মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ই*সরাইল ও ইরানের মধ্যে যে সংঘাত চলছিল সেটা প্রায় এক সপ্তাহের কাছাকাছি গড়িয়েছে। শুরু থেকে ফলাফল একরকম মনে হলেও, এখন মোটামুটি নিশ্চিত ফলাফল সম্পূর্ণ অন্যদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে ইরান তার শক্তিমত্তা প্রকাশ করছে আর ই*সরাইল অসহায়ের মতো পাশ্চাত্যের দেশগুলোর কাছে করুনা ভিক্ষা চাচ্ছে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য।
.
এবারের যুদ্ধ থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে ই*সরাইলের আসলে সত্যিকার অর্থেই মুসলিম শক্তিশালী কোনো দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। পিছনে আমেরিকা না থাকলে ই*সরাইলের অবস্থা আসলে কতটা করুণ হয় এবারই সেটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে।
.
গত সাত বা আট দিন ধরে যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখে আমার যা যা মনে হল তা এখানেই সংক্ষেপে তুলে দিলাম। সবগুলোই যে সবার চিন্তাধারার সাথে মিলবে এটা নাও হতে পারে:-
১) রাশিয়া এবার নিশ্চিতভাবে যুদ্ধে ইরানের সাথে চরমভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এতদিন ধরে চুপচাপ বসেছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি কোন দিকে যায় দেখার জন্য। ইসরাইল যে যুদ্ধে জিতে যাবে সেই ব্যাপার রাশিয়া নিশ্চিত ছিল। তাই এরা ভাব দেখাচ্ছিল যে আমরা নিরপেক্ষ অবস্থায় আছি, দুই দেশের সাথেই আমাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এখন যেহেতু ইসরাইলকে মেরে সাফ করে দিচ্ছে ইরান, এখন তাই ইরানের স্বপক্ষে উঁচু গলায় কথা বলা শুরু করেছে। তবে বেইমানদের প্রথমেই ভালোভাবে চিনে রাখা দরকার। এই বেইমান দেশ তার কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তায় এগিয়ে আসবে না। এবার আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে না।
২) শক্তিশালী বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে চীনের কোনো তুলনাই হয় না। এই মহাবিপদের মধ্যেও যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ইরানকে সহায়তা করেছে চীন। জানা গেছে প্রায় প্রতিদিনই একটা করে প্লেন পাঠাচ্ছে চীন। নিশ্চয়ই সেই প্লেনে ফুল পাঠাচ্ছে না! বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে রাশিয়ার পরিবর্তে চীনকেই ইরানে বেছে নেওয়া উচিত এবং অতি দ্রুত চীনের কাছ থেকে পঞ্চম প্রজন্মের অন্তত পাঁচ বা ছয় স্কোয়াড্রন যে ৩৫ বা ৪০ স্টিল যুদ্ধবিমান কেনা উচিত। আজ যদি এই বিমানগুলো ইরানের হাতে থাকতো তাহলে এফ ৩৫ কখনো ইরানের আকাশ সীমা ঢুকতে সাহস পেত না। ইরানের উচিত চায়না থেকে সর্বাধুনিক HQ9 এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনা। কেননা এই ডিফেন্স সিস্টেমগুলো তৈরি করা হয়েছে তাইওয়ানের সাথে ভবিষ্যতের যুদ্ধে আমেরিকান স্টিলথ বিমানগুলোকে প্রতিহত করার জন্য।
৩) মধ্যপ্রাচ্যের বাকি যে সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে দেখা যাচ্ছে এরা প্রত্যেকটা হচ্ছে ই*জরাইলের দালাল। এতদিন চুপ করে অপেক্ষা করছিল কখন ইরানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। বিশেষ করে সৌদি আরবিয়া এবং আমিরাত ই*সরাইলের সাথে মিলে প্যালেস্টাইনের উপর দিয়ে একটা করিডোর নেওয়ার পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে পারবে। ইরান খুব ভালো করে জানত এই সমস্ত বেইমান সুন্নি দেশগুলোর কাছ থেকে কোন সাহায্য কখনো পাওয়া যাবে না।
৪) এই যুদ্ধে মহান ধর্মীয় নেতা আয়তুল্লাহ খামিনি যে শক্তি, সাহস ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে নির্দ্বিধায় তাকে পুরো মুসলিম সমাজের একজন শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা হিসেবে মেনে নিতে যে কোনো মুসলমানের কোনো দ্বিধা থাকা উচিত না। তাকে নিশ্চিতভাবেই আমি প্রচন্ড শ্রদ্ধা করি এখন।
৫) divide and conquer. ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা সারা বিশ্বে যখন উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করছিল তখন তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল এটা। আর ঠিক এই অস্ত্র এর সাহায্যে এখন ব্রিটিশদের সহযোগিতায় সৌদি আরব ইত্যাদি সালাফী, ওহাবী ইত্যাদি ধর্মমত প্রচার করার মাধ্যমে সারাবিশ্বের বাকি মুসলিমদের কাছে শিয়াদেরকে খুব জঘন্য হিসাবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। এই সমস্ত বেইমান আরবদের চিনে রাখুন। এইসব ভন্ড আরবদের তুলনায় ইরানি শিয়ারাও আমার কাছে অনেক বেশি সম্মানীয়। অন্তত ইরানিদের মধ্যে এত বড় ধর্ম নিয়ে ভণ্ডামি নেই।
৬) সম্ভবত ইরানের জন্যই প্যালেস্টাইনের জনগণ এই যাত্রায় বেঁচে গেল। ই*সরাইলে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে প্যালেস্টাইনে এদের অভিযান আর চালিয়ে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে এখানে প্যালেস্টাইনদের জন্য আলাদা একটা রাষ্ট্র গঠন করা হতে পারে। যদি হয় তার পুরো কৃতিত্ব আমি ইরানকে দেব।
৭) সারাবিশ্বে চীন এখন আমেরিকার মুখোমুখি হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই জিনিসটা আরো ভয়াবহ অবস্থায় দেখা যাবে। আগে যেমন মুখোমুখি দুটা পরাশক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া ছিল, সেখানে রাশিয়া এখন অনেক দূর পিছিয়ে পড়েছে। রাশিয়ার সেই শক্তি ও সামর্থ্য এবং অর্থনৈতিক কাঠামো নেই আমেরিকার মুখোমুখি হওয়ার। সুতরাং দ্বিতীয় অবস্থান থেকে তারা নিজেরাই সরে গিয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো, তার সাথে তারা এখন সামরিক দিক থেকে দ্রুত উন্নতি করছে। আগামী বছরগুলিতে চীনের সাথে টেক্কা দিতে যে আমেরিকা শুধু অতঃপতনই হবে। মানব ইতিহাস বলে কোন সম্রাজ্যই অনন্তকাল ধরে টিকে থাকে না।
৮) এই যুদ্ধটা থামার পর, যা আশা করা যাচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যেই সম্ভব। ই*সরাইল এবং ইরান এই দুইটা দেশেরই নতুন করে দেশ গঠন করার কাজে প্রচুর অর্থনৈতিক সাহায্য দরকার হবে। আপনারা অবাক হয়ে দেখবেন যে, ইসরাইলকে সহায়তা করার জন্য আমেরিকার সাথে সবগুলো খ্রিস্টান রাষ্ট্র কিভাবে উদার হয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু ইরানকে এই কাজটা করতে হবে নিজেদের টাকা পয়সা দিয়েই। মনে হয় না কোন মুসলিম দেশ ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোর তো প্রশ্নই উঠে না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে এদের চেয়ে বড় বেইমান রাষ্ট্র আর কে আছে?
৯) আজ বা কাল যখনই হোক, ইরানকে অবশ্যই জর্দানের বাদশা এবং তার ইসরাইল সমর্থিত দালালদের জর্দান থেকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে হবে। ইরানের আর কোন বিকল্প নেই এক্ষেত্রে। ঘরের শত্রু যে বিভীষণ এটা ইরানের চেয়ে ভালো আর কে টের পেয়েছে?
১০) এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও ভয়ানক বিপদে পড়বে আরেকটা দেশ, সেটা হচ্ছে ভারত। ঐতিহ্যগতভাবে ইরানের সাথে ভারতের সুসম্পর্ক ছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বিশ্বাস করে ইরান ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজেদের চাবাহার নৌবন্দর দিয়েছিল পরিচালনার জন্য। আর এদের মাধ্যমেই ই*সরাইল ভারতীয় গোয়েন্দাদের দ্বারা মো*শাদের এজেন্ট ঢুকিয়েছিল। এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায় ইরান তাদের দেশ থেকে প্রতিটা ভারতীয়কে পশ্চাদদেশে লাথি দিয়ে বের করে দেবে। দেওয়াই উচিত, কারণ এই পৃথিবীতে ভারতীয়দের মত বেইমান রাষ্ট্র আর কোনটাই নেই। ইতিমধ্যে খবর পেলাম ৭ লক্ষ ভারতীয়কে সময়সীমা বেধে দিয়েছে ইরান থেকে বের হয়ে চলে যাওয়ার জন্য।
১১) মধ্যপ্রাচ্য সহ প্রত্যেকটা মুসলিম দেশে ইরানের ঘটনা থেকে চরমভাবে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ভারতীয়দের দেশের ভিতরে রাখলে এরা যে নিশ্চিতভাবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চর হিসেবে কাজ করে, এই ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ রাখা উচিত না কারো।
১২) আমেরিকা ইরানকে আক্রমণ না করার পিছনে আরেকটা বড় যৌক্তিক কারণ ছিল পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের সাথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিরালায় আলাপ করা। সম্ভবত আসিফ মুনির ট্রামপকে ইরানের সামরিক শক্তিমত্তার ব্যাপারে স্পষ্ট ও নিখুঁতভাবে ধারণা দিতে পেরেছে, যেটা ট্রামপকে তার সিদ্ধান্ত বদলাতে সহায়তা করেছে। ইরানের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে পাশ্চাত্য দেশ ও আমেরিকার তথ্যের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রাট ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মিলিটারি এ্যাসেট আছে। পাগল হলেও প্রত্যেকেই নিজের ভালোটা বুঝে। পাকিস্তানি সামরিক প্রধানকে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম সমাজের পক্ষে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে চাই। নিশ্চয়ই উনি বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও জনগণকে কোনভাবেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না ইরানকে সাহায্য করার ব্যাপারে। আগামী দিনগুলোতে উপমহাদেশে ট্রাম্প ভারতের তুলনায় পাকিস্তানকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিবে। মোদির কপালে শনি আছে সামনের দিনগুলিতে!
১৩) পাকিস্তানের ও তুরস্কের অতিদ্রুত ইরানের সাথে মিলে ত্রিদেশীয় সামরিক বাহিনী গঠন করা উচিত এতে প্রত্যেকটা দেশই উপকার পাবে। ভারতের আর কোনকালে সাহস হবে না পাকিস্তানে আক্রমণ করার। ঠিক তেমনি ইসরাইলও একসাথে তিনটা শক্তিধর মুসলিম দেশে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আর সাহস পাবে না।
১৪) সামনের দিনগুলিতে বাংলাদেশের যে হুজুররা সৌদি আরবকে অনুসরণ করতে বলবে তাদের যেখানে পাবেন সেখানে জুতা দিয়ে পিটাবেন। এটা হবে এদের ন্যায্য পাওনা।
১৫) শিয়া ও সুন্নি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন সংকোচ রাখবেন না। দিনশেষে মনে রাখবেন এরা উভয়ই আল্লাহকে একক খোদা হিসেবে বিশ্বাস করে এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসালামকে শেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করে। এরপর বাকি বিশ্বাসের জন্য আল্লাহ কাকে কি পুরস্কার দিবেন সেটা মৃত্যুর পর কিয়ামতের দিনই নির্ধারিত হবে। এটা নিয়ে ভন্ড হুজুরদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার কোন দরকার নেই। আমার কাছে মধ্যপ্রাচ্যের ভন্ড আরবদের তুলনায় সাহসী ইরানিদের কাছে অনেক বেশি মুসলিম মনে হয়েছে।
.
সবশেষে, বিগত এক বছরের উপরের সময় ধরে যে সমস্ত মুসলিমরা প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, লেবানন এবং সবশেষ ইরানে ইসরাইলের বোমা বা গুলির আঘাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের প্রত্যেককে আল্লাহ শহীদ হিসাবে গ্রহণ করুক, আমিন। আল্লাহ তাদের বেহেশত নসিব করুন, আমীন।
কপি রাইট @ নীল আকাশ / মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ
২১শে জুন ২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২৫ সকাল ৮:৪৭