somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইচ্ছামৃত্যু

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নব্বই একানব্বই সালের কথা। বাবার চাকরির সুবাদে তখন আমরা সিলেটের জৈন্তাপুরে। এই থানাটিকে নিয়ে বহুল প্রচলিত মজার একটি প্রবাদ আছে। তা হলো ‘পান-পানি-নারী এই তিনে জৈন্তাপুরী। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে বাবা যখন সিলেট থেকে জৈন্তা বদলি হলেন তখন পাড়ার কিছু লোক আমাদের দুইভাইকে ‘জৈন্তাপুরি ভূত’ বলে ক্ষ্যাপাতো। আর তা শুনে বড় ভাইয়ের কি মনে হতো জানিনা তবে আমার খুব খারাপ লাগতো। শিশু মনতো জৈন্তাতে আসলেই ভূত থাকে বলে ধরেই নিয়েছিলো। সেখানে না যাওয়ার জন্য মায়ের কাছে কত বায়না। কত অযৌক্তিক আবদার। একেতো স্কুল চেঞ্জ করতে হবে। খেলার সাথীদের ছেড়ে যেতে হবে। এই কষ্টটা যে কত প্রবল তা কেবল আমার মতো বদলিজনীত রোগে ভোগা পরিবাবের সদস্যরাই বুঝতে পারবে সবেচেয়ে বেশি।

সেই জৈন্তা গিয়ে আমরা দুই ভাই পুরোপুরি হতাশ। কারন দিনে তো প্রশ্নই ওঠেনা রাতেও কোন ভূত আমাদের চোখে পড়েনা। তবে চারপাশটা বেশ নিরব-শুনশান। প্রকৃতির সৌন্দর্যতা যেন গভীর থেকে গভীরতর। আমাদের উপজেলা পরিষদের বাসা থেকে দূরে খুব স্পষ্টই দেখা যেত খাসিয়া মেঘালয় পাহাড়। এই পাহাড় দেখলেই মনে হতো বুঝি কবি নজরুল ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ গানটি লিখেছিলেন।

বিরান্নবই সাল। আমি তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ করেই মামার সঙ্গে জৈন্তাপুরের আফিয়া নগর চা বাগানে ঘুরতে গেলাম। মায়ের মামা তখন সেই চা বাগানের বড় ম্যানেজার। সম্পর্কে দাদু। তার বড় ছেলে সুমিত মামা আমাদের বাসায় থেকেই স্কুলে পড়তেন। সেই সূত্রে স্কুল বন্ধ হলেই সুমিত মামার সঙ্গে চা বাগানের উদ্দেশ্যে হাওয়া হয়ে যেতাম।

দাদুর চা বাগানের বাংলো টাকে সুন্দর বললে কম বলা হবে। চা বাগানের ম্যানেজার বলে কথা। বিশ-পঁচিশজন কাজের লোক, ফুলের বাগান, ড্রাইভার, মাঝি কত কি! প্রকৃতির সঙ্গে জম্পেশ আয়েশি জীবন। দাদুর তিন ছেলে। মানে আমার তিন মামা। বড় মামা ছাড়া সবাই আমার কাছাকাছি বয়সের। তাই তাদের সঙ্গে আমি যখনই ঘুরতে যেতাম তখন বড় ম্যানেজারের নাতি হিসেবে সকলেই খুব সমীহ করতো। যেন আমরা দেবতাতূল্য।

বরাবরের মতো এবারও বিকেলে মামার সঙ্গে আমি বাগানে ঘুরতে গেলাম। ওই বস্তির মোড়ল টাইপের এক মুটকু লোককে ডেকে আমাদের দেখভাল করার দায়িত্ব দিলেন দাদু। আমাদের দেখে তাদের কি যে করিমরি অবস্থা। ম্যানেজারের ছেলে-নাতি বলে কথা। তাদেরকে তো খুশি করতেই হবে। কিন্তু তারা কি করবে? দৈন্য দশা, খর-মাটির বসতি। মাটিতে বস্তা বিছিয়ে কোনরকমে মশারী বিহীন ঘুম। সপ্তাহ শেষে তলব বারে প্রতি পাতা ছেঁড়ার গুনতিতে সবকুছু বাড়ে কেবল বাড়েনা টাকার গুনন। তা সেই বৃটিশ আমল থেকেই। তার উপর বড় ম্যানেজার, ছোট ম্যানেজার, বড় হেড টিলাবাবু, ছোট হেডটিলাবাবু মাড়িয়ে যে টাকাটাও আসে সেটিও তারা ধরে রাখতে পারে না। দেশী মদ, ভাং দারুর স্রোতে ভেসে যায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সঞ্চিত সেই পয়সা।

সেদিন দেখি একটি ছেলে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে তার বসে আছে একটি শালিক পাখি। আমাদের অবাক হওয়া দৃষ্টি দেখে ছেলেটি পাখি নিয়ে আরো কসরত করতে লাগলো। পাখিকে উদ্দেশ্য করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা ভাষায় বলতে লাগলো,
এই 'লক্ষী' মাথায় উঠে আয়রে তুই। আর সঙ্গে সঙ্গে পাখিটি মাথায় উঠে আসে। আবার, ‘আয় লক্ষী তুই এবার হাতে আয়’। পাখি তখন হাতে চলে আসে। সে তাকে খাওয়ায়।
আমার দেখে খুব লোভ হলো। ইস এরকম যদি আমার একটা পাখি থাকতো। কত মজা হতো। পাখিকে হাতে নিয়ে স্কুলের বন্ধুদের সামনে খুব ভাব নিতাম। স্কুলে যাবার পথে একটি ভিউকার্ডে ঠিক এইভাবেই পাখি হাতে আমি অমিতাভ বচ্চনকে আমি দেখেছি।

তাকে বললাম, ‘এই পাখিটা আমাকে দিয়ে দাও’।

ছেলেটা আমার থেকে দুই তিন বছরের বড় হবে। কিশোর ছেলে। আর আমি তখন বালক। ছেলেটা কোনভাবেই রাজি হলোনা। কিন্তু আমাদের সাথে যে মোড়ল গোছের লোক ছিলো সে তার নোংরা খড়ের মতো লালচে গোঁফে তা দিতে দিতে আচমকা হুঙ্কার দিয়ে ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বললো, ‘ম্যানেজার বাবুর নাতি খুঁইজছে আর তুই দিবিক না? এটা কি বলিসরে তুই? এটা কিছু হইলো? তুই এটাক দিয়ে দে।

ছেলেটি প্রথমে ভয় পেলেও খালি হাড্ডিসার গায়ে নির্বিকার ভাবে মুটকু মোড়লের চোখে চোখ রেখে উত্তর দিলো, না লক্ষী'কে আমি দিবক না। আমি এটা দিতে পারবোক না। আমি এটা পালি। এটাক আমি গোইছল করতে গেলে গোইছল করে। আমার সাথে থাকে, আমার সাথে খায়। আমি এটার সাথে ঘুমাই। এটা আমি দিবক না, দিতে পারবোক না। বুঝ না কেনে?

শোন হরি, তুই যদি না দিস তাইলে কিন্তু আমি পঞ্চায়েত ডেকে বিচার দিমুরে। তোর কাছে কত পাখি এরকম আছে। ছোট বাবু থাকে শহরে। বাবুর নাতি এটা চাইছে। ছোট্ট নাতি। এই নাতি চাইছে। আর এই নাতিরে তুই দিবিক না? ইমোশনের ভরি মিশিয়ে চোখমুখ পাকিয়ে বললো মোড়ল।

কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। সে দেবে না।

তাকে আমি বললাম, ‘আমি তোমাকে টাকা দেব। পুরো বিশ টাকা দেব। আমাকে তুমি এই পাখি দিয়ে দাও, প্লিজ। পরে মামা, মোড়ল ও তার বাবার অনুরোধে বিশ টাকার বিনিময়ে ছেলেটা কাঁদো কাঁদো হয়ে পাখিটি আমাকে দিয়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গেই হাফ পেন্টের পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে দিলাম তাকে। তাঁর চোখের কোনে টলমল করছে পানি। আমি তার দিকে না তাকিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলাম।

সে উত্তর দিলো, ‘হরি কৈরী’।
আর পাখির নাম? ‘লক্ষী কৈরী’।

মনে আছে ঐদিন রাতে আর ঘুমাতে পারছিলাম না। শুধু এপাশ ওপাশ করেছি। কখন সকাল হবে।

সকাল হলেই খাঁচা বন্দি ‘লক্ষী কৈরীকে’ নিয়ে আমি জৈন্তা ফিরে এলাম। সবাইকে দেখাই। কলোনীর বন্ধুদেরকে দেখাই। বাসার তিনতলা বারান্দায় পাখির খাঁচাটিকে ঝুলিয়ে রাখি। যাতে বেড়াল মশাই নাগাল না পান। ভাত খাওয়ায়। পানি খাওয়াই। মনে মনে ভাবি, দু’তিনদিন থাকার পরে লক্ষীকে একেবারেই খাঁচা থেকে মুক্ত করে দেব।

ঠিক তিনদিন পর দুপুরের দিকে লক্ষীকে নিয়ে পুকুরে গোসল করতে গেলাম। আসলে পুকুরে গোসল করাটা ছিলো উপলক্ষ্য মাত্র, মূলত পাখিটিকে কাঁধে হাতে রেখে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবার জন্যই আমার তর সইছিলো না। বন্ধুদের আগে থেকেই বলা ছিলো। তাই ঠিক সময় পাখি আর নতুন মালিকের তেলেসমাতি দেখার জন্য পুকুর পাড়ে বন্ধুরা সবাই অপেক্ষা করছিলো। পুকুর পাড়ে খাঁচাটিকে রেখে সবার সামনেই আস্তে করে খাঁচার দরজাটা খুলে দিলাম। পাশ থেকে বন্ধু বিরল বললো, 'দেখিস শালিক পাখি তো পোষ মানবে না। বের হয়েই ফুরুত দিবে'।

বিরলের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠলো। আমি তখন তাদের কথা না শোনার ভান করে সমজদার মনিবের মতোই বললাম,

‘আয় লক্ষী বাইরে চলে আয়’ চু..চু..চু আয় আয়..

কিন্তু পাখি খাঁচা থেকে বের হওয়া তো দূরে থাক। খাঁচার গায়ের সাথে লেপ্টে ঝিমুচ্ছে। যেন না উড়ার পণ করেছে। ধৈর্যের সীমা ভেঙ্গে গেলে হাত দিয়ে বের করে লক্ষীকে কাঁধে তুললাম। তারপর একে একে...

(চলবে).....


সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×