somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নার্গিসকে লেখা প্রেমিক কাজী নজরুল ইসলামের অমর প্রেমপত্র

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নজরুলের জীবনে দু’জন নারীর উপস্থিতি খুব গভীর ভাবে লক্ষ্য করা যায়- একজন নার্গিস আরেকজন হলেন প্রমীলা। নজরুলের হৃদয়ের দুই সারথী- একজন চাঁদ তো অন্যজন নীল সরোবর।
প্রিয় কবি নজরুলকে, তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস একটি পত্র লিখেছিলেন সেই কুমিল্লা থেকে বিয়ের প্রথম রাতে নজরুলের চলে যাবার অনেক দিন পর।সেই চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন একটি গানের মাধ্যমে-
“যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে্।।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে্।।”
-কিন্তু নজরুল কি সত্যিই ভুলতে পেরেছিলেন নার্গিসকে? পনেরো বছর পর একটি আবেগময় চিঠি লিখেন নার্গিসের কাছে- যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়- যে চিঠিখানা বিশ্বের সেরা ভালবাসার তথা প্রেমপত্রের একটি।
কল্যানীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে ।মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল ।পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারি ধারায় প্লাবন নেমেছিল– তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো ।আষাঢ়ের নবমেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার ।এই মেঘদূত বিরোহী যক্ষের বানী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে ।এই মেঘ পুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার ।এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গ লোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে । যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই । তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য । লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা ।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি ।আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা ! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না । তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে । অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি ।
তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি । অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় । আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয় ।আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই ।
তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা । আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবী মূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম,অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম । সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা । পাষান দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি । আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাইনে । জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব,অধিকতর বেদনা পাব,--তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি ।
দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায় । প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান,দগদ্ধ,হতশ্রী ।তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে ।লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি ।আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য ।আত্মা অবিনশ্বর,আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা । প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে ? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে । দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না ।মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে । যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন । আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে—সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায় ।…
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা । তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি ।তুমি কি চিয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি । মনে হয় যেন কালকের কথা । মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল । সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না ।
যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর । আর তার চেষ্টা করোনা । তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক ।যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে । তুমি সুখি হও, শান্তি পাও— এই প্রার্থনা । আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই –এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ ।
ইতি—
নিত্য শুভার্থী—
নজরুল ইসলাম
(সংগৃহীত)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ২:৫২
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×