somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটা রাতের গল্প

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহরের শেষ সীমায় গ্রাম্যলোকালয়ের পর মাঠ টা পেরিয়ে আর একটু হেঁটে গেলে কালভার্ট টা পড়ে। আমরা যখন ওখানে পৌঁছালাম তখন এশার আজান হয়েগেছে। অন্ধকারের মাঝে উঁচু কালভার্টটার উপর একটা ম্রিয়মান সোলার লাইট জ্বলছে। কোথাও জনমানুষ নেই কুয়াশায় ভরে আছে তলের খাদ টা। হঠাৎ দেখে মনে হবে কালভার্ট টা যেন হঠাৎ ই পথের পাশের জঙ্গল ফুঁরে নতুন পথ তৈরি করেছে। আমরা ওটা পেরিয়ে মেহগিনি গাছের ঘণ বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথে একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল যার আশেপাশে অন্য কোন দোকান বা বসতির চিহ্ন নেই। কাসতের মতো একটা পথের বাঁকে দোকানটা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে চুলার কয়লার আগুনের সামনে চাদর দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা এক কাস্টমার আর দোকানী ছাড়া কাওকে দেখলাম না। এই ছায়া অন্ধকারে চায়ের কাপ হাতে কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছাটা যদিও ত্যাগ করতে হলো। কারণ তখন ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে হাত পা। যখন হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম তখন আবহাওয়াটা এতো বৈরী ছিলো না। সন্ধ্যা ছটার কিছু আগে বেড়িয়েছিলাম ঘন্টা তিন পেরিয়ে গেছে। শহর থেকে বেশি দূরে যাইনি এটা নিশ্চিত কিন্তু ফিরতে এই পথই আবার পেরতে হবে এটা ই চিন্তার আর গত আধা ঘন্টায় একটা রিকশা তো দূর একটা ভ্যান ও চোখে পড়েনি। আরো কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর আমরা একটা পরিত্যাক্ত বাগানের মতো জায়গায় এসে পৌঁছালাম। জায়গাটা আমাদের চেনা শহরের পশ্চিমে বৃটিশদের তৈরি পুরনো পার্কটার মতো। এবং ওটার মতোই দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে আকাশ ছোঁয়া সব গাছ। সুমনের জোড়াজোড়িতে একটা গাছের তলে বেদিতে বসতে হলো এই পথ আসতেই ক্লান্তিতে ও ভেঙে পড়েছে। ইতিমধ্য ঘন্টা চার হাঁটা হয়ে গেছে গল্পের ভেতর ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি, আর আমার এমন হাঁটার অভ্যাস আছে। জায়গাটা নির্জন, কুয়াশায় দ্রুত গাছপালা সব ঢেকে যাচ্ছে তবে আমরা শিশিরে ভিজে যাচ্ছি না। চাঁদ নেই, আকাশের নিজস্ব আলোয় আবছায়া দেখা যাচ্ছা চারপাশ। হঠাৎ সামনে একটা ঝাঁকড়া গাছ দেখে সুমন বলে উঠলো, আরে ওটা কি শ্যাওড়া গাছ নাকি! গ্রামে যেয়ে ও শ্যাওড়া গাছ দেখে এসেছে। তাকিয়ে দেখলাম বিশাল ঝোঁপালো অনেকটা মানুষের মাথার মতো কালো একটা অন্ধকার। আর তখনই আমাদের পাশে কেউ যেন হেঁটে এলো। আমরা দুজন ই ট্যেঁর পেলাম সেটা অথচ মোবাইল টর্চ জ্বেলে কাওকে দেখতে পেলাম না! কিছুক্ষণের ভেতর দু দুবার এমনটা ঘটলো যে, কে যেন আমাদেরকে মাঝে রেখে বৃত্তকার পথে দৌঁড়ে গেল। মনে হলো কারো যেন ছায়াও দেখলাম। এর পরপর ই দেখলাম সামনের ঝোঁপালো গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে গরগর শব্দ করছে একটা কুকুর।
কুকুরটা রাগে গজরাচ্ছে যেন এখনই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার ভয় হলো কুকুরটা হয়তো অসুস্থ, কে জানে জলাতঙ্ক টঙ্ক আছে কিনা! পশুপাখির উপর সুমনের যে বিশেষ ভালবাসা আছে আমি আগে থেকেই জানতাম কিন্তু সেটা যে ও একটা পাগল কুকুরের উপর প্রয়োগ করবে আমার জানা ছিলো না। আমাকে অবাক করে দিয়ে সুমন আদুরে শব্দ করে রাগী কুকুরটাকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু এতে কুকুরটার ভেতর সামান্যতম পরিবর্তন তো এলোই না বরং আরো যেনো হিংস্র হয়ে উঠলো তার মুখের ভাব। কুকুর টা তখনো পর্যন্ত একবারো ডাকেনি। অপরিচিত মানুষ দেখলে যেমন স্বরে তেড়ে আসে তেমনও নয় বরং হিংস্র এক ক্ষোভে মৃদু গর্জনে যেন শাষাচ্ছে আমাদের। কিছু সময়ের ভেতর কুকুরের সংখ্যা এক থেকে দুয়ে বৃদ্ধি পেলো। যেন প্রথম কুকুর টার পেছনেই এতোক্ষণ অন্যটা দাঁড়িয়ে ছিলো। এবং চোখের পলকেই সংখ্যাটা দুই থেকে পাঁচ কি ছয়ে চলে গেলো। অন্ধকার ফুঁড়ে ওরা যেন বেড়িয়ে এসেছে। সুমন চুপ, কিছুক্ষণ আগের পশুপ্রেমী সুমন আর এই সুমনের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষ, আমার মত ই ওর মুখেও স্পষ্ট একটা আতঙ্কের ছাপ। কুকুরগুলো যেখানে ছিলো সেখানেই আছে কিন্তু তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সবার ভেতর তীব্র ঘৃণা এবং শিকারী একটা ভাব স্পষ্ট। আমি মোবাইলের আলো সামনে থেকে সরাতে সাহস পাচ্ছি না হয়তো এরা দল বেঁধে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে আমাদের। এদিকে হঠাৎ তাপমাত্রাটা যেন আরো নিচে নেমে গেছে, ঠান্ডাতে জমে যাচ্ছে হাত পা। দ্রুত সুমন এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কোনভাবে দৌড়ানো যাবে না আমরা চুপচাপ এখান থেকে হেঁটে বেড়িয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের মুখের কথা শেষ হবার আগেই কোথা থেকে একটা ঝড় ছুটে এলো আমাদের দিকে। কোথাও এতোটুকু বাতাস নেই, নিচে একটা পাতাও নড়ছে না অথচ আমাদের চারপাশের গাছগুলোর উপর দিয়ে যেন কালবৈশাখী বয়ে যাচ্ছে। গাছের ডালপালা ভেঙে তুমুল বেগে কিছু একটা ছুটে আসছে আমাদের এদিকেই। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা দৌড়াতে শুরু করলাম। চারদিকে ঘণ কুয়াশার মেঘ কেঁটে বড় বড় গাছের মাঝ দিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি। কুকুরগুলো আমাদের পেছন পেছন ছুটে আসছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অতোকিছু বোঝার সময় ও নেই শুধু জানি বাঁচতে হলে আমাদের এখান থেকে বেড়তে হবে। আমরা দৌড়াচ্ছি আমাদের পেছনে তাড়া করছে একটা তুমুল ঝড়,হিংস্র আক্রোশে গাছের ডালপালা ভাঙার উন্মাদ শব্দ।
সে রাতে কতটুকু বা কতক্ষণ দৌড়ে ছিলাম জানি না মনে হচ্ছিলো যেন অনন্তকাল ধরে দৌড়াচ্ছি, এই রাত যেন ফুরবার নয়। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় একটা খালের ভেতর পড়ে গেলাম। আমার চার পাশে ঝড় আর পানির স্রোতের তীব্র শব্দ, এর ভেতরই আমার নাম ধরে সুমনের চিৎকার শুনতে পেলাম। আমার সাঁতার জানা ছিলো না, তবু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কাদাপানি হাতড়ে এগিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু কেউ যেন পেছন থেকে আমার একটা পা শক্তকরে চেপে ধরলো। সে বা সেটা আমাকে পানির তলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছি আমি। নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, এখনি হয়তো মারা যাবো আর ঠিক সেসময় ই হাতের নাগালে শক্ত দড়ির মতো কিছু একটা পেয়েগেলাম। খরকুটোকে ধরে ভেসে যাওয়া মানুষ যেভাবে বাঁচতে চাই আমি ঠিক তেমনি ওটাকে চেপে ধরলাম অন্ধের যষ্ঠির মতো। শেকড়টাকে ধরে শরীরে অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারলাম পা টা আঁকড়ে ধরা জিনিসটাকে। একরকম ভাগ্যগুণেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খালের খাড়া ঢাল বেয়ে অপর তীরে উঠে এলাম। নিচে এক ভয়ানক জান্তব চিত্কা র পানিতে হুটোপুটির শব্দ।
আমি খাল পাড়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, পানিতে শব্দটা থেমে গেছে। কোথাও সামান্যতম শব্দ নেই, চারদিকে নিচ্ছিদ্র নীরবতা। খালের অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরগুলো। একসময় পেছনের কুয়াশায় একে একে কুকুরগুলো যেন মিলিয়ে গেল। তারপর কি হয়েছিলো আমার মনে নেই। পরে জেনেছিলাম সেদিন ফজরের ওয়াক্তের কিছু আগে হাইওয়ে র কাছথেকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় এক ভ্যানওয়ালা আমাকে পেয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। যেখানে আমাকে সে পায় সেটা ঘটনাস্থল থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে। আমার সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরতে একসপ্তাহের বেশি লেগেছিলো।
সুমনের খোঁজ পাওয়া যায় আমাকে পাওয়ার দুদিন পর যশাইখালি নামক একস্থানে, খালের ভেতর মৃত অবস্থায়। ওর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট লেখা হয়েছিলো পানিতে ডুবে মৃত্যু কিন্তু তখন যশাইখালির খালে হাঁটু পর্যন্তও পানি ছিলো না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:২৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×