somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বর্ণমালা ও ভালোবাসা (স্মৃতিচারণ)

১১ ই নভেম্বর, ২০১১ সকাল ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার বয়স সাড়ে চার বছরের মত ছিল যখন প্রথম বর্ণমালা শিখি। আব্বাই শিখিয়েছিল। আম্মা শিখিয়েছিল ১,২- মানে ধারাপাত। আর আপুর কাছে শিখেছিলাম ABCD আর ছবি আঁকা। সে সময়ে দাঁতে পোঁকা ধরেছিল, সারাক্ষণ পেন্সিলের শিস দিয়ে দাঁত খোঁচাতাম। একটা পেন্সিলের শিসও আস্ত থাকত না। ভেঙ্গে ফেলতাম দাঁত গুঁতাতে গিয়ে। আত কান পাঁকা রোগ ছিল, মাঝ রাতে কানের ব্যথায় ষাঁড়ের মত চেঁচাতাম। সবাই ঘুমিয়ে থাকত তারপরেও। আম্মা কেমন করে জানি অন্য ঘর থেকে টের পেয়ে যেত যে আমার কানে ব্যথা- আমি জেগে আছি। উনি উঠে এসে আমার কানে চামচে সরষের তেল গরম করে ঢেলে দিতেন। আরাম লাগত তখন। ঘুমিয়ে যেতাম। কিন্তু পরদিন আব্বা চেঁচিয়ে বাসা মাথায় করে ফেলত তার ছেলের কানে সরষের তেল ঢেলে দেয়ার জন্য। কানের পর্দা নাকি খুব ডেলিকেট হয়। তেল টেল দিলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কানে ড্রপ দিতে হয়।
নতুন খাট কিনে দেয়ায় হয়েছিল আপুকে। সেই খাটে শোবার লোভে আব্বা আম্মার বিছানা ছেড়ে আপুর সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলাম সাড়ে চার বছর বয়সে। আপু বরাবরি খুব উদার মনের মানুষ। মশারি টানিয়ে দিত, বিছানা যাতে না ভেজাই সেজন্য প্লাস্টিক বিছিয়ে তার ওপর ছোট কাঁথা বিছিয়ে দিত। আর আমি যখন ঘুমিয়ে থাকতাম তখন আপু ব্লেড দিয়ে আমার হাত-পায়ের বড় বড় নখ গুলো কেটে দিত। আমি টের পেতাম না। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম আমার আঙ্গুলে কাপড়ের ব্যান্ডেজ! আপু নখ কাটতে গিয়ে আমার আঙ্গুলও অল্প বিস্তর কেটে ফেলেছে! গগণ বিদারী চিৎকার দিয়ে বাসা মাথায় করে ফেলতাম। আম্মা এসে ঘটনা দেখে হাসতে হাসতে আপুকে ধমক লাগাতেন, “বাসায় কি নেল কাটার নেই? ব্লেড দিয়ে কেউ নখ কাটে!”
আমার আপু অনেক ভাল ছবি আঁকতে পারতো। ছোট থেকেই দেখতাম আপু অডিও ক্যাসেটের কভারের হিন্দী সিনেমার নায়ক নায়িকার ছবি হুবহু পেন্সিল দিয়ে এঁকে ফেলত। রাতে মশারির ভেতর আমি যখন ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যেতাম- ও ছবি আঁকত একা একা আমার পাশে বসে। মাঝ রাতে বিছানা ভিজিয়ে দিয়ে আমার ঘুমের মধ্য বিরতিতে জেগে উঠলে অবাক হয়ে দেখতাম এখনো জেগে আছে আপু! রাবার ঘষে ছবি ঠিক ঠাক করছে। রঙ পেন্সিল দিয়ে বং করা শুরু করেছে সবে। সে সময়েই ছবি আঁকার প্রতি নেশা ধরে যায় আমার। আপুর কাছেই ছবি আঁকার হাতে খড়ি। আপু ছবি আঁকা শেখানোতে যাচ্ছে তাই ছিল- মানে টিচার হিসেবে যাচ্ছে তাই। কিছুই বুঝতাম না। আমাকে বোঝাতে না পেরে বিরখত হয়ে ভাগিয়ে দিত। তবুও আমি ঘুরঘুর করতাম সারাক্ষণ ছবি আঁকা শেখার জন্য।
অন্য দিকে আব্বাকে বাঘের মত ভয় পেতাম। খাওয়া দাওয়ার ব্যপারে আব্বার হাতে প্রচুর মার খেয়েছি। বাসায় আব্বাই ছিল প্রধানমন্ত্রী। সপ্তাহে দুই দিন টিভি রূম খোলা থাকত আপু আর আমার জন্য। বাকি সপ্তাহ পড়াশোনা। এই নিয়মটা আমি আমার এস.এস.সি. পরীক্ষা পর্যন্ত পালন করে এসেছি। আব্বা টিভি দেখাকে পড়াশোনার ঠিক উল্টোটা মনে করতেন। তাই পরীক্ষার এক মাস ধরে কোনো টিভি দেখা যেত না। আবার পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহ টানা টিভি দেখতে দিতেন। তারপর আবার ‘দুই দিন’ নিয়ম চালু।
আমি বর্ণমালা শিখতে অনেক সময় লাগিয়েছিলাম। আব্বা আমাকে থাপ্পড় মেরে মেরে স্বরবর্ণ গুলো লেখা শিখিয়েছিলেন স্লেটে করে। আমি মার খেয়ে নাকের পানি চোখের পানিতে স্লেট ভিজিয়ে দিতাম, চকের দাগ বসত না তখন। অর্থহীন আঁকাবুকি গুলো মাথায় ঢুকত না। বর্ণ “এ”-কে মনে হত একটা ছেলে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। “ঐ”-কে মনে হত ছেলেটা বসে বসে আড় মোড়া বাংছে হাত ওপরের দিকে তুলে। বিচিত্র সব খেলা মনে হত আমার কাছে। আম্মার যখন ১,২ শেখাতো তখন মনে হত একটা পরিবারের ছোট ছেলে হল ১ ( আমার মতই বয়েস ছেলেটার)। ২ হল ছেলেটার বড় বোন ( আমার আপুর মত স্কুলে পড়ে, একা একা ছবি আঁকে, গান করে)। ৩ হল ছোট ফুপ্পি ( ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে সবে)। ৪ হল মা ( আমার মা)। ৫ হল বাবা ( আমার আব্বা)। ৬ হল সেজ চাচা (যিনি বিয়ে করেননি)। ৭ হল বড় চাচী ( খুব ভাল মানুষ, পিঠা বানিয়ে দেয়)। ৮ হল বড় চাচা ( উনি হাই কোটের উকিল)। ৯ হল দাদী ( সারাক্ষণ হানম দিস্তায় পান সুপারি ছেঁচে যাচ্ছেন)। ১০ হল দাদা ( বদ মেজাজী বুড়ো)।
এজন্য আম্মা যখন আমাকে “১” দেখিয়ে বলতেন, “ বলো তো বাবা এইটা কি?”
আমি বলতাম, “আমি!”
“৪” দেখালে, “এইটা কি?”
“তুমি!”
“৫” দেখালে, “আর এইটা?”
“আব্বু!”
আম্মা হতাশ গলায় বলতেন বইটা দেখিয়ে, “ তাহলে এইটা কি?”
“আমরা সবাই!” গম্ভীর মুখে বলতাম।
আমার স্বরবর্ণ শেখার দিনটা এখনো মনে আছে। বৃহস্পতিবার রাতে আমি স্লেটে করে “অ” থেকে “ঔ” পর্যন্ত লিখে দিতে পেরেছিলাম আব্বাকে। লেখাটা জমা দিয়ে বীরের মত তাকালাম আব্বার দিকে। আব্বা ভাবলেশহীন মুখে এক নজর দেখলেন। তারপর কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন। আমি সামান্য অবাক হয়েছিলাম। এত কষ্ট করে ছবি গুলো চক দিয়ে ঘষে মেজে এঁকে দিলাম- একটু বাহবাও দিল না! মন ক্ষুণ্ণ হলাম। মন খারাপ করেই ঘুমিয়ে গেলাম রাতে। মাঝ রাতে একবার ঘুম ভাঙ্গলো। যে জন্য ভাঙ্গে আর কি, সব ভিজিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মন খারাপ ভাবটা তখনো ছিল। তাই ভেজা কাপড়েই আপুর পাশে ঘুমিয়ে গেলাম আবার।
ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ঠান্ডা কন কনে শীত। আমরা তখন সিলেট ক্যান্টনমেণ্টে থাকতাম। জায়গাটা অসম্ভব সুন্দর ছিল। ছবির মত সুন্দর। আমি জেগে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আব্বার কোলে। তিনি আমাকে কোলে করে নিয়ে হাটছেন ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে একটা গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে! একটু দূরেই হাওড়। কুয়াশা চারিদিকে। সে সময় শীত কালেও হাওড়ে পানি থাকত। ইদানীং থাকে না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আপুও আছে সঙ্গে। গোলাপী একটা জামা পরেছে, তারওপর কাডিগেন। খালি পায়ে হাটছে, হাতে সেন্ডেল। আমি এদিক ওদিক তাকানো শুরু করলাম। আমি জেগে উঠেছি দেখে আব্বা আমাকে মাটিতে নামিয়ে দিল। আমি আব্বার হাতের আঙ্গুল ধরে হাটতে লাগলাম। আব্বার সঙ্গে হাওড়ের কাছে এসে দেখলাম একটা ডিঙ্গি খুঁটি গেঁড়ে রাখা। মাঝি গামছা বিছিয়ে সেই ঠান্ডার মাঝে ঘুমাচ্ছে পাটাতনে শুয়ে। আব্বা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ নৌকায় চড়বি?”
আমি আর আপু ঘাড় কাত করে সায় দিলাম। আব্বা মাঝিকে ডেকে ঘুম ভাঙ্গালো, “ও মাঝি, নৌকাটা একটু লাগবো। দিবা? ছেলে মেয়ে দুইটাকে একটু ঘুরায় দেখাইতাম।” মাঝি চাচা চোখ কচলাতে কঁচলাতে উঠে বসলেন, অবাক হয়ে একবার আব্বার দিকে আরেক বার আমাদের দিকে তাকাতে লাগলেন। দেখে মনে হল আব্বার কথা বুঝতে পারেনি।
সে সময়ের মানুষ গুলোকে আল্লাহ নিশ্চই অনেক মমতা ঢেলে গড়েছিলেন। ভেবেছিলাম নৌকা দেবে না। কিন্তু দেখলাম লোকটা ঘুম ঘুম মুখে উঠে নেমে এলেন নৌকা থেকে, বৈঠাটা আব্বার দিকে এগিয়ে দিলেন। নৌকা নিয়ে যে কেউ পালিয়ে যেতে পারে- তা নিয়ে বিন্দু মাত্র ভাবনা নেই যেন! আমাদের দিকে তাকিয়ে কেবল বললেন, “শক্ত করি বসিও। পানি ঠান্ডা, পরি গেলে জ্বর আইবো।” তারপর গামছা ঘাসের ওপর বিছিয়ে শুয়ে পরলেন। ঘুমাতে লাগলেন আবার!
আব্বা সাবধানে আপু আর আমাকে নৌকায় তুলে দিয়ে দাঁড় হাতে উঠে পরল। লুঙ্গি পরে এসেছিল আব্বা। সেটা হাটু পর্যন্ত তুলে ভাল করে বসল পাটাতনে। আপুকে বলল, “শিহাবকে শক্ত করে ধরে রাখিস। পড়ে টড়ে যায় না যেন!”
আপু আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে রাখল। আব্বা দাঁড় বাওয়া শুরু করলেন। (আমি দাঁড়/বৈঠা দুটোই এক সাথে লিখে ফেলছি। কারণ এ দুটো জিনিসের ঠিক কোনটা যে সে সময় আব্বার হাতে ছিল মনে নেই। তাছাড়া এ দুটো জিনিসে পার্থক্যও আমি বুঝি না।) ধীরে ধীরে নৌকাটা নিয়ে হাওড়ের মাঝে ঢুকে পরলাম আমরা।
অদ্ভূত নীরবতা চারপাশে। হাওড়ের পানি থেকে কুয়াশা উড়ছে, সূর্যটা সবে মাত্র বেরিয়েছে, তরল সোনা ঢালছে যেন হাওড়ের পানিতে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছি। আব্বা আপুকে হঠাৎ বলল, “শিমু, একটা গান ধর তো।”
আপু গান ধরলো। ( তার জাতীয় সঙ্গীত হল “মাঝি নাও ছাইড়া দে”! আপু এই এক গান সবখানে গেয়েছে সারা জীবন। পুরষ্কারও কম পায়নি। কিন্তু এই এক গান শুনতে শুনতে আমার কান পঁচে গেছে। আমার ধারণা দুলাভাই মাঝ রাতে যদি একটু শখ করে আপুকে বলেন, “একটা গান ধরো তো শিমু।” আপু মাঝ রাতেই গলা ছেড়ে গাওয়া শুরু করবে “মাঝি নাও ছাইড়া দে.......” বেচারা দুলাভাই!)
যা হোক, আপু গান গাইছে। চারপাশের নিস্তব্ধ হাওড়ের মাঝে ছড়িয়ে যাচ্ছে ওর গানের কন্ঠস্বর।

“মাঝি নাও ছাইড়া দে
ও মাঝি
পাল উড়াইয়া দে,
গা রে মাঝি গা কোনো গান...........”

আমি অবাক হয়ে শুনছি। আপুর গানের গলা খুব মিষ্টি। তবে আম্মার গানের গলাটাই বেশি ভাল মনে হত সব সময়। মা মেয়ে দুজনেই ভাল গান গাইত। আমি ভাল গান পারি না, আব্বাও না। আব্বার প্রিয় গান হল রাজ্জাকের একটা ছবির গান। দুষ্টুমী করে প্রায়ই আম্মার কানের কাছে গায় এখনো-

“আমার নাম কালু মিয়া,
থাকি আমি করোটিয়া।
মাসে দেড় শো ট্যাকা মাইনে পাই-
আমি এক উকিলের চৌকিদার...........”

আব্বার এই গান নিয়ে কম হাসা হাসি হয় না বাসায়। থাক সে কথা। হাওড়ে ফিরে যাই।
আব্বা বৈঠা বাইতে বাইতে হাওড়ের ঠিক মাঝামাঝি একটা গাছের কাছে এলেন। হাওড়ের পানির মাঝে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা বটগাছ। বেশি বড় না। প্রচুর পাখি গাছটায়। কিচির মিচির কিচির মিচির করছে। চারপাশে এখানে শাপলা আর শাপলা। নৌকাটাকে এখানে বেঁধে আব্বা লুঙ্গি মালকোচা মেরে পানিতে নেমে গেলেন। অল্প পানি হাওড়ে। মাত্র চার ফুট হবে। আব্বার লুঙ্গি ভিজে গেল। অনেক গুলো শাপলা তুলে আনলেন আমাদের জন্য। নৌকায় যখন উঠে এলেন- শীতে ঠক ঠকিয়ে কাঁপছেন। আপু আবিষ্কার করল আব্বার হাটুতে একটা চিনা জোঁক! গগণ বিদারী একটা চিৎকার দিয়ে নৌকার একদম কোনায় চলে গেল। আমি বেশ অবাক মুখে জোঁকটার দিকে তাকালাম। এত ভয় পাওয়ার কি আছে? কি সুন্দর চুষনির মত ধরে রেখেছে হাটু। টেনেও ছোটানো যাচ্ছে না, লম্বা হয়ে হয়ে যায় কেবল! পিচ্ছিল খুব। মজা লাগল। আব্বা বেশ খাণিক্ষন টানাটানির পর ছোটাটে পারলেন জোঁকটা। গলগল করে রক্ত বেরুল জায়গাটা থেকে। আপুতো বেহুঁশ হয়ে যাবে রক্ত দেখে। আব্বা হেসে বললেন, “অত ভয় পাবার কি হল? জোঁক বুঝি আর কাউকে কামড়ায় না!”
শাপলা নিয়ে আমরা হাওড়ের মাঝ দিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলাম। কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে কাঁচা সোনা রোদে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। কোত্থেকে এক ঝাঁক বক আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আমি বিস্মিত চোখে পৃথিবী দেখছি তখন!
নৌকা নিয়ে ফিরে এলাম সেই মাঝির কাছে। উনি এখন কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছেন হাওড়ের পাড়ে। আমাদের দেখে কয়লা মাখা দাঁত বের করে হাসলেন, “কি গো বাবু সাবেরা, গোরা কেমুন হইলো?”
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, “আপনার টুথপেষ্ট-টুথব্রাশ নাই? কয়লা দিয়ে দাঁত মাজলে মাড়ি নষ্ট হয়।” আব্বার কাছে শোনা জ্ঞান ঝেড়ে দিলাম।
আমার কথা শুনে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলেন মাঝি চাচা।

ফেরার পথে একটা রুটির দোকানে বসলাম আব্বার সাথে। মাটির চিমনিতে নান রুটি বানাচ্ছে এক চাচি। আমরা বড় বড় টিনের মগে চা দিয়ে রুটি খেলাম। খুব খিদা লেগেছিল, গো-গ্রাসে খেলাম। শাপলা যে কাঁচা খাওয়া যায় সেটা জানতাম না, দোকানি চাচি আমাদের শাপলা গুলো থেকে কয়েকটা আঁশ তুলে লবন দিয়ে খেতে দিলেন, খেয়ে দেখলাম আসলেই খাওয়া যায়। খারাপ না। উনি শাপলার ডাটা দিয়ে মালা বানানো শিখিয়ে দিলেন আপুকে। আপুর মুখে হাসি আর ধরে না!
বাসায় যখন ফিরলাম, দেখি আম্মা সবে ঘুম থেকে উঠেছেন, “কোথায় গিয়েছিলে সব? আমি উঠে দেখি বাসা ফাঁকা। দরজাও বাহির থেকে বন্ধ। না বলে যাও কেনো?”
আব্বা দাড়াজ গলায় হাসলেন, “তোমার ছেলে বাংলা বর্ণমালা শিখেছে এই খুশিতে ঘুরতে নিয়ে গেলাম। তোমার তো শরীর খারাপ- তাই ডাকিনি।”
আমি অবাক হয়ে সে মুহূর্তে তাকিয়ে ছিলাম আব্বার দিকে। মাত্র এগারোটা অক্ষর লেখার খুশিতে মানুষটা এত সুন্দর একটা সকাল উপহার দিবেন- আমার ছোট মাথায় আটছিল না। আমার জীবনের সব চেয়ে সুখ স্মৃতিময় সকাল সেটাই ছিল।
সে দিন দুপুরে আমার বর্ণমালা শেখা উপলক্ষ্যে বাসায় পোলাউ আর গরুর মাংস রান্না করা হল। আমার অতি প্রিয় চিংড়ি মাছ আঁকা কাঁচের প্লেটে করে খেতে দেয়া হল সেদিন আমাকে। আমি নির্বাক হয়ে কেবল আমার আম্মা, আব্বা আর আপুর দিকে তাকাচ্ছিলাম। কেমন যেন অসহায় লাগছিল নিজেকে। এত ভালোবাসা আল্লাহ এদের মাঝে দিলেন কি করে? নিজেকে সেদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা মনে হচ্ছিল আমার।

ছোট থাকতে প্রতি শুক্রবার সকালে আব্বা আপু আর আমাকে নিয়ে কোয়ার্টারের ছাদে উঠে পানির পাইপ গুলোর ওপর বসে ইসলামী ইতিহাস শোনাতেন। গল্পের মত করে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)’র জীবনী বলতেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। আমি ছোট বেলায় খুব দূর্বল ছেলে ছিলাম- তাই আমাকে যোগ ব্যায়াম করাতেন ছাদে সেই সময়। আমি যোগ ব্যায়াম করতে করতে আমাদের ইসলামের নানান কাহিনী শুনতাম মন্ত্র মুগ্ধের মত। চোখের সামনে যেন সব দেখতে পেতাম।
আমি ঠিক করেছি আমার ছেলে মেয়ে যখন হবে, আমিও ওদের বর্ণমালা শেখাবো। যেদিন শিখে যাবে সেদিন সকাল বেলা ঘুরবে আমার সাথে। আর আমার সেই চিংড়ি মাছের প্লেটে পোলাউ-মাংস খাবে ওরা। আমি সপ্তাহে শুক্রবার সকাল বেলা ওদের ইসলামী ইতিহাস শোনাবো। যোগ ব্যায়াম করাবো।
আমার জগৎটাকে আল্লাহ অনেক সুন্দর করে, অনেক মমতা দিয়ে গড়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। এজন্যই বোধ হয় আমার চারপাশের মানুষ গুলো এত ভাল! আমার খুব অবাক লাগে- এত মমতা উনি এক বুকে ধরেন কি করে? আমি চাই আমার সন্তানরাও একদিন উনার এই মমতা টের পাবে, এবং অবাক হয়ে যাবে!
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×