আঁকাবাঁকা মহাসড়ক। তার উপর দিয়ে চলছে দুপুর ১২টার “হানিফ পরিবহন” এর বাস। রংপুর থেকে গন্তব্য “যান্ত্রিক শহর” ঢাকা। টপ ভিউ থেকে দেখলে মনে হবে মস্ত বড় এক সাপ। যার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট একটা পিঁপড়া।
বাসের ভিতর বসে আছে একটা ছেলে। মনটা মনে হয় একটু খারাপ। খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেক দিন পর নিজের গ্রামে বেশ কিছু দিন থাকলো সে। বেশ ভালো কিছু সময় কাঁটিয়েছে পুরাতন বন্ধুগুলোর সাথে। বেশ কিছু নতুন অভিজ্ঞতা, বেশ কিছু সদ্য শেখা নতুন গানের সুর, বেশ কিছু স্বরনীয় হয়ে থাকার মত মুহুর্ত, সব কিছুই তাকে আবার প্রতিবারের মত ভোগাবে কিছু দিন। তারপর আবার সব আগের মত হয়ে যাবে। যান্ত্রিক ধরনের।
কানে হেডফোন গুঁজে নিজের এমপিথ্রি টা অন করলো সে। কিছুটা ঘুম ঘুম লাগছে তার। চোখ বন্ধ করলো ছেলেটা। গানটা বেশ অদ্ভুদ। আগে কখনো শুনেছে কিনা মনে করতে পারছে না। গানের কথাটা যদি এক বাক্যে বলতে হয় তবে বিষয়টা এরকম দাঁড়ায় যে, এক বৃদ্ধ তার দাম্পত্য জীবনের সময়কার পরকীয়ার কথা বলছে। ছেলেটার চোখের সামনে ভেসে উঠলো যেনো কিছু চলোমান চিত্র। সে দেখতে পাচ্ছে সেই বৃদ্ধকে। চোখ বন্ধ করেই সে অনুধাবন করলো সে বৃদ্ধের কষ্টগুলোও ফিল করছে।
লিখলাম ০৮।০৮।২০১৪ তারিখ আমার রংপুর থেকে ঢাকায় ফেরার ঘটনা। তাই বলাই বাহুল্য, বসে থাকা ছেলেটি আমিই ছিলাম। সেই গানটা আমি সারারাস্তা শুনতে শুনতে এসেছিলাম। বাসায় এসে এমপিথ্রি ঘেঁটে বের করলাম গানটার নাম। “পেস মেকার*”। গানটা নচিকেতার।
পুরো নাম- নচিকেতা চক্রবর্তী। তিনি মুলত “জীবনমুখী” গান করেন। আমার যতদুর মনে পরে আমার শুনা তার প্রথম গান “এক দিন স্বপ্নের দিন*”। তখন আমি খুব সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। আমার মিউজিকাল সেন্স খুব একটা ভালো কখনোই ছিলো না। তবে ছোট থেকেই গানের কথাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতাম। সব সময় যে বুঝতাম তাও ঠিক না। তবে এই গানটার কথা কেনো জানি আমার মনে একটা দাগ কেটেছিলো। সেই থেকে তার গান শুনার আগ্রহ কিছুটা বৃদ্ধি পায়।
নচিকেতার “বৃদ্ধাশ্রম*” গানটি শুনে নিজের বাবার কথা একবারো মনে করেনি এমন সন্তান পৃথিবীতে আছে বলে, অন্তত আমি মনে করি না। মাঝেমাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হয়, যাদের বাবা বৃদ্ধাশ্রমে আছে নচিকেতার সেই গানটি শুনে তারা নিজেদের বিবেকের কাছে কি জবাব দিয়েছিলো যখন তাদের বিবেক তাদের কাছে প্রশ্ন করেছিলো- “বাবার কথা মনে পরছে?”
নচিকেতাকে তার জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো তার প্রথম অ্যালবাম “এই বেশ ভাল আছি” যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯০এর দশকের প্রথম ভাগে। আর জনপ্রিয়তা সে পাবেই বা না কেনো? যেখানে তার গানের মাঝে আছে সুন্দরভাবে ফুটে ওঠা বাস্তবতা। তার বেশ কিছু গান আমার কাছে মনে হয় যেনো আমার জন্যই লেখা। কিন্তু আমি জানি সেটা শুধু আমার জন্য না। আমার মত হাজারো নীরবের জন্যই সেই গান। শুধু যে তরুন বা যুবক সমাজের জন্য তিনি গান করেছেন তা নয়। তিনি গান করেছেন সব সমাজের মানুষের জন্য। তাই তো তার জনপ্রিয়তা সব সমাজেই। আমি খুঁজে মরি বৃথাই যে তিনি কাদের জন্য কোনো গান করেননি। বেতনহীন শ্রমিক, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বাবা, পড়ালেখায় অমনযোগী কিশোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লড়াকু যুবক, দেশপ্রেমিক, চাকরিহীন বেকার যুবক, হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, ফেরীওয়ালা, ঘুষ খাওয়া সরকারী কর্মচারী, অবিবাহীত সমাজ, নিউ জেনারেশন, ব্যর্থ প্রেমিক,প্রেমে কাতর ডাক্তার, ডিভোর্সি বাবা-মার আত্মহননী ছেলে খোকন, পরকীয়া করে লজ্জিত স্বামী- কাকে নিয়ে গান করেননি তিনি? আরো অনেকর কথা এইখানে লিখতে পারলাম না।
হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি যেমনঃ হিমু, রুপা, মিসির আলী। কিংবা জীবনানন্দ দাসের সৃষ্টি যেমনঃ নাটোরের বনলতা সেন। অথবা, অঞ্জন দত্তের সৃষ্টি যেমনঃ বেলা বোস; তেমনি নচিকেতারও কিছু সৃষ্টি রয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলোঃ অনির্বান*, নীলাঞ্জনা, রাজসশ্রী। অনির্বান নিয়ে তিনি গান করেছেন ৩টি। নীলাঞ্জনা এবং রাজসশ্রী নিয়ে ৪টি। অনির্বান হলো নচিকেতার হারিয়ে যাওয়া এক বন্ধু যে কিনা কৃষক, দিন-মজুর, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সব কিছু ছেড়ে চলে গেছে তাদের মাঝে। এই চরিত্র নিয়ে লিখা ১ম ও ২য় গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এবার নীলাঞ্জনায় আসি। শান্ত ধরনের মেয়ে নীলাঞ্জনা। ছিপ-ছিপে গরনের শরীর। কোমর পর্যন্ত দীঘল কালো চুল। সেই স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই নীলাঞ্জনার প্রতি দুর্বল ছিলেন নচিকেতা। এই দুর্বলতার আধুনিক নাম “ক্রাশ”। কিন্তু মুখ ফুটে বলা হয়নি কিছু। যখন বলা হলো তখন বেশ দেরী হয়ে গেছে। এক সময় নীলাঞ্জনার কথা বলা সবাই বন্ধই করে দিলো। অনির্বান নামে তার আসলেই কোনো বন্ধু ছিলো কিনা, কিংবা নীলাঞ্জনা এই পৃথিবীতে এক্সিস্ট করে বা করতো কিনা আমি জানি না। যা লিখলাম তা তার গাওয়া গানের কথার উপর ভিত্তি করে। না, রাজসশ্রীকে নিয়ে আজ কিছু লিখবো না। অন্য কোনো দিন লিখবো তাকে নিয়ে।
নচিকেতার আরেক নাম হলো- “জীবনমুখী গায়ক”। আমি বলি- “অন্তর্যামী মানব”। কেননা অন্তর্যামী না হলে তিনি এই রকম জীবনমুখী গান করেন কিভাবে? আমি জানি অনেকেই তাকে তাদের ভগবানের মত মানে। কেননা তিনি তাদের দিয়েছেন পথ চলার নতুন উদ্যম। তিনি তাদের দিয়েছেন অনুপ্রেরনা। তিনি তাদের দিয়েছেন শক্তি। আর তিনি যাদের দিয়েছেন তারা তাদের প্রতিটি প্রার্থনায় স্মরন করেন এই “অন্তর্যামী মানব”কে। তবুও, শুভকামনা আর দোয়া আপনার জন্য- “অন্তর্যামী মানব- নচিকেতা চক্রবর্তী”।
“নচিকেতা চক্রবর্তী' একটি আদর্শের নাম। যে আদর্শ সততা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বিপ্লবের সমন্বয়ে গড়া।”
পুনশ্চঃ আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, এই ৪টি গান শুনবেন। আপনার কালেকশানে না থাকলে আমাকে বলবেন আমি আপনাকে ডাউনলোড লিংক দরকার হলে খুঁজে দিবো। আশা করি অনুরোধটা রাখার চেষ্টা করবেন।
*পেস মেকার- অ্যালবামঃ একলা চলতে হয় (২০০২)
*অনির্বান (১)- অ্যালবামঃ কে যায়? (১৯৯৪)
*এক দিন স্বপ্নের দিন- সিনেমাঃ হটাত বৃষ্টি (১৯৯৮)
*বৃদ্ধাশ্রম- অ্যালবামঃ দলছুট (১৯৯৯)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫৬