পরীক্ষা স্টাইলঃ প্রাইমারী থেকে স্নাতোকত্তর
প্রাইমারী
অত ছোটবেলার কথা মনে নেই, তবে কেজি এবং ক্লাস ওয়ান দুটো ভিন্ন স্কুলে পড়েছিলাম এবং কোনটিতেই ভর্তি পরীক্ষা লাগেনি। তবে ক্লাস ফাইভে ওঠার সময় আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তিও হয়েছিলাম। মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে ভর্তি হওয়ার সময় একটা নতুন শব্দ শিখেছিলাম 'ডোনেশন" যা তৎকালীন উচ্চবিত্ত অভিভাবকরা তাদের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী সন্তানদের ভর্তিতে ব্যবহার করতেন (প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রাইমারী লেভেল
তো ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোন ভীতিকর অভিজ্ঞতা প্রাইমারী লেভেলে ছিলনা, কারণ তখন তো ঐ বিষয়টার মাজেজাই মাথায় ছিলনা। মনে আছে, আমার বড় ভাই যিনি আমার এক বছরের বড় ভাই ক্লাস টুতে যখন কোন একটা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যায় (স্কুলের নামটা ঠিক মনে নাই, সম্ভবত সেন্ট জোসেফ) তখন আমার প্রশ্ন ছিল এরকম, আচ্ছা আম্মু, ভর্তি পরীক্ষায় কি আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেয়? (আলুভর্তা একসময় আমার প্রিয় খাবার ছিল
আজকের দিনের শহুরে অভিভাবকরা ক্লাস ওয়ানে ভর্তির জন্যও বাচ্চাদের কোচিং করায়।
স্কুল পরীক্ষার কথায় আসা যাক। প্রাইমারী লেভেলে আমার পরীক্ষার চেয়ে বড় বিভীষিকা ছিল মায়ের কোচিং পদ্ধতি। কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে যে ক্যাচা খাইতাম তা হজম করা সত্যি দুস্কর ছিল
হাইস্কুল পর্ব
বয়সের দোষ কন আর অভিভাবকের ছাড় কন, এই স্টেজে আইসা পোলাপানের বুদ্ধি একটু বেশীই পাকে। তো আমিই বা এর থাইকা বাদ যাই কেন? তাই সারা বছর কমিকস, তিনগোয়েন্দা, মাসুদরানা এইসব থাকত পাঠ্যবইয়ের নীচতলায় ।২/১বার ধরা খাওয়ার পর কিছু লেকচার খাইলেও বয়সের পাংখার বাতাসে ঐ লেকচার কই উড়াল দিত টেরও পাইতাম না। ভেজাল যত লাগত সব পরীক্ষার আগের রাত্রে।
নাইনে উঠার পর নম্বর তোলার আলাদিনের চেরাগ হাতে পাইলাম । আর সেই আলাদিনের চেরাগের নাম প্রশ্নব্যাংক (৫০০ নৈর্বক্তিক প্রশ্ন সম্বলিত এক আশ্চর্য আলাদিনের চেরাগ
কলেজ (কলজে র্কাঁপানো বিভীষিকাময় দিনগুলো
যে স্টেজে সব পাংখাওয়ালার পাংখা প্রপেলারের চেয়েও দ্রুত ঘোরে সেইখানে উপরের হেডলাইন দেইখা কারো কারো একটু খটকা লাগতে পারে, কিন্তু যারা টেরেন্স পিনেরু বা ফিজিক্স ল্যাবের রিপিটের ঘানি টানছে তাগো কাছে ব্যাপারটা জলবৎ তরলং।
একটু খোলাসা করি। এসএসসি পাশ করার পরে মোট নাম্বারে না কুলানোয় ঢাকা কলেজের ফর্ম তুলতে পারলাম না। কিন্তু কেমনে কেমনে জানি নটরডেমের ভর্তি পরীক্ষায় উৎরাইয়া গেলাম । তয় ঐ সময় ভর্তি পরীক্ষায় "মাস্টারমশায় খড়ম পায়ে নরম ঘাসের উপর দিয়া হাটিতে লাগিলেন" মার্কা কি একটা ট্রান্সলেশন দিছিল যেইটা তখন কপালজোড়ে পারছিলাম এইটা মনে আছে। না পারলেই ভাল হইত, তাইলে আর উপরের হেডলাইন লেখতে হইত না।
এরপর শুরু হইল পরীক্ষার ম্যারাথন। প্রথম ক্লাসে এক স্যার আইলো। তার ফার্স্ট নেম ছিল বিদ্যুত, তিনি বিদ্যুত গতিতে টানা দেড় ঘন্টা ক্লাস নিয়া বুঝাইয়া দিলেন কোন গজবের মধ্যে আইসা পরছি।
মাস্টার ছাড়াও ঐসব ল্যাবে একধরনের প্রাণী আনাগোনা করত, তাগো কেতাবী নাম ছিল ল্যাব ব্রাদার (এই ব্যাখ্যা শুধু এই সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা নাই তাদের জন্য)। ওরা যেই জ্বালাতন করছে তা মনে করলে এখনও গা কিঢ়মিঢ় করে
তয় এর মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটল। আমাদের গ্রুপের একটা অংশের সাপ্তাহিক টেস্ট এর সীট যে রুমে পড়ত সেই রুমে গার্ড দিতে আসত সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের এক সদ্যনিয়োগপ্রাপ্তা খন্ডকালীন ম্যাডাম যার ফিগার, আউটফিট ছিল সেইরকম
তো সেই পারফেক্ট ম্যাডামের খপ্পড়ে পইড়া আমাগো পরীক্ষার স্কোর হইতে লাগল ইম্পার্ফেক্ট । কারণ জৈবরসায়নের কাছে ভৌত অভৌত সব রসায়নই উদ্বায়ী গ্যাসের ন্যায় আচরণ করত। আর কোষ বিভাজনের প্রোফেজ মেটাফেজ অ্যানাফেজের ক্রোমোজমগুলা এমন গিট্টু লাগাইতো যে ঐ গিট্টু ছুটানোর সাধ্য তখনকার ঐ কচি মাথার পক্ষে সম্ভব হইত না।
যাহোক কোনমতে টেস্ট পরীক্ষা পার করার পর চূড়ন্ত পরীক্ষার সীট পড়ল সরকারী বিজ্ঞান কলেজে। তখন টের পাইলাম সরকারী কলেজ কি জিনিস। এত ক্লোজ রেঞ্জে সীট পড়ল যে একজনের খাতা দেইখা সহজেই আরেকজন পুরা পরীক্ষা দিতে পারে। তো আমি আর আমার পাশেরজন প্রিপারেশন দুইভাগ কইরা নিলাম। যেমন সে ভৌত তো আমি অভৌত, তার ভাগে স্থিতি তো আমার গতি । এইভাবে ভালই চলছিল, বাগড়া দিল শেষ দিন গণিত ২য় পত্রে। আমার ভাগ উত্তর দেয়া মাত্র শেষ করছি এমন সময় আমার পাশেরটারে দিলো সীট থেইকা সরাইয়া
ব্যথাতুর হৃদয়ে স্মৃতির মনিকোঠায় টর্চলাইট মাইরা কোনমতে বাকি পরীক্ষা শেষ করলাম।
ঝামেলা বাধল জীববিজ্ঞান প্র্যাকটিক্যাল নিয়া। কারণ কলেজে ব্যাঙ এর রক্তসংবহনতন্ত্র প্র্যাকটিক্যালের সময় প্রতিবারই ক্যামনে জানি আমার হাতে চিমটার আগায় ব্যাঙ এর হৃৎপিন্ডটা আইসা লাফাইত। তো ঠিক করলাম বাসায় বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে প্রাক্টিস করুম। বাসায় একটা পুরান চ্যাপ্টা কড়াই ছিল। ঐটার উপর মোম গলাইয়া ডিসেক্টিং ট্রে বানাইলাম। ব্যাঙ আনতে গেলাম ঢাকা কলেজে। মামু আমারে দশ টাকার বিনিময়ে একটা বাদামী খাম ধরাইয়া দিল। টের পাইলা ভিতরে মালটা লড়ে চড়ে। ফেরার পথে টেম্পুতে বইসা দেখি হাতের খামে কোন নড়াচড়া নাই। মইরা গেল নাকি! চেক করতে যেই খাম খুললাম, ব্যাঙ বাবাজি দিলো একখান লাফ। চলতি টেম্পুর ভিতরে তখন ৩ মহিলা যাত্রী, বোঝেন অবস্থা। সেই যাত্রায় কোনমতে বাসায় ফিরলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব ১
আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রী যত মেধা মগজে নিয়াই ঘুমাক না কেন এইচএসসি পরীক্ষার পর সবাইকে কাংখিত ক্যারিয়ারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের জন্য রীতিমত বুকডন দিতে হয়। আর এইসময় যারা তাদের পাংখার সাথে লাগানো ইঞ্জিন বন্ধ না করে তাদের লক্ষ্যচ্যুতির সম্ভাবনা ব্যাপক।
পাংখামি বন্ধ না করায় আমারও লক্ষ্যচ্যুতি ঘটল। শেষমেষ যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হইলাম, সেইটার ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমার ন্যূনতম প্রস্তুতিও ছিল না। লক্ষ্যবিহীন নৌকার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ শুরু হইল।
কিন্তু কয়দিনের মধ্যে আবার পাংখামি ধরল। কথায় আছে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আর অভিভাবকের শ্যেণদৃষ্টির আড়ালে মুক্ত স্বাধীন হল জীবন, আহ! কী অপূর্ব মুক্তির স্বাদ!
কথায় আছে ফার্স্ট ইয়ার ড্যাম কেয়ার, কলেজ লাইফে ঐটার স্বাদ না পাইলেও সকল অফসোস ১বছরে মিট্যা গেল। যথারীতি ইয়ার ফাইনালের ডেট পড়ল। কিন্ত বিশ্বজগতে একই সময়ে আরেকটা ইম্পর্টেন্ট ঘটনার আবির্ভাব হইল যা প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ১৬ আনাই মাটি, আর সেই গুরতর ঘটনা হইল বিশ্বকাপ ফুটবল'৯৮। ফলাফল... পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন । বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সারা বছর নাকে তেল দিয়া ঘুমায়, কিন্তু এই একটা ইস্যু নিয়া তারা ক্যান জানি খালি গোস্যা করে। কিন্তু জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে মিনমিন করতে করতে সব মাইনা নেয়। অতএব বিদায় বইখাতা,স্বাগতম ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইতালি...।
বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রথম বিশ্বকাপ দেখা, খেলা দেখার মানেই পাল্টে দেয়! টিভি রুমের দুই টিভি দুই দলের সমর্থকের দখলে, গ্যালারীও আলাদা। প্রতি খেলায় জিতলে দলীয় সমর্থকদের চাদা তুলে খিচুড় খাওয়া আরো কত আয়োজন। পরীক্ষার আয়োজন শিকেয় ঝুলে রইল ফাইনাল শেষ হওয়ার অপেক্ষায়।
এসময় পরীক্ষা ও প্রস্তুতির নতুন কিছু রূপ উন্মোচিত হলঃ
১. ভালো জ্যাক থাকলে প্রশ্ন ফাঁস করেও পরীক্ষা দেয়া যায়।
২. সুপার কম্পোজের উপর নির্ভরশীলদের কাছে ফটোকপি মামুর কদর বেড়ে যায়।
৩. পরীক্ষা খারাপ হলে একশ্রেণীর পরীক্ষার্থীনিদের স্যারদের চেম্বারে ছুটতে দেখা যায়।
৪. আদুভাইদের নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আড্ডা দিতে দেখা যায়।
৫. কম্পিউটার সহজলভ্য হওয়ার ফলে ডিজিটাল নকলের সাপ্লাই পাওয়া যায়।
মাস্টার্স পর্বের পরীক্ষা তো আরেক তামশা। সারা কোর্সে ক্লাসের খবর নাই, পরীক্ষার আগে এসাইনমেন্ট থেকে স্যাররাই সাজেশন দিয়া দেয়, প্রিপারেশন বলতে পরীক্ষার দিন সকালে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া। পড়বে কখন, সবাই তো বিসিএস প্রিপারেশন আর নানামুখী ক্যারিয়ারের চিন্তায় চিন্তিত। হাফ বেকার থেইকা ফুল বেকার জীবনে পদার্পনের চুড়ান্ত প্রস্তুতি...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুন, ২০০৯ রাত ৯:৫৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




