পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম করে একদিকে যেমন পারিবারিক বিষয়াদি বিয়ে, তালাক, যৌতুক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ে ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে প্রগতিশীল কাজে ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করছে বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী একটি মহল।
একথা এখন নিঃসন্দেহে প্রমাণিত, মৌলবাদীদের শক্ত হাতিয়ার এবং কৌশল হিসেবেই এসব ফতোয়া ব্যবহূত হচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক নিরর ও দরিদ্র হওয়ায় ফতোয়া নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারগুলো গেঁথে গেছে একথা বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু এসব ফতোয়ার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আইন প্রয়োগ করা এবং জনগণকে সচেতন করা এখন সময়ের দাবি মাত্র। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অজুহাতে এবং এর অপব্যাখ্যা দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত কাজ এবং ইসলামের পরিপন্থী কাজ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
1993 সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি গ্রামের জামে মসজিদের ইমামের স্ত্র ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ওই ইমামের পেছনে নামাজ পড়া নাজায়েজ বলে ফতোয়া দেওয়ার ঘটনাটা বেশ আলোচিত হয়েছিল। তাছাড়া বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, এনজিও প্রভৃতির বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে ফতোয়া দিয়েছে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী। বাংলাদেশের সরল বিশ্বাসী হতদরিদ্র লোকজন এসব ফতোয়াকে বিশ্বাস করে বিপর্যস্ত করে তুলছে পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনযাপন।
বাংলাদেশে ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার নজির আছে কিন্তু তা অপ্রতুল। তবে উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ। 2001 সালে হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ এবং বেআইনি বলে ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ফতোয়ার বিরুদ্ধে কি কি ব্যবস্থা আছে তা জানার আগে জানা যাক 'ফতোয়া' আসলে কী?
আরবি ফতোয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে 'আইন সম্বন্ধনীয় মত'। প্রচলিত অর্থে ফতোয়া বলতে বুঝায় ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত কিংবা এ ধর্মাবলম্বীদের দেওয়ানি বিষয়ে আইনগত মতামত। 'সংপ্টি ইসলামী বিশ্বকোষ' অনুযায়ী ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ফতোয়া দিতে পারেন। যারা ফতোয়া দেন তাদের মুফতি বলা হয়। সাধারণত যে কোনো পরিস্তিতিতে যখন শরীয়ত সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববতর্ী নজির এনে সমাধান দেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিভিন্ন ফতোয়া মুসলমান সমাজের প্রচলিত ধমর্ীয় নিয়মেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ফতোয়ার এ সংজ্ঞাকে পালটে (সঠিক বানান লেখা যাচ্ছে না )সাম্প্রদায়িক তুচ্ছ স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। যার বেশিরভাগ শিকার বাংলাদেশের নিরর জনগণ।
বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া প্রভৃতি।
এসব নির্দেশ কোনোমতেই ফতোয়ার সুস্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। এসব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের আইনের সমতা বিধান, নারী-পুরুষের সমতা বিধান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যেসব অনুচ্ছেদ লিপিবদ্ধ হয়েছে তার লঙ্ঘন। বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত যেসব বিধানাবলী আছে তার 27, 28, 31 ও 35 অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন।
2001 সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয় তা সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির মৌখিক তালাককে এবং হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেেিত দেওয়া হয় (তৎকালিন আলোচিত আরেকটি ঘটনা)। এ রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লঙ্ঘন করা হচ্ছে। রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মতামত সংক্রান্থ সমস্যা সমাধানের মতা একমাত্র আদালতেরই আছে। ফতোয়াবাজির ঘটনাকে আমলে নিতে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের প্রতি নির্দেশ, স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে সব স্কুল ও মাদ্রাসায় পারিবারিক আইন পাঠ বাধ্যতামূলক করা প্রভৃতি। এসব ফতোয়া বাংলাদেশের বিধিবদ্ধ 1961-এর মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের 7 ধারার বহির্ভূত এবং এ আইনের সুস্পস্ট লঙ্ঘন। তাছাড়া দন্ডবিধির 494, 498, 508 ও 509 ধারারও লঙ্ঘন।
1961 সালের আইনে তালাক সংক্রান্ত যে বিধানাবলি আছে এর 7 ধারায় বলা হয়েছে, কোনো লোক যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যথাশিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ দিতে হবে, নইলে তালাক অকার্যকর হবে। এখানে মৌখিক তালাককে অকার্যকর করা হয়েছে। নোটিশ জারি হওয়ার 90 দিন অতিবাহিত না হলে তালাক অকার্যকর হবে। তালাক কার্যকর হওয়ার পর যদি স্ত্রী স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চায় তাহলে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পুনরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে, এতে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে অন্তর্বতর্ীকালের বিয়ের প্রয়োজন পড়ে না। দম্পতি পূর্ণাঙ্গ তালাকের পর পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে চাইলে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পুনর্বিবাহ সমর্থন হবে। এ আইনে তালাকের নোটিশ পাওয়ার 30 দিনের মধ্যে আপস বা বোঝাপড়ার জন্য চেয়ারম্যান সালিশ কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ আইনের 3 ধারায় বলা হয়েছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য কোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ এ আইন অমান্য করে অন্য কোনো আদেশ বা ফতোয়া কার্যকর হতে পারে না।
দন্ডবিধির 494 ধারায় স্বামী বা স্ত্রীর জীবদ্দশায় পুনরায় বিয়ে করার শাস্তি এবং 498 ধারা কোনো বিবাহিত নারীকে ফুসলিয়ে বা প্ররোচনায় আটকে রাখলে সশ্রম কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান করা হয়েছে। 508 ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কাউকে জোরপূর্বক কোনো কাজে বাধ্য করলে যা আইনত বাধ্য নয় তাহলে দায়ী ব্যক্তি এক বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারে। 509 ধারানুযায়ী নারীর শালীনতার প্রতি অমর্যাদার কোনো কাজ বা মন্তব্যের জন্য শাস্তির বিধান আছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ফতোয়াবাজির ঘটনা আইন বহিভর্ূত কাজ এবং আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত কাজ কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। অবাক হলেও সত্য, হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়টি কোনো অদৃশ্য ও অশুভ শক্তির সমর্থনেই আপিল আদালতের নির্দেশে এখন পর্যন্ত স্থগিত আছে। রায়টির কার্যকারিতা খুব শিগগির প্রদান করাসহ প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের দাবি করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
অনেকে শরিয়া আইনের সঙ্গে এ বিধিবদ্ধ আইনের অসামঞ্জস্যকে একটি নিছক ভাঁওতাবাজি হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। কারণ শরিয়া অন্তভর্ুক্ত বিধানাবলি কোনোমতেই ফতোয়ার মতো নির্মমতা, নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন দেয় না। এটি নিছক পবিত্র গ্রন্থের অপব্যাখ্যা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতিটি ধর্মই শান্তির কথা বলে কিন্তু ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার ও কৌশল হিসেবে ব্যবহার করলেই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ফতোয়া এখন ব্যবহূত হচ্ছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে। ফতোয়াবাজদের কখনোই নির্যাতনকারী, চোরাকারবারি, ঋণখেলাপিসহ উচ্চবিত্ত লোকজনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করতে দেখা যায় না। এটাই প্রমাণ করে এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী এবং স্বার্থসংশি্নষ্ট কাজ।
হাইকোর্ট বিভাগের ঐতিহাসিক রায়ের কার্যকারিতা প্রণয়ন করা হোক। সরকারের উচিত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মৌল চেতনা রার্থে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের মুখাপেী না থেকে এসব নৃশংসতার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
(লেখাটির আইনি টার্মস উল্লেখ করার সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা তানজিম আল ইসলাম, শিক্ষার্থী, এলএলএম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এর কাছে।)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


