(১)
আজও ডাল চরচরি আর পটলভাজা। এগুলো খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে জরীর। কিন্তু প্রতিবারের মত আজকেও অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুপ করেই রাতের খাবার শেষ করলো।
কি বলবে জরী? সেও জানে পরিবারের অবস্থা। বুঝতে পারে। সবারই কষ্ট হয়। কিন্তু কি করা? জরীর এবার নবম শ্রেণীতে পড়ার কথা ছিল।
কিন্তু গত ৯মাস ধরে সে স্কুলে যায় না। এমন নয় যে সে নিতান্তই অজপাড়া গায়ের মেয়ে, যার বাবা চায় না তার মেয়ে পড়াশুনা করুক।
"নিষ্ঠুর শহর" ঢাকারই মেয়ে জরী। ঢাকা শহরকে জরী এভাবেই ব্যাখ্যা করে। "নিষ্ঠুর শহর" কারন তার পরিবারের বর্তমান অবস্থার জন্য এই শহর কোন অংশে কম করে নাই।
জরীর আরও তিনটি ভাই-বোন আছে। সবার ছোট্টটা “পরী”। কোলের শিশু। আর সেজো ভাইটার সামনের মাসেই সাত থেকে আট-এ পরবে। নাম-“দীপু”।
আর মেজ বোনটার এগারো বছর। "কলি"। ওদের চার ভাই-বোনকে নিয়ে পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৬। নিতান্তই সুখি পরিবার বলা যায়।
নাহলে কি আর, এই বাস্তবমুখী অনু পরিবারের সমাজে ৬জনের পরিবার টিকে থাকে?
কিন্তু বাস্তবতা আর লেখকের লেখা গল্পের মাঝে মিলের চে’ তুলনামূলক ভাবেই পার্থক্যই বেশী পাওয়া অস্বাভাবিক কিছুই না।
(২)
জরীর বাবা সেলিম, তথাকথিত কর্মজীবি হলেও তাকে বেকার বলাটা দোষের কিছু নয়। নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই তার।
কখনো “রেন্ট-এ-কার”-এ ড্রাইভিং, তো আবার কখনো ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করে। তবে মাসের বেশীর ভাগ সময় বাসাতেই শুয়ে বসে কাটায়।
কারণ তখন থাকে না তার করার মত কাজ।
তিনতালা বাসার নিচতলায় একটা ছোট্ট খুপড়ির মত ঘরে তারা থাকে। যেখানে বড়জোর ২জন কষ্ট করে থাকতে পারে। ভাড়া ৪৫০০টাকা।
সেলিম বাসায় থাকলে গ্যারেজের কাজও করে। তাই ভাড়া একটু কম। প্রথমে বাড়ির মালিক ভাড়া চেয়েছিল ৫০০০টাকা।
সেলিম সাহেবেরও কষ্ট হয়। সেও বুঝতে পারে। তার ছেলে-মেয়েগুলো বড় হচ্ছে। জরী এখন ততটাই বড় যতটা বড় হলে তার নিজের একটা আলাদা নিজস্ব রুমের প্রয়োজন।
কলিও বড় হচ্ছে। কিন্তু তারও কিচ্ছুই করার নাই। কিই বা করবে সে? চেষ্টা তো কম করলো না। এখনো করছে।
তিন-তিন বার সে অনেক কষ্টে বেশ বড় অংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছিলো। প্রথম দু’বার বড় বড় লোকসানে তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
আর শেষবার তো তার সঙ্গীরাই টাকা খেয়ে সাবাড় করেছিলো। শেষ পর্যন্ত তার কপালে কিছুই জোটেনি। ব্যবাসায় ঢালার মত টাকাও তার কাছে আর নেই।
আর সেই সাহসও নেই যা নিয়ে সে তার পরিচিতদের কাছে টাকা চাইবে। তবুও সে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
(৩)
টাকা গুনতে গুনতে স্কয়ার হাসপাতালের করিডর ধরে ধীর পায়ে হাটছে সেলিম। লাশবাহী একটা অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভিং করছে গতকাল থেকে।
পঞ্চম লাশটা নিয়ে এসেছে একটু আগে। প্রতি টিপ ৩০০টাকা।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় অপর পাশের করিডরে একটা ছোট-খাটো জটলা দেখলো সে। কিছু মহিলার আহাজারি কান্না কানে এলো তার।
সিঁড়ি দিয়ে না নেমে কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যায় সেই দিকে। কিছু লোক মহিলাগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো।
তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যায় তারা বেশ উচ্চপদস্থ এবং গুরত্বপূর্ন ব্যাক্তি সবাই।
পাশ দিয়েই যাচ্ছিলোএকটা ওয়ার্ড বয়। ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হইসে ভাই এইখানে?”
“আরে মিয়া, রুগীর আত্মীয়-স্বজন। শুনসি অনেক বড় ব্যবসায়ী। অনেক টাকার মালিক। কিন্তু আল্লা’র কি কেরামতি দেখসেন? দুইডা কিডনী-ই নষ্ট হইয়া গেসেগা।
ডাক্তারসাব কইসেন একটা কিডনী হইলেও বাঁচতো।”
কথাটা মগজের নিউরনে ঝড় তোলার সাথে সাথেই চোখ চকচক করে উঠলো সেলিমের।
“আলহামদুলিল্লাহ”-বলে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে জটলার দিকে পা বারায় সে।
(৪)
আজ সেলিম অনেক খুশি। অনেকগুলো টাকা পাবে সে আজ। তাদের কষ্টের দিন শেষ। তার “জরী” আবার স্কুলে যাবে। কলিকে নতুন একটা স্কুল ড্রেস কিনে দেবে। স্ত্রীকে দেবে নতুন একটা শাড়ি।
পরী আর দীপুর জন্যও কেনাকাটা করবে। আরও কত্ত কি! ভাবতে ভাবতে তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোটা আনন্দ অশ্রু।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে সে। চোখ বন্ধ। তবুও বুঝতে পারছে তাকে ঘিরে আছে বেশকিছু মানুষ। কি জেনো কথা বলছে তারা নিজেদের মধ্যে।
কিন্তু সব কথা কেমন জেনো অস্পষ্ট। হটাৎ তার পরিবারকে দেখতে ইচ্ছা করলো। সাথে সাথেই চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠলো প্রিয় মুখগুলো।
মানুষ তো একটা কিডনী নিয়েও বাঁচে। সেলিম তার পরিবারের জন্য নিজের একটা কিডনী বিনিময় প্রথায় মোটা অংকে টাকার সাথে বিনিময় করতে রাজী হয়।
মাথাটা হঠাৎ তার চক্কর দিয়ে ওঠে সেলিমের। আশেপাশের শব্দগুলো মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। কেন যেন একটু মুচকি হাসল সেলিম।
গাল বেয়ে আবার গড়িয়ে পরলো এক ফোটা আনন্দ অশ্রু। কিন্তু তা কেউ দেখতে পেলো না।
বি.দ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ন কাল্পনিক।