয়ে মাঠে নামল নাহিদ। জীবনে কত ভয়ংকর সব কঠিন কাজ করেছে ও, আর ভালোবাসা দিয়ে একটা মেয়ের মন জয় করতে পারবে না? ও এই চ্যালেঞ্জ সাদরে গ্রহণ করল। নাবিলার খালাকে এই প্রস্তাব দিতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন সাহায্যের জন্য। ছেলেটাকে উনি এমনতেই পছন্দ করেন। নিজের মেয়ে বড় থাকলে তো অনেক আগেই এর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতেন। প্রায় পনের বছর ধরে এই ছেলেকে চেনেন উনি। নাবিলাকে ওর পছন্দ হয়েছে শুনে উনি খুব খুশি হয়ে গেলেন। আর নাহিদও প্রেমের পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করল…………

তোমাকে নিয়ে লিখতে চাই একটা অনবদ্য প্রেমের কবিতা
যেই কবিতার প্রতিটি বর্ণে-ছন্দে-মাত্রায়,
উচ্চারিত হবে আমার গুপ্ত প্রেমের অব্যক্ত কথামালা।
ভালোবাসার সেই অতলান্তিক পংক্তি গুলিতে
তোমাকে নিয়ে পাড়ি দেব আমি যোজন যোজন দূরত্ব,
কিংবা হাতে হাত আর চোখে চোখ রেখে
সাজাব অনুরাগে শিহরিত কিছু চতুর্দশপদী কবিতার লাইন।


চার
প্রায় পাঁচ দিন ধরে নাবিলা ওকে নিয়ে লেখা ফিদা কাহিনী খুব মনোযোগ দিয়ে বারবার পড়ল। লেখাগুলি খুব আবেগ নিয়ে লিখেছে, কাঁচা প্রেমে পড়লে যা হয় আরকি? তবে লেখার মাঝে মাঝে কবিতাগুলি দুর্দান্ত। প্রায় প্রতিটা কবিতাই ওকে মুগ্ধ করেছে। এই নশ্বর পৃথিবীতে ওকে নিয়ে যে কেউ ভালোবেসে কবিতা লিখবে, তাও আবার এত দারুন সব কবিতা, এটা নাবিলা কখনো কল্পনাও করেনি। নাবিলা যে কবিতা পছন্দ করে, সেটা মনে হয় ছেলেটা জানে। ওর মাথা নষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ চেস্টা করেছে, আপাতত ওর কাছে মনে হচ্ছে কিছুটা সফলও হয়েছে। ওর নব্য প্রেমিক কবি কে নিয়ে কি করা যায় ভাবছে ও? ছেলেটা দেখতেও একেবারে মন্দ নয়, ডায়রির একদম শেষ পাতায় আবার অনুরোধ করেছে নাবিলার খালার কাছে রাখা একটা চিঠি পড়ার জন্য। নির্ঘাত আরও একটা গদগদ প্রেমের চিঠি হবে, ঐটা পড়ার লোভ ও কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না! খালার কাছে ওর এমনিতেই যেতে হবে এই ছেলের ভালোমত খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। নাহ, কালকেই ভার্সিটি থেকে সরাসরি ওর খালার বাসায় যেতে হবে…..

খালার বাসায় নাহিদের আদ্যপান্ত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল নাবিলা। ছেলের আর ফ্যামিলির সব কিছু শুনে নাবিলা খুব ভালো করেই বুঝল, এই প্রস্তাব ওর খালা নাবিলার বাসায় দিলে ওর বাসায় সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাবে। ছেলে বিয়ের পাত্র হিসেবে খুবই ভালো কিন্তু ও তো এখন বিয়ে করবে না। আবার এই প্রেমিক কবিকে তো মুখের উপর সরাসরি না বলতেও ইচ্ছে করছে না। কি করা যায়? নাহিদের চিঠিটা আগে পড়ে দেখি ভাবল নাবিলা, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে…………

প্রিয় নাবিলা,
আপনি যখন এই চিঠিটা পড়ছেন ততক্ষনে নিশ্চয়ই আমার হাতে লেখা ডায়েরিটাও পড়ে ফেলেছেন! সুতরাং আপনি ইতিমধ্যেই আমার মনের সব কথা জেনে গেছেন। আমি এমনিতেই খুব লাজুক স্বভাবের ছেলে। এত গুলি কথা আপনার সামনে যেয়ে হয়ত কোনদিন বলতেও পারতাম না। কোনদিন কোন মেয়েকে প্রোপজ করে তাকে আবার এই স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজিও করাতে হবে এটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি প্রথমেই আপনার কাছে হার মেনে নিচ্ছি। আপনাকে কনভিন্স করানো আমার পক্ষে সম্ভব না। এই প্রায় অসম্ভব চেস্টা আমি করবোও না।

আপনার সাথে সাত বার দেখা হবার প্রায় পুরো কাহিনীই আমি লিখে ফেলেছি, সম্ভবত শেষবার দেখাটা লিখতে পারিনি কারন ডায়েরিটা ইতিমধ্যেই আমি আপনার কাছে দিয়ে দিয়েছি। এই ডায়রিটা লেখার সময় আমার মনে যা যা এসেছে সেটাই লিখে গেছি। এর প্রতিটা বর্ণ, প্রতিটা বাক্য আমার মনের অব্যক্ত ভাললাগার অনুভূতিগুলিকে আপনার কাছে তুলে ধরেছে। এর চেয়ে ভালো কোন পন্থা আমার মাথায় আসেনি।

নাবিলা, আমি আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি। আপনাকে ভালোবেসে বিয়ে করে আমার স্ত্রী হিসেবে এই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ যতটুকু সম্মান দেয়া যায় তার সবটুকু দেবার প্রতিশ্রুতি আমি দিলাম। এই চিঠিটা সেটার প্রমান হয়ে থাকবে আপনার কাছে। আমার ভালোবাসা আপনার লেখাপড়া চালিয়ে নেবার পথে কখনোই বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। আমি হিসেব করে দেখেছি, আমার মার্স্টাস শেষ হবার পরপরই আপনার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হবে। আমি ইউনিভার্সিটি অফ কালিফোর্নিয়া – লস আঞ্জেলস এ যাচ্ছি পড়াশুনা করার জন্য। আপনি নিশ্চয়ই জানেন এটা এই মুহূর্তে মনোবিজ্ঞানের উপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য খোদ ইউএসএ তেই র‍্যাংকিং এ ৩য়। আপনার রেজাল্ট খুবই ভালো। আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি ঠিক এইখানেই মার্স্টাসে ভর্তি করে দেব। নিজের প্রিয়তমার জন্য এতটুকুও কি আমি করতে পারব না, বলুন? এতে তো আমারই লাভ, আপনি আমার কাছে থাকবেন। এর চেয়ে বেশি আর কি চাইবার আছে আমার এই ছোট্ট জীবনে…….

নাবিলা, সেদিন আপনাকে নীল শাড়ি পরে আপনার খালার বাসার ছাদে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনলাম। কি যে সুন্দর লাগছিল আপনাকে! আমার জানা কোন ভাষা বা শব্দই সেটা প্রকাশের উপযুক্ত নয়! ইচ্ছে করছিল ছুটে আপনার কাছে চলে যাই। কতটা কষ্ট হয়েছে নিজেকে ধরে রাখতে সেটা শুধু আমি আর আমার উপর আল্লাহই জানেন। আমার বাসার ছাদে বসে ঠিক সেই মুহুর্তেই আপনাকে নিয়ে এটা লিখেছি, এত ভালো আবৃত্তিকারকে এটা কবিতা বলার সাহস আমার নেই।

আমি একবার তোমার কাছে আসতে চাই,
তোমার চোখের কাজল কালো দিঘীতে
.....আমি আজীবন ডুব সাতার কাটতে চাই!
আমি একবার তোমার চুলের সুঘ্রান নিতে চাই,
তোমার চুলের মাতাল করা সুবাসে
...........একবার পাগল হয়ে যেতে চাই!
আমি একবার তোমার অধর স্পর্শ করতে চাই,
তোমার উষ্ণ ঠোঁটের সিঞ্জনে
.......আমি একেবারে ফতুর হয়ে যেতে চাই!
আমি একবার তোমাকে কাছে পেতে চাই,
তোমার প্রেমের উষ্ণ শিহরনে আমি, প্রতিটা মুহুর্তে
.......নতুন করে আবার বেঁচে থাকতে চাই!
আমি তোমাকে একবার ভালোবাসতে চাই,
তোমার প্রেমের অতৃপ্ত সরোবরে, ছোট্ট আমার জীবনটা
……....তোমাকে নিয়েই কাটিয়ে দিতে চাই!

আমি আরেক বার আপনার সাথে দেখা করতে চাই, যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। সময় খুবই স্বার্থপর, খুব দ্রুতই হয়ত আমাকে আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে………


পাঁচ
লেখাপড়া শেষ করে রাতে নাবিলা বিছানায় ঘুমাতে যাচ্ছে, কালকে একটা পরীক্ষা আছে। মশারি গুঁজছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে ওঠল, এত রাতে কে ফোন করল? অপরিচিত নাম্বার দেখে বিরক্ত লাগলো নাবিলার, কৃত্রিম রাগ গলায় এনে জিজ্ঞেস করলো-
-কে?
নরম গলায় নাহিদ হাসতে হাসতে বললো-
-আপনার বিরহে বিক্ষুব্ধ প্রেমিক। আমার ভয়ে কি ভার্সিটিতে সিঙ্গাড়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন নাকি?

কথা অতিশয় সত্য, ইচ্ছে করেই গত কয়েকদিন ও ডাসের ধারে কাছেও যায়নি। এই ছেলের বিরহ আর প্রেমের গভীরতা কতটুকু সেটা ওর জানা দরকার ছিল আর তাছাড়া নাহিদের লেখাগুলি ওকে ভালোই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তার মুহুর্তে ও নাহিদের সামনে কোনভাবেই পড়তে চাচ্ছে না।

-আজ নিয়ে সাত দিন হলো আপনার গলাও শুনি না আর চেহারাও দেখি না। খুব অস্থির অস্থির লাগছিল, ভাবলাম একটু কথা বলি। আপনার কন্ঠ শুনার পর নিশ্চয়ই এখন আমার সুন্দর একটা ঘুম হবে, মিষ্টি একটা স্বপ্নও দেখবো আপনাকে নিয়ে।

নাবিলা চুপ হয়ে গেল কথা গুলি শুনে। ইচ্ছে করছিল ওকে নিয়ে শেষ কবিতাটায় উলটা পালটা কিছু লাইন লেখার জন্য কঠিন একটা ধমক দিতে, এই সব নব্য প্রেমিকদের সব সময় কঠিন ঝাড়ির উপর রাখতে হয়। কিন্তু নাহিদ এতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলল যে, এরপর আর কিছুই বলতে ইচ্ছা করল না ওর।
-আমার ডায়েরিটার সব কিছু কি পড়া শেষ হয়েছে?
-হুম, তবে এর মধ্যে অনেক উলটা পালটা কথা আছে।
-উলটা পালটা কথা গুলির জন্যই তো আপনাকে পড়তে দিয়েছি। যেটা যেটা বুঝতে পারেন নি, বলুন আমাকে? সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
-কালকে আমার পরীক্ষা। আজকে রাতে নতুন কিছু আর বুঝতে চাচ্ছি না।
-তাই, আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার খালার কাছে আপনার জন্য একটা চিঠি রেখেছিলাম, পেয়েছেন সেটা?
-হুম, পেয়েছি। পড়েও ফেলেছি। কবিতাটা ভালো হয়েছে।
-সত্য বলছেন? আমি তো খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম।
-আপনি কবিতা বেশ ভালোই লিখেন।
-তাই! তাহলে কি এই অধম কবির ব্যাপারে আপনি কি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন?
-এখনও না, আমার টিউটোরিয়াল চলছে, আমি ব্যস্ত লেখাপড়া নিয়ে, আমার কিছুটা সময় লাগবে।
-তাহলে আর এখন আপনাকে বিরক্ত করব না, শুভ রাত্রি। I wish you a sweet and beautiful dream tonight.

খুট করে একটা শব্দ করে ফোন লাইনটা কেটে গেল। নাম না জানা একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হলো নাবিলার মনে। ঠিক তার সাথে ভাললাগার দোলাচলে মিষ্টি মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে সেই রাতে ঘুমাতে গেলো নাবিলা…

ছয়
রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে সামনে নীলক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেলে বাম দিকের যেই রোডটা ব্রিটিশ কাউন্সিলের দিকে চলে গেছে, ঠিক সেই রোডের মাথায় নাহিদকে অপেক্ষা করতে বলেছিল নাবিলা। ওর খুব লজ্জা লাগছিল, ডিপার্টমেন্টের সামনে বা ডাসের সামনে দাড়ালে পরিচিত কেউ না কেউ ওদের দেখবেই। তাছাড়া, এই রোডটা নাবিলার খুব পছন্দের একটা জায়গা, হাতে সময় পেলেই বান্ধবীদের নিয়ে এখানে ঘুরতে আসে ও। একটু দূর থেকেই নাবিলা দেখল ওর প্রেমিক পুরুষ সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ নাবিলার খুব পছন্দের রং। তাই এত দূর থেকেই নাবিলার মনটা ভালো হয়ে গেল। ছেলেটা খুবই বুদ্ধিমান আর বুদ্ধিমান ছেলেদের ও দারুন পছন্দ করে। সামনে যেয়ে দাড়াতেই নাহিদ এক গুচ্ছ রক্তলাল গোলাপ উপহার দিল ওকে। নাবিলা সাথে সাথেই গোলাপের সংখ্যা গুনল, পাঁচটা। গোলাপ উপহারের জন্য পাঁচ হচ্ছে একটা ম্যাজিকেল নাম্বার। কোন মেয়েকে যদি কখনো পাঁচটা গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করা হয় তাহলে সেই মেয়ে নাকি না বলতে পারে না। নাহিদ আজকে বেশ আঁটঘাট বেঁধেই এসেছে বুঝা যাচ্ছে, ওর মন হরনকারী আর কি কি কাজ নাহিদ করতে পারে সেটা নাবিলার দেখতে ইচ্ছে করছে। প্রেমে পরলে ছেলেরা পারেনা এমন কোন কাজ নেই! আর এই ছেলে এমনিতেই দারুন ইনোভেটিভ, যে বুদ্ধি করে বায়োডাটার নামে ওকে নিয়ে লেখা একগাদা প্রেমপত্র পড়িয়ে ওর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে! হাতের গোলাপ ফুল গুলিতে ভাল করে তাকাল নাবিলা, কোন কাঁটা আছে নাকি?
-আমি এখানে আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থেকে সব কাঁটা ভেঙ্গে ফেলেছি। আপনি খোপায় ফুল পড়তে খুব পছন্দ করেন, এটা আমি জানি।

নাবিলা ওর হাতের ব্যাগটা নাহিদের হাতে দিয়ে খোপায় গোলাপ ফুল গুলি গুঁজে নিল আর ওর ব্যাগটা ফেরত নিয়ে খুব সুন্দর একটা হাসি গিফট করল নাহিদকে। খোপায় গোলাপ ফুল সহ নাবিলাকে দেখে হঠাৎই নাহিদের মনে হল স্বর্গের সবচেয়ে সুন্দরী অপ্সরীটাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিলার হাসিটা যেন ওর মাথা সাথে সাথেই নষ্ট করে দিল। মুহূর্তের মধ্যেই ও নাবিলার হাত দুটি নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে অস্ফুটে স্বরে বলল-
-নাবিলা, আমি আপনাকে ভালোবাসি, অসম্ভব ভালোবাসি। আমার বুকে ঢুক ঢুক করা এই হৃদপিন্ডটা যদি বের করে এনে আপনাকে দেখাতে পারতাম, তাহলে দেখতেন সেটার সারা জায়গায় শুধু আপনারই নাম লেখা। এই হাত দুটি ধরে সারা জীবন শুধু আমি আপনাকেই ভালোবেসে যেতে চাই, আর কিচ্ছু চাইনা। আপনি আমাকে ভালোবাসার যেই পরীক্ষাই নিতে চান আমি সেটাতেই রাজী, তাও আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

নাহিদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখে নাবিলা হতম্ভব হয়ে গেল। এই ছেলের অবস্থা যে খারাপ সেটা ও নাহিদের লেখাগুলি পড়েই বুঝেছিল, কিন্তু বাস্তবে তো মনে হচ্ছে নাহিদের মাথা ভালোই নষ্ট হয়েছে দেখি। নাহিদের এই গদগদ প্রেমের ডায়ালগ শুনতে অবশ্য ওর মন্দ লাগছে না। ছেলেটাকে ওর অপছন্দ হয়নি, চিঠির সাথের শেষ কবিতাটা কঠিন লিখেছে। ঐটা পড়ে ওর প্রায় হৃদকম্পন শুরু হয়ে গিয়েছিল। মেঘ না চাইতেই ঢাক গুরগুর অবস্থা!
-ডায়রির মধ্যে লেখা সব কবিতাই কি আপনি লিখেছেন?
লজ্জায় নাহিদের মুখ চোখ লাল হতে গেল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে নাবিলার দিকে তাকিয়ে বলল-
-আমি কি আর কবিতা লিখতে পারি? কি যে বলেন না আপনি? উল্টো পালটা কিসব লিখেছি আর আপনি বলছেন সেগুলি কবিতা!

নাবিলা হেসে দিল এই কথাগুলি শুনে। নাবিলা কবিতা খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারে, কোনটা কবিতা আর কোনটা নয় সেটা ও ভালো করেই বুঝে।
-আমাকে নিয়ে এই পর্যন্ত কয়টা কবিতা লেখা হয়েছে?
-উঁহু, এটা বলা যাবে না। আমার মনের ভিতরে এসে আপনাকে গুনে নিতে হবে!

লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল নাবিলা। হুট করে নাহিদ এমন সব কথা বলে বসে যে ওর লজ্জায় মরি মরি অবস্থা! নাহিদ এখনও নাবিলার হাত দুটি ছেড়ে দেয় নি, কেন জানি ওর মনে হচ্ছে নাবিলা ছাড়াতেও চাচ্ছে না। এক বুক ভরা ভালোবাসা চোখে নিয়ে ও নাবিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল-
-নাবিলা, আমি খুব একা। জীবনের এই নিঃসঙ্গ অথৈ সাগরের মাঝে আমি এক বুক ভরা হাহাকার নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। এক মুঠো স্বস্তির নিশ্বাসও কি আমি আপনার কাছে চাইলে দেবেন না?

অতর্কিত এই প্রেমের আহবানে নাবিলার বুকটা অপ্রত্যাশিত আবেগের শিহরণে তোলপাড় হয়ে গেল। ভালোবাসা আহবান হঠাৎই মানুষকে বিহবল করে তুলতে পারে, হৃদয়ের অন্ত:করনে প্রশান্তির পসরা সাজাতে পারে, আকর্ষণের তীব্র ছায়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে কল্পলোকের অথৈ অতলে। নাহিদের যে সাত সমুদ্র ভালোবাসা ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনুরাগে, সেটা কি এড়িয়ে যাওয়া সত্যই ওর পক্ষে সম্ভব?

নিজের মনের উপর নাবিলার অসম্ভব বিশ্বাস ছিল যে হুট করে কেউ এসে ওর মনের দখল নিয়ে যেতে পারবে না। একজন সত্যিকারের রাজকুমারই পারবে এসে ওর মনের ঘরের চাবি ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে। কিন্তু সেই কল্পনাকেও যেন হার মানাল নাহিদের প্রেমের আকুতি! এভাবে সত্যি সত্যিই ওর আসল রাজকুমার না চাইতেই চলে আসবে আর ওর মনের বদ্ধ দুয়ার চাবি কেড়ে নিয়ে খুলে দেবে, তা নাবিলা কল্পনাও করেনি। নাহিদের প্রেমময় ভালোবাসার আহবান যেন নাবিলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ওর অধর ছুঁয়ে গেল আর সাথে সাথেই নাবিলা প্রণয়ের শিহরনে কেঁপে উঠল। ভালবাসার এই হাতছানি থামিয়ে দেবার শক্তি নাবিলার নেই। ওর শীতলতায় তপ্ত হৃদয়ে হঠাৎ করেই স্পর্শ করল প্রণয়ের অনল, সেই অনলে কিছু বুঝার আগেই দগ্ধ হয়ে যায় নাবিলার হৃদয়। সেই দগ্ধ হৃদয়ে অসহ্য শিহরনের মাঝেই নাবিলা কান পেতে শুনতে পেল অনাগত ভবিষ্যতে অসম্ভব ভালোবাসায় ঘেরা জীবনের হাতছানি…….

চোখের ভাষায় ভালোবাসার অবুঝ আবদার
উচ্চারিত হয় ষোড়শীর নৃত্যেমত্ত নূপুরের নিক্কনে,
কিংবা কাঁচের কাঁকনের রিনিঝিনি পদ্যে,
অনাগত অনুভুতি কেঁপে উঠে প্রণয়ের প্রথম স্পর্শে।


সাত
নাহিদের হাতে সময় খুব কম, মাত্র দশ দিন পরেই ওর ফ্লাইট ইউএসএ তে চলে যাবার। উইন্টার সেমিস্টার শুরু হয়ে যাবে, দেরি করার কোন উপায়ও নেই। নাবিলাকে এখনও বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলেনি ও। এখন প্রায় প্রতিদিনই নাবিলার সাথে দেখা হয় ওর। সেদিন ডেস্পারেট হয়ে নাহিদ বিয়ের প্রস্তাব দিতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল নাবিলা। নাবিলা জানত আজ না কাল এই প্রস্তাব আসবেই। নাহিদেরও কোন উপায় নেই! মাথা নীচু করে ও নাহিদকে ওর বাসায় যোগাযোগ করতে বলল আর জানাল ওর কোন আপত্তি নেই বিয়েতে।

ঠিক পাঁচ দিন পরে নাবিলার বাসায় একেবারেই ঘরোয়া পরিবেশে বিকেল বেলা ওদের বিয়ে হয়ে গেল। সব গার্জিয়ানরা বসে গল্প শুরু করলে নাবিলা ওর বর কে নিয়ে ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে এল। বিকালটা তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। হাতে হাত ধরে ছাদে অনেকটা সময় দাড়িয়ে শেষ বিকেলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে দুইজন। আকাশ কিছুটা মেঘলা! হঠাৎ বয়ে যাওয়া দমকা বাতাস ওর মনটাকে ছুয়ে যাচ্ছে, কি যে ভালো লাগছে! বিশুদ্ধ বাতাসে জোরে একটা শ্বাস নিল নাবিলা, অসম্ভব সুন্দর মাতাল করা বাতাসের গন্ধ! দু এক ফোটা বৃষ্টির ছিটা এসে শীতল করে দিচ্ছে ওর মনটাকে। অসম্ভব ভাললাগা অনুভুতিতে ওর মন চাইছে হারিয়ে যেতে কোনো এক অজানা দেশে যেখানে থাকবে শুধু ও আর নাহিদ! এক বুক ভরা ভালো লাগা নিয়ে আজ নাবিলার কেন যেন এই মাতাল করা প্রকৃতিটাকে খুব করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে, এই মেঘ, আকাশ, বৃষ্টি, শীতল ঠান্ডা দমকা হাওয়া সব কিছু যেন ওর খুব আপন মনে হচ্ছে! ইচ্ছে করছে চলে যেতে সেই নীল মেঘগুলোর উপরে, আরো উপরে যেখানে থাকবে শুধু ওরা দুইজন আর ওদেরকে ঘিরে থাকবে অপরূপা সৌন্দর্য……

ঊর্মির ভাঁজে গুঁড়ো নীল জলবিন্দুর উচ্ছাস
শুন্যে উঠেই একে অন্যের সাথে বিলীন হয়ে যায়,
অপ্রত্যাশিত আবেগের জোয়ার এলে
ভালোবাসায় দুই হৃদয় মিলিয়ে যায়
একে অন্যের অস্তিত্বের সাথে।


আট
এক বছর পাঁচ মাস পরের কথা। নাবিলা জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের বর্হিগমন লাউঞ্জের একটা চেয়ারে চেক-ইন করে বোর্ডিং পাশ হাতে নিয়ে বসে আছে। আর অল্প কিছুক্ষন পরেই ইমিরাট'স একটা ফ্লাইটে লস অ্যাঞ্জেলস এ যাচ্ছে ও। নাবিলার সাথের বড় দুইটা ব্যাগের একটার মধ্যে ইউনিভার্সিটি অফ কালিফোর্নিয়ার মার্স্টাস' এর অফার লেটার। নাহিদ ওর কথা রেখেছে। ওর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল ওর প্রিয় সাবজেক্টের উপর বিদেশে যেয়ে উচ্চতর শিক্ষার, নাহিদের প্রস্তাবে রাজি হবার এটাও ছিল অন্যতম কারন।

তিন মাস আগে নাহিদ দেশে এসে ঘুরে গেছে। সাত দিন ছিল। ওরা দুইজন মিলে কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিনে বেড়াতে গিয়েছিল। ফ্লাইট এনাউন্সমেন্টে আরও ২৫ মিনিট দেরি হবে শুনে নাবিলা ব্যাগ থেকে এ্যাপলের আই ফোন এক্স বের করে সেই ট্যুরের ছবিগুলি দেখতে শুরু করল। এই ফোনটা নাহিদ ওকে গিফট করেছে, দেশে ফেরার সময় ইউএসএ থেকে নিয়ে এসেছিল। ছবি গুলি দেখতে দেখতে নাহিদের একটা ফুল স্ক্রীন ছবিতে এসে থেমে গেল নাবিলা। কি যে সুন্দর লাগছে নাহিদকে! নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না ছবিটা ওই তুলেছিল। গভীর আবেগে নাবিলা ৫.৮ ইঞ্চি টাচ স্ক্রীনে আংগুল দিয়ে বার বার নাহিদকে স্পর্শ করার চেস্টা করে যেতে লাগল……

# আজ থেকে প্রায় ছয় বছর পরে মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রী নেবার পর নাবিলা দেশে ফিরে আসে আর ঢাকা ভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। আর তার কয়েক দিন পরেই মিথিলা ওর সমস্যা নিয়ে নাবিলার সাথে দেখা করে। নাবিলার পরের পর্ব গুলিতে ওকে সাইকোলজিস্ট হিসেবে দেখা যাবে। আগ্রহী পাঠকদের কে নাবিলার পরের পর্বগুলি পড়ার জন্য সাদর আমন্ত্রন দিয়ে গেলাম।

উৎসর্গঃ এই গল্পটা মোঃ মাইদুল সরকার Click This Link ভাইকে উৎসর্গ করলাম। উনার অনুরোধেই নাবিলাকে নিয়ে লিখেছি, এমনকি এই গল্পে যে ছবিটা দেয়া হয়েছে সেটাও উনি এঁকেছেন। ইচ্ছে ছিল নাবিলাকে নিয়ে সাইকোলজির উপর লিখব, একটা পর্ব লিখেই ফেলেছিলাম, হঠাৎ করেই অনবদ্য একটা প্রেমের গল্প লিখতে ইচ্ছে করল। আর তাই…….

সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, ডিসেম্বর, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫২
৪৩টি মন্তব্য ৪৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×