somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরজি - পূর্বাভাস

২৩ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“আম্মা আমি যামু না!” গোয়ারের মতো বলে উঠল ফারজানা। ভারী বেনারসী আর গলা ভর্তি গহনার ভারে মেয়েটার গলা সামনের দিকে ঝুকে পড়েছে রীতিমত। হাড্ডিসার মানুষ। সবে চৌদ্দতে পা রেখেছে। ক্লাস নাইনে উঠেছে গেল জানুয়ারিতে। এরপর কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাড়ির মুরুব্বীরা পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ে ডাঙ্গর হয়েছে, বিয়ে দেওয়া দরকার, তার ওপর কাজী বাড়ির মেয়ে- চার পুরুষ পর্যন্ত সব মাদ্রাসা, মসজিদের হুজুরে ভরা। ওর আব্বা, বড় ভাই, মেজ ভাই প্রত্যেকে দুইবার করে হজ্জ্ব করে ফেলেছে। কানাইঘাট কামিল মাদ্রাসার মাওলানা সবাই। চাচাদের মধ্যেই দুজন আছেন মৌলভি। বলা যায় বেশ নাম ডাক করা পরিবার। কেবল একটাই সমস্যা, এই পরিবারে মেয়েদের পড়াশোনাটা খুব বেশিদূর আগায় না। আগালেও বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে যদি আগ্রহ করে মেট্রিক, ইন্টার দেওয়ায়- ঠিক আছে। কিন্তু এর বেশি কেউ যায়নি।
ফারজানা মাওলানা ইউসুফ সাহেবের কনিষ্ঠা সন্তান। বাকি সব ছেলে মেয়ের বিয়ে শাদী হয়ে গেছে। নাতি পুতিও আছে। ফারজানাই বাকি ছিল। আজকে দুম করে আসরের ওয়াক্তে তাঁরই কোন এক ছাত্রের সাথে বলা নেই কওয়া নেই- ফারজানার বিয়ে দিয়ে দিলেন ইউসুফ সাহেব। বলা যায় একেবারে খেয়ালের বশে। পরিবারের কারো সাথে কোনো কথা বার্তা আলাপ আলোচনা ছাড়াই যোহরের ওয়াক্তে সিদ্ধান্ত নিলেন, আসরের মধ্যে বিয়েও দিয়ে দিলেন মেয়েকে জোর করে।
বিয়ের শাড়ি আর গহণা সব ফাতেমা আখতারের, ফারজানার মা। মেয়ের বিয়ের চিন্তায় একসময় গহনা জমা করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক দিনেই যে বেনারসি কিনে মেয়েকে এভাবে হুট করে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে- ভাবেন নি। শুধু তাই না। জামাই যে আসরের পর পর নব বিবাহিতা ফারজানাকে সঙ্গে নিয়ে সুনামগঞ্জ রওনা দিতে চাইবে- সেটা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করেননি। ছেলে খুবই সাধারণ ঘরের, হাফেজ। হামিদ পাটোয়ারী নাম। তেমন আয় উপার্জন নেই। মাদ্রাসায় আরবী পড়ায়, পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকাল সন্ধ্যায় আরবী পড়িয়ে আসে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের। এরপরেও তেমন একটা স্বচ্ছলতা নেই। তবে বাপের ভিটা বাড়ি আছে একটা কোনো রকমের। এমন ছেলের সাথে বিয়ে কেন দিলেন আদরের ছোট মেয়েটাকে ফাতেমা আখতার বুঝতে পারলেন না। ছেলে তাঁর স্বামীর এক কালের ভাল ছাত্র হতে পারে, তাই বলে মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দিতে হবে? অন্দরমহলে অনেক অসন্তুষ্টি ছিল তাঁর। কিন্তু স্বামীর সিদ্ধান্তের ওপর কোনো রকম মন্তব্য করলেন না। ইউসুফ সাহবে স্ত্রীর পরামর্শ বা এ জাতীয় বিষয়ে কোনো আলাপে কান দেন না। এক রোখা।
কিন্তু বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ছেলের তাড়াহুড়া করে বৌ নিয়ে যেতে চাইলে হকচকিয়ে যান। ইউসুজ সাহেব বাদে প্রায় সবাই। সুনামগঞ্জ যাওয়া কি মুখের কথা? তাও আবার গ্রামে যেতে হলে হাওড় পাড়ি দিয়ে যেতে হবে! এখন আসর শেষ, মাগরীবের বেশি বাকি নেই! এটা কি ধরণের গোয়াতুর্মী?
কিন্তু বিচিত্র ব্যাপার, মাওলানা ইউসুফ সাহেব ঠিকই রাজী হয়ে গেলেন। গম্ভীর গলায় রায় দিলেন, “বিয়ে হয়ে গেছে। ফারজানার যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে হামিদ। আমরা এখন দূরের মানুষ। মেয়ের সাথে বেশি মায়া মহব্বত রাখার প্রয়োজন নাই, মেয়ে স্বামীর ঘরে আর যাইতে চাবে না।” আশ্চর্য এক বাক্য! সকালেও যে মানুষটা জীবন থেকেই অপরিচিত ছিল, বিকেলে কিনা মেয়েটার সমস্ত জীবনের সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অভিভাবক হয়ে গেল?
ফারজানা ভেতরের ঘর থেকে আবার গোঙ্গানোর মতো করে বলল, “আমি কিন্তু যামু না আম্মা! আমারে নিয়া টানা টানি করলে বিষ খামু! আমার পাখিগুলা, গাছগুলারে কে দেখবো?”
ঘর ভর্তি ছোট বড় টব আর আঙিনায় শখ করে অনেক গাছ লাগিয়েছিল ফারজানা। ফলের গাছ, ফুলের গাছ। সেগুলোর মায়া কাটাতে পারবে না সে। তারওপর আছে একটা খাঁচা ভর্তি আটটা বড় বসন্তবৌরি পাখি। নীলগলা বসন্ত। এগুলোর সাথেই সারাক্ষণ কিচির মিচির করে কাটে ফারজানার দিনের দীর্ঘ সময়। এগুলোর কী হবে?
ফাতেমা আখতার অসহায় গলায় উত্তর দিলেন, “মেয়ে মানুষের জীবন তো কচুপাতার পানিরে মা। আইজ এইপাতায় তো কাল ঐ পাতায়। কোনো ঠিকানা নাই। স্বামীর ইচ্ছার অবাধ্য হইয়া কি করবি? জাহান্নামের ভয় ডর নাই তোর? এইসব অলুক্ষুনে কথা কবি না।”
ফারজানা বিষ খাওয়ার জন্য বোতল খুঁজে পায়নি। বিপুল ওজনের শাড়ি সামলিয়ে সেই ইঁদুর মারার বিষ খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমস্ত ঘটনা যেন ঝড়ের বেগে ঘটতে লাগলো। বেবি টেক্সি নিয়ে এলো বড় ভাই। আম্মা আর চাচী মিলে ব্যাগ গুছিয়ে দিল ফারজানার। ঘোরের মধ্যে পুরো সময়টা পেরিয়ে গেল। বেবি টেক্সিতে করে দীর্ঘ রাস্তার যাত্রা করে সুনামগঞ্জ আসা, হাওড়ে পৌছানো ভ্যানে করে। সেই ভ্যান থেকে নেমে কাঁদা মাখা পথ ধরে হেঁটে, কাঁদায় স্যাণ্ডের ছিঁড়ে নৌকার ঘাটে পৌঁছানো। অতঃপর রাত দশটার দিকে হামিদের গ্রামের উদ্দেশ্যে ছইওয়ালা নৌকায় করে রওনা দেয় আদিগন্ত বিস্তৃত হাওড়ের মাঝ দিয়ে। যাত্রী হচ্ছে- ষাটের কাছাকাছি মাঝি চাচা, ছইয়ের ভেতরে বসে থাকা হামিদ, ফারজানা আর এক খাঁচা ভর্তি চুপচাপ জেগে থাকা বসন্তবৌরি। বাড়ি থেকে আসার সময় পাখিগুলোও নিয়ে এসেছে ফারজানা। নাহলে কেঁদে বাড়ির উঠানে গড়াগড়ি শুরু করে দিচ্ছিল। সারাদিনের ধকলে এখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে ফারজানা। লম্বা ঘোমটার ভেতর মুখ হা করে ছইয়ে হেলান দিয়ে, পা লম্বা করে ঘুমিয়ে গেছে ও। একটা হাত খাঁচার ওপর দিয়ে রেখেছে আলতো ভাবে। সে ঘুমালেও পাখিগুলো ঘুমায়নি। নৌকার হারিকেনের হলদে আলোয় জ্বল জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে।
দীর্ঘ এই যাত্রায় হামিদ গুণে গুণে তিন চারটি শব্দ ছাড়া কোনো কথাই বলেনি। ছইয়ের ভেতর মূর্তির মতো বসে রয়েছে অন্ধকারের মাঝে। ছই থেকে ঝুলতে থাকা লণ্ঠন একবার এদিক, একবার ওদিকে নড়ছে। সেই আলো এসে পড়ছে ফারজানা আর পাখিগুলোর ওপর। হামিদ ওপর পাশে। নৌকায় সামনের দিকে মাঝি, এরপর ফারজানা, তারপর হামিদ বসা। হামিদ আর মাঝি দুজনে দুই পাশে বসা, মাঝে ফারজানা।
মেঘে ঢাকা আষাঢ়ের আকাশ। চাঁদ নেই। কৃষ্ণপক্ষের রাত। মাঝে মাঝে একপশলা বৃষ্টি এসে কুয়াশার মতো আরেকদিকে চলে যাচ্ছে। হাওড়ের পানির উচ্চতা বেড়েছে। আগের টানা দশ দিনের বৃষ্টিতে ধারে কাছের অনেক গ্রাম ডুবে গেছে। দ্বীপের মত বাড়ির চাল জেগে আছে। কিন্তু গাছের বড় বড় ডাল। মানুষজন সরে গেছে। যারা সরে যেতে পারেনি, বাড়ির চালে উঠে বসে আছে। সেই সব চালের ওপর ছাতা, পলিথিন হাতে অবয়বগুলো বসে থাকতে দেখা যায় অন্ধকারের মাঝে। রহস্যময় লাগে। বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি অদ্ভুত এক ছায়াচিত্র এঁকে দিয়েছে বিস্তৃর্ণ হাওড়ের মাঝে কৃষ্ণ বিন্দুর মতো।
দাঁড় ফেলার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হচ্ছে। এলোমেলো বাতাস এসে হু হু কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, শরীর এবং হারিকেনের শিখা- দুটোই।
গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল প্রায় ফারজানা। স্বপ্ন দেখছিল কিনা ঠিক জানে না, ঘুমের ভেতর কেন যেন মনে হল ভেজা ভেজা কিছু একটা তার শরীরে হাত রেখেছে... ঘোমটার আড়াল সরিয়ে ভেজা কিছু একটার নিঃশ্বাস তার গালে লাগছে। অশুচি একটা অনুভূতি... আচমকা ঘুমের ভেতরের ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠল। কেউ একজন তার খাঁচার ওপর রাখা হাতটায় ঠাণ্ডা একটা ভেজা হাত রেখেছে। হামিদ? চেনা নেই জানা নেই, হাত ধরতে যাবে কেন? অবাক হয়ে ঘোমটার ভেতর থেকে মুখ তুলে তাকাতেই বিদ্যুতস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠল। নৌকাটায় কেউ নেই! তার স্বামী হ্যাঙলা পাতলা সেই ঘিয়া পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা কই? মাঝি? মাঝি চাচা কই গেল?
ফারজানা অস্ফুট গলায় ডাকলো, “শুনছেন? কই গেলেন আপনারা?” খানিক আগে ঘুমের মধ্যে হাত কে ধরেছিল বুঝতে পারছে না। বিচিত্র একটা ভয়ে হাত পা সব সেঁধিয়ে যাচ্ছে ভেতর দিকে।
“শ-শুনছেন?” ভয়ে পাখির খাঁচাটা আঁকরে ধরল ফারজানা। পাখিগুলো নিশ্চুপ। সামান্য নড়তেও ভুলে গেছে। যেন কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে।
হারিকেনটা দপ করে নিভে গেল হঠাৎ... ঘুটঘুটে অন্ধকার।
পরক্ষণেই মনে হল আঁশটে একটা ভেজা শ্যাওলা মাখা হাত ওর শাড়ির ভেতর দিয়ে পেটের কাছটায় নখ সহ খামচে ধরল! ফারজানা চিৎকার দিয়ে ওঠে। আবছা আঁধারে দেখতে পায় ওর সামনে কালো জমাট একটা অন্ধকার বসে রয়েছে ঠিক পূর্ণ বয়ষ্ক মানুষের মতো......
“ম-ম-মাআআআআ... মা-আ-আ-আ...” একদম শিশুর মতো একটা ডাক ভেসে এলো অন্ধকারটা থেকে।
ফারজানা জমে গেল বরফের মতো। কথা বলতেও ভুলে গেছে। অন্ধকারটা তীব্র শ্যাওলা এবং কাঁদা মাটির গন্ধ ছড়াচ্ছে। যতটুকু দেখা যায়, ঝুঁকে এসে দুই হাত এবং মুখটা ফারজানার পেটের দিকটায় ছুঁইয়ে করুণ স্বরে আবার ডাকল, “মা-আ-আ, মা-আ-আ-আ।” যেন পেট চিড়েই ঢুকে যেতে চাইছে।
ফারজানা অচ্ছুতের মতো জিনিসটা দেখে সরে যেতেও ভুলে গেছে। অসম্ভব একটা ঘৃণায় সমস্ত শরীর রি রি করছে, আর ভয়ে ভেতরটা দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। হাপড়ের মত বুক ওঠা নামা করছে... পেটের কাছে নখের চাপ বাড়ছে, অন্ধকার জিনিসটা ফারজানার পেটে, নাভির কাছাকাছি নখ বসিয়ে দিয়েছে তীব্র ভাবে...
ফারজানার চলৎ শক্তি লোপ পেয়েছে। বস্তুটা ওপর পেটে চিড়ে ফেলার মতো অবস্থায় চলে যাচ্ছে যত সময় গড়াচ্ছে।
“ম-ম-মা-আ-আ-আ... ম-ম-মা-আ-আ” একদম ছোট্ট শিশুর মতো করুণ স্বরে ডাকছে, অসহায়ের মতো।
ফারজানা চিৎকার দিতে মুখ খুলেও আবিষ্কার করল সে চিৎকার দিতে পারছে না। তার যাবতীয় প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে অজানা কিছু একটা। বিন্দু মাত্র টু শব্দও করছে পারছে না...
কাঁপছে থর থর করে মেয়েটা অসহ্য যন্ত্রণায়... কালো জমাট অন্ধকারটা ওর নাভি ছিঁড়ে নখ গেঁথে দিয়েছে ভেতর পর্যন্ত...

নিস্তেজ হয়ে আসছে দ্রুত ফারজানা। মনে হচ্ছে রুহ বেরিয়ে যাচ্ছে তার। অন্ধকার জিনিসটা পেট ছিঁড়ে ওর ভেতর ঢুকে পড়বে আর কিছুক্ষণ যেতে থাকলে। চোখের সামনে বস্তুটা নিজের আকার বদলে ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে......
চোখের সামনে লালচে কালো একটা পর্দা নেমে আসতে শুরু করেছে ফারজানার। সংজ্ঞা হারাচ্ছে? নাকি জীবন? মৃত্যু কি এরকম অসহ্য যন্ত্রণাময়?

সহসা থ্যাঁপ করে একটা বাজে ধরণের ভোঁতা শব্দ হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুরো অন্ধকারটা ফারজানাকে ছেড়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই অন্যপাশের খোলা ছই দিয়ে কুকুরের মতো তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে হাওড়ের অন্ধকার পানিতে ঝাপ দিলো মৃদু শব্দ তুলে...
চেতনা হারাতে হারাতে কেবল দেখতে পায় ফারজানা মাছধরার কোঁচ হাতে এইপাশের ছইয়ের মুখে ঝুঁকে বসে রয়েছে হামিদ। পরিচিত মুখটায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, কিছু একটা বোধহয় বলেছিল। ফারজানা টের পায়নি।

০০০০০০০০০০০০০০০০০

“ফারজানা?”
বহুদূর থেকে ডাকটা ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো ফারজানা। অন্ধকার আর লণ্ঠণের টিমটিমে আলোয় চোখ সয়ে আসতে সময় নিলো।
নৌকা ঘাটে ভিড়েছে। হামিদের গ্রামে এসে পৌঁছেছে ওরা। মালপত্র সব নৌকা থেকে নামানো হয়ে গেছে। একেবারে ঘাটেই ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। টর্চ হাতে আরো লোকজনের সমাগম। বৌ নিতে এসেছে নাকি ঘাটের কারণে রাত বিরাতে মানুষজন এতো বেশি বুঝতে পারলো না ফারজানা।
“লম্বা ঘুম দিছে বেডি। যাও মা, আইয়া পড়ছি।” মাঝি চাচার সরল স্নেহমাখা গলা শুনতে পেল। মাথার ভেতর তীব্র ভোঁতা একটা ব্যথা করছে।
হামিদ আবার ডাকলো, “কই? তাড়াতাড়ি করো। বেশি রাত হইয়া গেলো তো।“
ফারজানা ধীরে ধীরে নৌকার ছইয়ের নিচ থেকে রাতের খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে আসে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে, এলোমেলো ঠাণ্ডা বাতাস। পাখির খাঁচাটা নিয়ে পেছন থেকে বেরিয়ে এলো হামিদ। “চলো, নামতে পারবা ঘাটে? আমি ধরমু?”
ফারজানার কোনো একটা কারণে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। আশ্চর্য তো! এটা কেমন ব্যাথা? হামিদকে তো বলাও যাবে না। সাথে আম্মাও নাই যে বলবে কিছু। তাছাড়া এখন মাসিকের তারিখও না। সেই ব্যাথা উঠলে তো আগে আম্মার কোলে গুটিসুটি মেরে সারাদিন শুয়ে থাকতো। এখন কোথায় যাবে সে রকম হলে?
নৌকা থেকে নেমে ভ্যানে উঠতে গিয়ে ফারজানা পেটে, নাভির কাছটায় চাপ চাপ ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। হামিদ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকার সময় হাত দিয়ে অন্ধকারে পেটে রাখতেই বরফের মতো জমে গেল ফারজানা। আঙ্গুলের আগায় এগুলো কি? কালচে? রক্ত না? কম্পিত হাতে আচঁলের নিচ দিয়ে পেটে ভাল করে হাত দিতেও অসংখ্য কাটা দাগ, গভীর ক্ষত’র অস্তিত্ব আবিষ্কার করল......
“কি আজীব কারবার! একটা মড়া পাখিও নিয়াসো নাকি ফারজানা বানু?” হামিদ ভ্যানের সামনের দিকে মুখ করে খাঁচাটা তুলে দেখতে থাকে।
আটটা পাখির সাতটা পাখি চুপচাপ বসে রয়েছে। কেবল একটা নিচে পা উলটে পড়ে আছে, ডানা ছড়িয়ে... মারা গেছে।
ফারজানা ভীত দৃষ্টিতে হামিদের হাতের খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আঁচলের আড়ালে একটা হাত পেটের ক্ষতগুলো খামচে ধরে রাখে অজ্ঞাত, অসংজ্ঞায়িত কোনো ভয়ের কারণে।
টিপ টিপ বৃষ্টিটা বাড়ছে। ছাতা মেলে ধরেও বাঁচা যাচ্ছে না। হামিদ আর ফারজানা কাছাকাছি হয়ে বসেছে এক ছাতার নিচে। উঁচু নিচু গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে ভ্যান ছুটে যাচ্ছে লন্ঠনের আলোয়। ছাতায় খাঁচাটা জায়গা না হওয়ায় ভিজে যাচ্ছে দেখে হামিদ ভ্যান চালকের উদ্দেশ্যে বলল, “পাখি গুলা তো ভিজে যাইতেছে, ও ভাই পেলাস্টিক টেলাস্টিক নাই তোমার ভ্যানে? ঢাকে দেওয়া যাইতো?”
ভ্যানওয়ালা উত্তর দেয়ার আগেই ফারজানা নিচু স্বরে বলে উঠল, “পাখিগুলা ছেড়ে দেন। উড়ে যাক। খাঁচায় থাকলে মরে যাইবো।“
অবাক হয়ে তাকালো হামিদ স্ত্রীর এই কথা শুনে। মাত্র এক সন্ধ্যা আগেও এই নবোঢ়া পাখির খাঁচাটা নেয়ার জন্য উঠানে শুয়ে পড়েছিল বিদায়ের বেলায়। অথচ এত অল্প সময়েই পাখিগুলোকে ছেড়ে দিতে বলছে?
“কি হইল? ছাড়বেন না?” ফারজানা অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞেস করে।
হামিদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিয়ে পাখিগুলোকে একটা একটা করে বের করে দিতে থাকে রাতের অন্ধকারে। বৃষ্টির মাঝে ডানা ঝাপ্টে উড়ে যেতে থাকে সবাই। হয়তো বা কোনো বিদ্যুতহীন কারেন্টের খুঁটির তারে বসে কৌতুহলী দৃষ্টিতে কোনো পাখি তাকিয়ে থাকে ভ্যানে করে ছাতার আড়ালে চলে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে।
ফারজানার পেটের চাপ চাপ ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে। শ্যাওলা, কাঁদা মাখা আশঁটে একটা গন্ধে নাক ভারি হতে শুরু করেছে...... ছোপ ছোপ রক্ত আর নখের গভীর এই দাগগুলো কিসের?

পরের অংশ আরজি - (কৃষ্ণপক্ষি)

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১২:২২
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×