somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আরজি - (কৃষ্ণপক্ষি)

২৫ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আরজি - (পূর্বাভাস) এরপর

“আরে! এইটা রেডিও না?” উৎফুল্ল গলায় জিজ্ঞেস করে ফারজানা।
হামিদ খানিকটা অবাক মুখে তাকালো স্ত্রীর দিকে। বিয়ে করে এনেছে চারদিন হয়ে গেল। এ কয়দিন নিজের ঘরে বিছানাতেই পড়েছিল অসুস্থ হয়ে। জ্বর, পেটে ব্যাথা। কাঁথা মুড়ি দিয়ে হু হু করে কেঁপেছে। সম্ভবত সেদিনের বৃষ্টিতে ভেজার কারণে এত জ্বর। হামিদ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। বিয়ে করে আনার পর অভাবের ঘরে অসুস্থ নতুন বৌকে কীভাবে দেখে রাখবে বুঝে পাচ্ছিল না। বাবা মারা গেছে বছর চারেক হচ্ছে। মা আর ছোট বোন আছে। আর কেউ নেই। আত্মীয় স্বজনের বাড়ি দূরে দূরে। সেমি পাকা বাড়ি, ওপরে টিনের চাল, পাশে বাঁশের চাটাইয়ের দেয়াল। আঙিনা ভর্তি গাছপালা আর বিভিন্ন সব্জির ক্ষেত। সামনের পুকুর। বর্ষার কারণে পানি পাড় আর উঠানে চলে এসেছে বিঘত খানেক। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে হাঁটা চলা বন্ধ হয়ে যাবে। বন্যা হতে দেরি নেই। বাড়ির নতুন বৌ দেখতে ছাতা হাতে অন্যান্য বাড়ির মহিলারা এসেছে সেই টাখনু সমান পানি মাড়িয়ে। কিন্তু জ্বরে বিধ্বস্ত বৌ দেখে বেজার মুখে চলে গেছে। কেউ কেউ বা আঙ্গিনায় তাড়াহুড়ো করে বৌ দেখতে এসে আছাড়ও খেয়েছে ধপাস – ঝপাস শব্দে। তাও বৌ দেখার উৎসাহে কারো ভাঁটা পড়েনি। বর্ষার পানির মতোই তাদের উৎসাহ বেড়েই গেছে।
এদিকে ফারজানার জ্বর কমেছে মাত্র আজ সকালে। বিছানা থেকে নেমে হেঁটে বেড়াতে পারছে নিজে থেকেই। সাহায্য লাগছে না কারো। হামিদের ছোট বোনটার নাম আয়েশা। বয়সে ফারজানার চেয়ে অনেক ছোট। সাত আট হবে বয়স। এই কয়েকটা দিন শয্যাশায়ী ফারজানার কথা বলার একমাত্র সঙ্গী ছিল এই মেয়েটা। ভীষণ চটপটে। টুকটুক করে সারাক্ষণ ওর সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। হামিদের ঠিক উলটো, হামিদ একেবারেই কথা বলে না। অন্যদিকে তার বোন আয়েশা কথার গাছ। সারাক্ষণ সেই গাছ থেকে কথার পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে।
শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে আজকেই প্রথম হামিদের মায়ের ঘরে গিয়েছিল ফারজানা। প্রথম রাতেও এসেছিল, কিন্তু নতুন বৌ ঘোরের কারণে হিসেবে গৃহপ্রবেশের কিছুই মনে নেই। ফারজানার শাশুড়ি সুফিয়া বেগম শক্ত স্বামর্থ মহিলা। এই বৃষ্টির মাঝে ভিজে ভিজে ক্ষেতের সবজি তুলে জড়ো করে রাখছেন ঘরের ভেতর। পানিতে ডুবে নয়ত পঁচে যাবে। এরমধ্যেই কুমড়া, বেগুন, ঢেঁড়স, পুঁইশাকের ক্ষেতে পানি এসে জমে গেছে। বিঘত খানেক ঘোলাটে ময়লা পানি। পুকুরের পাড় উপচে গেছে পানি। বাড়ছে ধীরে ধীরে। বৃষ্টি একটানা অক্লান্ত ভাবে ঝরেই যাচ্ছে। ঝম ঝম করে চালে সেতার বাজছে। মাত্র বেলা দশটা এগারোটা হবে। কিন্তু বাহিরের আলো দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। টিনের চাল ছাড়াও আম, কাঁঠাল সমস্ত গাছের পাতার শব্দও হচ্ছে ভীষণ। বাতাস হচ্ছে হু হু করে।
সুফিয়া বেগম প্রবল বৃষ্টিতে মাথাল দিয়ে ভিজে ভিজে এসব তুলে আনছিলেন ঘরের ভেতর। শোবার বিছানার নিচে এনে সব জড়ো করে রাখছিলেন। প্লাস্টিকের বস্তা মাথায় এবং কাঁধে বেঁধে হামিদও মাকে সাহায্য করছিল। লুঙ্গি হাঁটু অবধি কাছা মেরে নিয়েছে। দুজনেই পালাক্রমে বাহিরে গিয়ে সব সবজি তুলে এনে রাখবে ভেতরে। ফারজানা সে সময়েই আয়েশাকে সাথে নিয়ে প্রথম গেল শাশুড়ির ঘরে। বিদ্যুৎ নেই। ঘরে আলো কম। প্রথম রাতে সে ভাবে ভাল করে দেখেনি, আজ দেখলো। জানালা বন্ধ। খোলা দরজা দিয়ে যা আলো আসছে, সে আলোতেই আগ্রহ নিয়ে সব দেখতে থাকে ফারজানা। টিনের চালের নিচে বাঁশের চাটাই দিয়ে এই বাড়ির সিলিং দেয়া। ওপরের সেই বাঁশের সিলিং থেকে তাকের মতো দড়ি দিয়ে ঝোলানো আছে। বিভিন্ন ধরণের বিস্কুটের বোয়ম, শিশি বোতল, হারিকেন রাখা সেই ঝুলন্ত তাকে। বিছানার একপাশে পর্দা ফেলে রাখা হয়েছে একটা পুরনো আমলের ড্রেসিং টেবিল। আয়নাটা পর্দার এক ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে। একটা সেগুনের ওয়ারড্রোব আর একটা আলনা। ছোট একটা কুসিকাঁটার কাজ করা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা ছিল রেডিওটা। কৌতুহলী মুখে ফারজানা ঢাকনাটা সরাতেই পুরনো রেডিওটা বেরিয়ে এলো। Vintage রেডিও এবং ক্যাসেট প্লেয়ার। টুইন ওয়ানের একদম শুরুর দিকের ভার্সন। ক্যাসেট বসানোর ঘরও আছে। রেকর্ড করা যায়।
ফারজানাদের বাড়িতে টিভি, ক্যাসেট ছিল না। বান্ধবির বাড়িতে একবার টিভিতে ওয়াসিম আর অঞ্জুর একটা বাংলা সিনেমা দেখেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে। সেটা ধরা পড়ে যাবার পর আব্বা আর আম্মার হাতে তুমুল মার খেয়েছিল। সেই বান্ধবির বাড়িতে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়া হয়। ফারজানার সে বান্ধবির ঘরে এরকম একটা টুইনওয়ান ছিল। ক্যাসেট দিলে গান শোনা যেত, আবার বাংলাদেশ বেতারও শোনা যেত।
শ্বশুরবাড়ি এসে হঠাৎ পর্দায় ঢাকা এই টুইনওয়ান দেখে তাই অদ্ভুত একটা খুশিতে মূহুর্তেই ভরে উঠল ভেতরটা। উৎসুক চোখে হামিদের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “এইটা রেডিও না?”
হামিদ উত্তর দেয়ার আগেই বাহির থেকে একটা টুকরিতে বেশ কিছু বেগুন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন সুফিয়া বেগম। তিনি ফারজানাকে টুইনওয়ান নিয়ে জিজ্ঞেস করতে দেখে আপনা থেকে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, কেসেটও চলে। তোমার শ্বশুর আব্বা শখ করে মিডিলিস্ট থেইকা আনছিল। ব্যাটারি দিয়া চলে। আগে তো চিঠি পত্র দিয়া কথা চালা চালি করতে অসুবিধা লাগত; এইজন্য রেকর্ড করে কেসেট পাঠায় দিত গ্রামের কেউ বিদেশ থেকে আসলে- তারে দিয়া। তোমার শ্বশুর আব্বার রেকর্ড করা অনেকগুলা কেসেট আছে ট্রাঙ্কে। মানুষটা নাই, কিন্তু তার কথা বার্তা রেকর্ড হইয়া আছে... মাঝে মাঝে সংবাদ শুনার জন্যও চালাই। শুনলে নেও না? ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে বেটারি আছি। লাগায় চালাও। খুঁজলে দুয়েকটা সিনেমার কেসেটও পাবা, বেদের মেয়ে জ্যোছনার কেসেট ছিল। আমি কাজ শেষ করলে ট্রাঙ্ক থেকে ক্যাসেট বাইর করে দিমু, তোমার শ্বশুরের কথাও শুনতে পারবা।“
ফারজানা অবাক দৃষ্টিতে তাকালো শাশুড়ির দিকে। এত সহজে তিনি রেডিও-ক্যাসেট শোনার কথা বলে ফেলবেন একদমই আশা করেনি। হামিদও কিছু মানা করল না, ইঙ্গিতে আয়েশাকে বলল, “বেটারি খুঁজে লাগায়া দে তোর ভাবীরে। গান হইলে আওয়াজ কমায় দিস।“ বলে বৃষ্টির মাঝে বেরিয়ে গেল কুমড়া নিয়ে আসতে।
আয়েশা তড়িৎ গতিতে ছুটে গিয়ে প্রথমে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে ব্যাটারি নিয়ে নিল। তারপর ওয়ারড্রব এর ওপর থেকে ভারি টুইনওয়ানটা সাবধানে পেড়ে আনলো। বিছানায় রেখে চারটা মোটা সাইজের ব্যাটারি পুরে অন করে দিল। শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে। সেন্টার খোলেনি, নাকি বেতার তরঙ্গের সমস্যা হচ্ছে আবহাওয়ার কারণে বোঝা যাচ্ছে না। তবে ভাষা ভাষা ভাবে কথা শোনা যায়। বাংলাদেশ বেতার নাকি অন্য কোনো চ্যানেল কে জানে। ভেতরে ক্যাসেট নেই। সুফিয়া বেগম আসুক, ক্যাসেট তখন নেয়া যাবে। আপাতত বেতার কেন্দ্র ধরানো যাক।
প্রায় আড়াই কেজি ওজনের টুইনওয়ানটা হাতে নিয়ে ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ফারজানা এন্টেনা লম্বা করে চ্যানেল ধরানোর চেষ্টা করতে লাগল। আয়েশা ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে সেই ড্রয়ারটা থেকে স্নো পাউডার বের করে মুখে দিতে থাকে, আর খিল খিল করে হাসতে থাকে একা একা শিশু সুলভ প্রগলভতায়। আয়নার ওপরে যে পর্দাটা ছিল এক কাঁত হয়ে- সেটাকে আরো টেনে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে আয়নায়।
আয়নার মুখোমুখি ঘরের অন্যপাশে দরজাটা, ওটা দিয়েই হামিদ আর সুফিয়া বেগম ঘন ঘন বাহিরে আসা যাওয়া করছে। রেডিও হাতে ফারজানা পায়ের ভার বদল করতে করতে চ্যানেল বদলাচ্ছে। লাভ হচ্ছে না খুব একটা। আয়েশা হাসতেই আছে শব্দ করে, এত বৃষ্টির মাঝেও সেই হাসির শব্দে ঘরটা ভরে গেছে।
হঠাৎ আয়েশার দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ল আয়নাটার ওপর। মুখোমুখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্নো পাউডার লাগাতে থাকা আয়েশার প্রতিবিম্ব পড়েছে ঠিকই। কিন্তু এত বিশাল আয়নায় খানিক পেছনে রেডিও হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফারজানার কোনো প্রতিচ্ছবি পড়েনি! আশ্চর্য তো! আয়নার হিসাবের চেয়েও বাহিরে হয়তো সে দাঁড়িয়ে আছে। রেডিও হাতে নিয়ে সামান্য নড়ে আয়না বরাবর আয়েশার পেছনে এসে দাঁড়ালো ফারজানা, ভেতরে ঈষৎ সংশয়-দ্বিধা।
শীতল রক্তের স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ডের ওপর দিয়ে। আয়েশার পেছনে সরাসরি দরজাটা দেখা যাচ্ছে, হামিদ আর সুফিয়া বেগম বাহিরে থেকে এসে এসে সবজি রেখে যাচ্ছে...... অথচ ফারজানা আয়নায় নেই...
শোঁ শোঁ করতে থাকা রেডিওটার মাঝ দিয়ে ঝড়ের মাঝে ভেসে এলো করুণ একটা শিশু কণ্ঠ, “ম-মা-আ-আ-আ, ম-ম-আ-আ-আ...”
চমকে নিজের হাতে ধরে থাকা টুইনওয়ানটার দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় ফারজানা। এটার ভেতর থেকে কণ্ঠটা ভেসে আসছে! পুরো রেডিও সেটটা থেকে কেমন আঁশটে, কাঁদা আর বিকট গন্ধ বের হচ্ছে... হাত থেকে রেডিওটা ফেলে দিতে দিতে কোনোমতে বিছানার ওপর এনে ছেড়ে দিল অচ্ছুৎ এক ভয়ে। পিছিয়ে গেল দুই পা। ধপ করে ভোঁতা শব্দে রেডিওটা বিছানায় পড়ার শব্দে আয়েশা অবাক হয়ে ফিরে তাকালো ভাবীর দিকে, “কী হইল ভাবী? গান আসে না? আম্মা আইসা কেসেট বাইর করে দিলে গান শুনামু। ভাবিও না।”
ভয়ার্ত মুখে আয়েশার দিকে তাকালো ফারজানা। মুখে পাউডার মেরে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আয়েশা। ওর প্রতিবিম্ব পরেছে আয়নার, ফারজানার প্রতিবিম্ব পড়েছে। যেমনটা হওয়ার কথা। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে ফারজানার। ভুল দেখেছে? এরকম ভুল কেন হবে?
“কী হইছে ভাবী? শরীর খারাপ লাগতেছে? এরকুম লাগতেছে ক্যান তোমারে?” আয়েশা জিজ্ঞেস করল।
ফারজানা হঠাৎ করেই নাভির চারপাশে তীব্র একটা কাঁচা ব্যথা অনুভব করতে থাকে। শাড়ির আড়ালে পেটের কাছে লুকিয়ে থাকা গভীর নখের দাগগুলো দিয়ে তাজা জখমের ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। আয়েশার কথার উত্তর না দিয়ে দ্রুত পা ফেলে ঘরটা থেকে পাশের ঘরে চলে আসে ফারজানা। একরকম দৌড়িয়েই এলো। ডান হাতটা নাভির কাছে ধরা মাত্র আঠা আঠা রক্তের স্পর্শ্ব পেল... ঠিক সেই রাতের মতো। শুকিয়ে যাওয়া ঘাঁ গুলো আবার জেগে উঠেছে অজ্ঞাত কোনো কারণে। অসহ্য একটা যন্ত্রণায় হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ল ঠাণ্ডা মেঝেতে।
ঘরের জানালার পাল্লা খোলা, বাতাসে ভেজা পর্দাটা উড়ছে। বাহিরের বৃষ্টির ছটা ভেতরেও আছে, সাথে ওপাশের পেঁপে গাছের পাতা জানালার শিকে এসে লেগেছে। একটা সবুজ রঙা পাখি এসে জানালায় বসেছে। মেঝেতে বসে চাপা স্বরে কাতরাতে থাকা ফারজানার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ফারজানা জানালার দিকে তাকাতেই যন্ত্রণার মাঝেও খানিকটা বিস্মিত হল। বসন্তবৌরি এসে বসেছে। ঠিক তার পাখিগুলোর মতো অবিকল একটা।
চালের ওপর ঝম ঝম শব্দের মাঝেও বহু দূরে থেকে ভেসে এলো কাতর একটা শিশু কণ্ঠ, “ম-মা-আ-আ-আ...” সঙ্গে সঙ্গে নাভিসহ ভেতরটা কেউ ধারালো শ্বাপদের নখ ঢুকিয়ে চিড়ে দিল! অসহনীয় একটা ব্যথায় চোখে পানি চলে এলো মুহূর্তের মধ্যে। দম বেরিয়ে গেছে, কিন্তু নিতে পারছে না আর। মনে হচ্ছে গভীর কোনো হাওড়ের নিচে কিংবা পুকুরের ভেতর ডুব দিয়েছে। পানির ওপরে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে। কিন্তু মাথা তুলতে পারছে না। বুকের পাজরের ভেতর ফুসফুসটা বাতাসের জন্য আইঠাই করছে। অথচ কোনো শক্তি কাজ করছে না আর... এইঘরের খোলা দরজাটা দিয়ে বারান্দা দেখা যাচ্ছে। পানি বারান্দা ছুঁয়ে ফেলেছে। পুকুর, উঠান- সব সমান। পানি আর পানি। ফারজানার মনে হতে থাকে বহুদূর হতে পানির নিচ থেকে কেউ ডাকছে তাকে, এই বারান্দা পর্যন্ত উঠে আসা পানিতে তার হাত ছোঁয়াতেই হবে। নাহলে বাঁচতে পারবে না। দম নিতে পারবে না আর।
বিচিত্র কোনো এক তাগিদে ফুরিয়ে আসা শক্তি নিয়ে পাগলের মতো নিজেকে হেঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে গেল। লম্বা হয়ে শুয়ে রক্ত লেগে থাকা ডান হাতের কবজিটা বারান্দার বাহিরের সেই হাঁটু অবধি উঠে আসা পানিতে ডুবিয়ে দিল...
সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে পারল চুপসে যাওয়া ফুসফুস দুটোয়! হা করে চিত হয়ে শব্দ করে নিঃশ্বাস নিতে থাকে ফারজানা বুভুক্ষের মতো। পেট খামচে আসা কাঁচা যন্ত্রণাটা আচমকাই ছেড়ে চলে যায়... চোখ মুদে আসে ধীরে ধীরে।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
“বৌ? আঁচলটা সরাও ত।” সন্দিগ্ধ গলায় বললেন সুফিয়া বেগম।
বিছানায় শুয়ে আছে ফারজানা। খানিক আগে কি হয়েছে বলতে পারে না। সুফিয়া বেগম সবজি টানা টানি করতে করতে আবিষ্কার করেছেন পাশের ঘরের বারান্দায় পানিতে হাত ডুবিয়ে অদ্ভুত ভাবে নতুন বৌ শুয়ে আছে। পড়ে থাকার ধরণটা ভাল না। ছুটে এসে ছেলের সাহায্য ছাড়াই ফারজানাকে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। হামিদ কবিরাজ ডাকতে বেরিয়ে গেছে অথৈ পানির মাঝ দিয়ে। আয়েশা পাউডার, লিপস্টিক দিয়ে সেজে বোকা বোকা মুখে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সুফিয়া বেগম ইশারায় মেয়েকে বললেন পাশের ঘরে চলে যেতে। একা থাকতে চাচ্ছেন ফারজানার সাথে। ইচ্ছা না থাকা শর্ত্বেও আয়েশা পাশের ঘরে চলে গেল।
ফারজানার হুশ ফিরেছে একটু আগে। ব্লাউজ, শাড়ির আচঁল সব ভেজা। বারান্দার বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সব। ঠাণ্ডা লাগছে। ওকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার সময় পেটের কাছ থেকে কাপড় সরে গিয়েছিল, সুফিয়া বেগম অসংখ্য দাগ দেখেছেন। কাঁচা দাগ। সে কারণেই বললেন কথাটা।
ফারজানা পিটপিট করে তাকালো প্রথমে।
“কথা বুঝো নাই? বললাম যে পেটের কাছ থেইকা কাপড়টা সরাও।“ খানিকটা কঠিন গলায় বললেন।
ফারজানা যন্ত্রের মতো কাপড় সরায়।
সুফিয়া বেগম তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন দাগগুলোর দিকে। ফারজানার পেটে নাভিকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কাটা ছেঁড়ার কাঁচা দাগ, কেন্দ্রে রীতিমত কালচে রক্ত জমে উঠেছে গভীর একটা জখমের কারণে।
বরফ শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “হামিদ করছে এইগুলা? সত্যি কইরা বলবা। আমার কাছে শরমের কিছু নাই।”
কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল ফারজানার মুখ, “ন-না আম্মা! উ-উনি কিছু করেন নাই। আমাকে ছোঁয়ও নাই।“
“তাইলে? কখন হইছে এইসব?” অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞেস করেন, “বিয়ের আগের দিন?” কণ্ঠে ক্ষীণ সন্দেহ। যেহেতু বেয়াইনবাড়ির সবাই এক বেলাতেই ছেলের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন, ছেলের ঘর বাড়ি দেখতে না এসেই- মেয়ের কোনো গভীর সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক না। “তোমার আম্মা জানে?”
“ব-বিয়ের রাতে হাওড় দিয়ে আসার সময় কীভাবে জানি এইগুলা হইছে। আমি ঘুমায় ছিলাম...” বলতে গিয়ে ফুপিয়ে ওঠে ফারজানা। “আমার কাছে কেউ আসতে চায় আম্মা। আমাকে অনেক দূর থেইকা মা মা বলে ডাকতে থাকে...” সে রাতের পুরো ঘটনা বলতে থাকে সুফিয়া বেগমকে। সেই সাথে আজকের ব্যাপারটাও।
সুফিয়া বেগম শক্ত মানুষ। পুরো ঘটনা মন দিয়ে শুনলেন ফারজানার পাশে বসে বসে। তারপর দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপচাপ জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রইলেন, বৃষ্টি দেখছেন না মেঘলা আকাশ- বোঝা গেল না। কিছু একটা গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে তাঁকে।
থেকে থেকে ফোঁপাচ্ছে ফারজানা। জ্বর এসে গেছে মেয়েটার। ভেজা কাপড়ে রাখা ঠিক হবে না। সুফিয়া বেগম ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বৌয়ের কাপড় বদলে নিতে সাহায্য করলেন। এর মাঝেও কেঁদে যাচ্ছে ফারজানা। হয়তো গত চারদিনের জমে থাকা চাপা ভয় আজকে বের করার সুযোগ পেয়েছে। কাউকে কিছু বলার পাচ্ছিল না। নিজের মাকে যেভাবে সবকিছু খুলে বলত, আজ সুফিয়া বেগমকে ঠিক তেমনটাই বলেছে। অথচ কিছু আগেও তাঁর সঙ্গে অনেক দূরত্বের সম্পর্ক ছিল।
“আম্মা আম্মা? দেখছেন? একটা পাখি মইরা পড়ে আছে ঘরের ভিতর!” পাশের ঘরের দরজা থেকে উঁকি দিল আয়েশা। একটা হাতে সে দুই আঙ্গুল দিয়ে মড়া পাখিটার ডানা ধরে রেখেছে। ডানা ছড়িয়ে গেছে, পা বাঁকা হয়ে ঝুলছে। নিষ্প্রাণ। ফারজানার খানিক আগের দেখা বসন্তবৌরি পাখিটা। নাকি অন্য আরেকটা?
সঙ্গে সঙ্গে হাত খামচে ধরল শাশুড়ির, চাপা স্বরে আতংকিত মুখে বলল, “আম্মা, সেই রাতেও আমাদের একটা পাখি মারা গেছিল! আমি আটটা পাখি নিয়াসছিলাম। একটা মরে গেছে দেখে বাকিগুলা ছাড়ে দিছিলাম ভ্যানে করে আসতে আসতে।”
সুফিয়া বেগম নিরুত্তর। গম্ভীর হয়ে গেলেন।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
হামিদ কবিরাজ মশাইকে নিয়ে চলে এসেছে। এই বর্ষায় পানি ভেঙ্গে আসা সম্ভব ছিল না আশি উর্ধ্ব কবিরাজ মশাইয়ের। হামিদ নিজে একটা ভ্যানে করে টেনে এনেছে বুড়ো কবিরাজ সুনির্মল দত্তকে। এই গ্রামে এমবিবিএস ডাক্তার নেই। গত প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে সুনির্মল দত্তই চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন গ্রামের লোকজনকে। বংশানুক্রমিক ভাবেই কবিরাজ তাঁরা। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও এই হাওড়বেস্টিত এলাকাগুলোয় চিকিৎসা দিতেন।
ফারজানাকে বেশ ভাল করে দেখলেন। নাড়ি দেখলেন, রক্তচাপ মাপলেন, চোখ দেখলেন। সব দেখে খানিকটা বিস্মিত দৃষ্টিতে চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন ফারজানার দিকে, “কি সমস্যা তোমার?”
সাদা চুল দাড়িতে একেবারে রবীন্দ্রনাথ লাগে দেখতে তাঁকে। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন রবীবাবুর মতোই। তবে ইয়া মোটাসোটা রবীন্দ্রনাথ। কারণ তাকে ভ্যানে করে টেনে আনতে গিয়ে ভ্যানওয়ানা ছোকড়া এবং হামিদ দুজনেই কাবু হয়ে গেছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে ভ্যান নয়, জাহাজ টেনে এনেছে। এত ওজন নিয়ে ভ্যান পানির ওপর দিয়ে ঠেলে আনার সময় দুইজনেরই মনে হয়েছে- লাঙ্গল খালি হাতেই জমি চাষ দিয়ে দেয়া ঢের সহজ সুনির্মল দত্তকে টানার চাইতে! এখন পাশের বারান্দায় বেঞ্চে বসে লেবুর শরবত খাচ্ছে ভ্যানওয়ালা, আয়েশা বানিয়ে দিয়েছে। আর হামিদ গ্লাস হাতে কোনায় একটা মোড়া নিয়ে বসে আছে। ঘামছে এখনো দর দর করে, অথচ ঠাণ্ডা আবহাওয়া।
ফারজানা কবিরাজ দাদুর প্রশ্নটা শুনে সুফিয়া বেগমের দিকে তাকালো অসহায়ের মতো। ঘরে হামিদও আছে। এই অল্প কদিনের সংসারে তার সাথে ফারজানা ভালমত কথাই বলতে পারেনি মন খুলে। পেটের দাগগুলোর ব্যাপারে হামিদ এখনো কিছুই জানে না। ভীষণ লজ্জ্বাও লাগছে। লাল হয়ে গেছে চেহারা। সুফিয়া বেগম মুখের ওপর আঁচল টেনে ধরেছিলেন। ফারজানাকে “কী হয়েছে” প্রশ্ন করতে দেখে শান্ত গলায় বৌমাকে বললেন, “সমস্যা নাই, উনি আমাদের মুরুব্বী, আসল সমস্যাটা দেখাও।”
“সেকি? আসল সমস্যাও আছে নাকি? এতক্ষণ দেখায়নি?” কৌতূহলী গলায় বললেন সুনির্মল দত্ত।
ফারজানা পা লম্বা করে বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিল। শ্বাশুড়ির কথা অস্বস্তি নিয়ে হাত দিয়ে পেটের কাপড় সরালো। “দাদাজান, আমারে কিছু একটা খামচায় পেট ছিঁড়ে ফেলতে চায়। যেইদিন হাওড় দিয়া প্রথম এই গ্রামে আসতেছিলাম, সে সময় পানির ভিতর থেকে কিছু একটা উঠে আসছিল...”
মোড়ায় বসে থাকা লেবু শরবত খেতে থাকা হামিদ বিষম খেলো। চোখ বড় বড় করে তাকালো, “এ-এইসব কি! কখন হইছে এইটা? আমাকে বলো নাই ক্যান?” এক সাথে হড়বড়িয়ে প্রশ্নগুলো করলো উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে। এগিয়ে এসেছে বিছানার কাছে। চোখে মুখে ভয়ের স্পষ্ট চিহ্ন। মাত্র বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যেই স্ত্রীর এরকম একটা ব্যাপার...
সুনির্মল দত্ত ফারজানার পেটের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠেছিলেন, বিড়বিড় করে কিছু একটা মন্ত্র জাতীয় জপলেন মনে হল। কেমন যেন ভীত দেখালো তাঁকে।
ফারজানা সেই রাতের ঘটনা বলার জন্য মুখে খুলেছিল, কিন্তু তার আগেই সুনির্মল দত্ত শুকনো গলায় বলল, “জিনিসটা তোমার কাছে কয়বার আসছে এখন পর্যন্ত?” কোনো রকম ভূমিকা, বর্ণনা বা কীভাবে এই দাগ হলো জানতেও চাইলেন না।
ফারজানা আর সুফিয়া বেগম মুখ চাওয়া চাওয়ি করল একে অন্যের। হামিদ পুরোপুরি অন্ধকারে। তাকে অন্ধকারে রেখেই ইতস্তত গলায় ফারজানা জানালো, “একবার তো নৌকায় স্বপ্নে দেখছি। কারণ আমার স্বামী কিংবা মাঝি চাচা কেউ জিনিসটারে দেখে নাই। আর আজকে জিনিসটার গলা শুনতে পাইছি আবার। পুকুরের পানি উঠানে উঠে আসার পর মনে হইতেছিল পানির ভিতর অনেক দূর থেইকা ডাকতেছে আমারে।”
স্থাণুর মতো ঝিম মেরে বসে রইলেন সুনির্মল দত্ত চেয়ারটায়। ফারজানা, সুফিয়া বেগম উভয়েই গভীর জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে কবিরাজের দিকে। হামিদ তিনজনের মুখের দিকেই তাকাচ্ছে। কিছুই বুঝতে পারছে না ঘটনার আগা মাথা। আয়েশা দরজার কাছ থেকে উঁকি দিয়ে চুরি করে শোনার চেষ্টা করছে কথাগুলো। তার এইঘরে আসতে মানা করেছেন সুফিয়া।
“কাকা? কী হইছে আসলে? বৌমা যেইটার কথা বলতেছে- সত্যি আছে এইরকম কিছু? পানির মধ্যে?” সুফিয়া বেগম জানতে চান।
“জিনিসটা তো ভাল নারে মা।“ সুফিয়ার উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন সুনির্মল দত্ত। “বহুকাল আগে আমার ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলাম কৃষ্ণপক্ষির কথা। সেইটাও রূপকথার মতো। সত্যি কিনা কেউ জানতো না। নতুন গিন্নীর কথা শুনে তো মনে হয় এইটা কৃষ্ণপক্ষি। হাওড়ের সন্তান।“
বিমূঢ়ের মতো তাকালো ফারজানা, “ক-কি বললেন দাদাজান? কৃষ্ণপক্ষি? মানে পাখি?”
“হুম। পানির পাখি। অন্ধকারের পানির পাখি। কিন্তু এইসব বইপত্রের মাঝে লেখা আছে, বাস্তব কোনো প্রমাণ নাই। বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা দেওয়া আছে। জার্মানদের দেশে নিকর, ডাচদের দেশে কেলপি, চীন-জাপানে কাপ্পা নামে ডাকে। ঠাকুরদার মুখে এসবের কত গল্প যে শুনেছি। আমাদের হাওড় বাওড়, নদী বা সাগরে কেউ ডাকে জলদানব, কেউ ডাকে “দেও”। কৃষ্ণপক্ষি নামটা ঠাকুরদার মুখে শোনা। ব্রিটিশ প্রিয়ডে একবার এক মেম বেড়াতে এসেছিল এইদিকের হাওড়ে। পূর্ণিমা দেখার জন্য বজরা ভাড়া করে এনেছিল। সাথে ছিল সাহেব। বহু আগের কথা, ভাল করে মনে নাই ঘটনাটা। তবে এটা খেয়াল আছে, ঠাকুরদা বলেছিল পোয়াতি ছিল মেমটা। মাঝদড়িয়ায় প্রসব ব্যথা উঠেছিল। কিন্তু একেবারে অসময়ে। ডাঙ্গায় যাওয়ার সময় পর্যন্ত হাতে ছিল না। তবে নার্স ছিল। সেই’ই ব্যাবস্থা নিল যা করার। লাভ হয়নি। মরা বাচ্চা হয়েছে। ওদিকে রক্ত পড়া থামছে না মেমের। সাহেবের সাথে কথা বলে বাচ্চাটার লাশ হাওড়ে ফেলে দিয়েছিল মেমের হুশ ফেরার আগেই।
অসুস্থ মেমকে মুমুর্ষূ অবস্থায় নিয়ে ডাঙ্গার দিকে বজরা রওনা দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার ডাঙ্গার দিকে পৌঁছানোর খানিক আগেই জেগে ওঠে মেম। কাতর হয়ে বলতে থাকে তার বাচ্চাটা তার কাছে ছুটে আসছে পানির মাঝ দিয়ে। বজরা থামাতে বলতে থাকে চিৎকার দিয়ে।
সাহেব, নার্স সহ বাকিরা সবাই অবাক। মেম জানলো কী করে যে বাচ্চাটাকে হাওড়ে ফেলে দিয়েছে তারা?” দম নেবার জন্য থামলেন সুনির্মল দত্ত। একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে গেছেন।
ফারজানার মুখ থেকে কথা সরে গেছে। হামিদ নির্বাক। সুফিয়া ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। “তারপর কী হইছে কাকা?”
“ভরা জ্যোৎস্না সেই সময়। মধ্য রাতে চাঁদের আলোয় সারা হাওড় জ্বল জ্বল করছিল। সুনসান নীরবতার মাঝে বজরায় মেমের চিৎকার করে বাচ্চার জন্য কান্না। সাহেব ভেবেছে জ্ঞান ফিরে বাচ্চা না দেখে শোকে প্রলাপ বকছে মেম। হঠাৎ বজরার দুই মাঝি বাহির থেকে চিল্লানো শুরু করে দেয়। কি হয়েছে দেখার জন্য সাহেব বিদ্যুতের বেগে বেরিয়ে আসে খোলা ডেকে। মেঘহীন আকাশ থেকে থপ থপ করে কি যেন পড়ছে বরজার ওপর। পাখি... ঝাঁকে ঝাঁকে মরা পাখি বরজার ডেকে, ছাদে, আশেপাশের পানিতে থপ থপ করে পড়তে শুরু করেছে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো!
সাহেব হতভম্ব। কাউকে কিছু বলার আগেই পুরো বজরা সুদ্ধ ভীষণ একটা ধাক্কায় দুলে উঠল। ভেতরের প্রত্যেকটা মানুষ ছিটকে গেল একেক দিকে। দুই মাঝিও সতর্ক না থাকায় কিনার থেকে হাওড়ের পানিতে উলটে পড়ে গেল। কেবল সাহেব ছাদের কিনার খামচে ধরে পতন ঠেকালো। পুরো বজরাটাকে ঘিরে নিচে পানিতে কিছু একটা চক্কর দিচ্ছে। মাঝিরা উঠতে পারলো না। কিছু একটা বা একাধিক জলজ প্রাণি মাঝি দুজনকেই টেনে ডুবিয়ে দিল পানির নিচে। তারপরেই পানি থেকে রীতিমত উড়াল দিয়ে ছোট্ট একটা শিশুর আকৃতির, অন্ধকার জিনিস বজরার ডেকের ওপর এসে পড়ল! চাঁদের আলোয় কেবল অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। পশুর মতো ঝুঁকে আছে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে। সাহেব ভয়ে চেঁচাতেও ভুলে গেছে জিনিসটা দেখে। বজরার ভেতর থেকে মেম কাঁদছে। এদিকে ছাদে বসা জিনিসটা শিশুর কান্নার মতো করছিল।” আবার থামলেন। দ্রুত হাঁপিয়ে যাচ্ছে তিনি। “পানি খাওয়াও আমাকে।” আয়েশা ফুড়ুৎ করে এক দৌড়ে পানি নিয়ে এলো। সুফিয়া বেগম চোখ পাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়ে যে আড়ি পেতে সব শুনছিল বোঝা যাচ্ছে।
ঢক ঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার বলা শুরু করলেন, “সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্ধকার জিনিসটা লাফিয়ে লাফিয়ে এক ছুটে বজরার ভেতরে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল নারকীয় চিৎকার, চেঁচামেচি। নার্স, মেম আর একটা মেইড ছিল। পরিচারিকা আরকি। সবাই মরণ চিৎকার দিয়েছে। সাহেব পিস্তল খুঁজে বের করে ভেতরে ঢুকে তাজ্জ্বব বনে গেল। ভেতরে কোনো বাতি জ্বলছে না। সব নিভে গেছে। একটা কুপি, মোম বা হারিকেন কিছুই না। তবে বাহির থেকে আসা চাঁদের নীলচে আলো দরজা এবং জানালা দিয়ে যতটুকু আসছে- তাতে দেখা যাচ্ছিল, নার্স, মেইড এবং মেম তিন জনেই দেয়াল ঘেষে পড়ে রয়েছে। তিনজনের পেট থেকে কালচে রক্ত এসে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। নার্সের পেট থেকে ভেতরের “অর্গান”সহ বেরিয়ে এসেছে... মারা গেছে তিন জনেই। অন্ধকার জিনিসটাকে মেমের পেটের কাছে গুটি সুটি মেরে বসে থাকতে দেখা গেল। কাঁদছে।
সাহেব পিস্তল দিয়ে তাক করে সেই অন্ধকার জিনিসটাকে গুলি করার জন্য তোলা মাত্র দুলে উঠল পুরো বরজা আরেকবার। ছিটকে পড়ে গেল সাহেব। মেঝেতে উপুর হয়ে পড়েছে, হাত থেকে পিস্তলটা ছুটে যেতে যেতে ধরে ফেলল। ধপ ধপ করে সমস্ত বজরায় শব্দ করে পানি থেকে কিছু উঠে আসছে।
উপুর হয়ে মুখ তুলে তাকালো সাহেব, বরজার প্রতিটা জানালা, দরজায় সেই অন্ধকার শিশুর মতো জিনিসগুলো নানান বয়সের, নানান আকৃতির- এসে দাঁড়িয়েছে! সংখ্যায় অনেক। পানি ঝরছে প্রত্যেকের শরীর থেকে। নির্জীব। কোনো শব্দ নেই কোথাও, কেবল সাহেবের স্ত্রীর লাশের সামনে বসে থাকা ছোট্ট প্রাণিটা সদ্য জন্ম নেয়া মানব শিশুর মতো কাঁদছে...
দৃশ্যটা সাহেব আর সহ্য করতে পারলো না। গুলি করা শুরু করল প্রতিটা অন্ধকার অবয়বগুলোকে তাক করে। সাথে সাথে সব জিনিসগুলো ঝড়ের বেগে ছোটাছুটি আরাম্ভ করে দিল। সব তোলপাড় করে দিয়ে বাহিরে পানিতে ঝাপিয়ে পড়তে লাগে সব...
পানিতে ঝপাস ঝপাস করে শব্দ হতে থাকে। সাহেব বুঝতে পারে, জিনিসগুলো পালিয়েছে... মেমের লাশের সামনে থাকা সেই শিশু অন্ধকার প্রাণিটাও আর নেই...” চুপ হয়ে গেলেন।
“এরপর? এরপর কী হইল?” ফারজানা শুকনো কাঁঠ গলায় বলল। মুখ শুকিয়ে গেছে।
“এরপর বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ দিন পর পর হঠাৎ হঠাৎ হাওড়ে নৌকায় করে বাড়ি যাওয়ার কালে মেয়েরা নাকি শুনতে পেত, শিশুর মতো স্বরে মা মা করে কেউ ডাকে। হাওড়ে পাখি মরে ভাসতে থাকে তখন। কারো কারো নাভি ঘিরে গভীর জখম, রক্তের দাগ ফুটে উঠত। কেউ বা স্বপ্নে দেখতো পানির ভেতর থেকে ডাকছে তাকে কেউ। কিন্তু সবই শোনা কথা। নাম ধরে কেউ বলতে পারতো না এইসব কাল, পাত্র ঘটনা কবেকার, কোথাকার, কোন বাড়ির...... আজকেই প্রথম জানতে পারলাম, এতকাল মিথ্যা গল্প শুনিনি।“ সুনির্মল দত্ত অস্বস্তি মেশানো গলায় বললেন, “আমি জানি না কৃষ্ণপক্ষি তোমার কাছে কি চায়। কিন্তু সে যে আসছে, বা দুইবার তোমাকে ডেকেছে- এটা ভাল না। খুবই খারাপ।”
রক্ত সরে গেল ফারজানার মুখ থেকে, “আ-আমি কী করবো এখন তাইলে দাদাজান?”
সুনির্মল দত্ত অসহায় ভাবে মাথা নাড়লেন, “আমি শরীরের রোগের চিকিৎসা জানি রে গিন্নী। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সমাধান আমার জানা নাই। ভগবানের ইচ্ছা সব...”
শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফারজানা। হামিদ মূর্তির মতো বিছানার কাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সুফিয়া বেগম কথা খুঁজে পান না দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত। বাহিরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবকিছু। অসাড়।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
সেদিনের পর বিশ দিন কেটে গেছে। বন্যা হয়েছে আশেপাশের সব এলাকায়। হামিদদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত পানি উঠে এসেছে। খাট পালং, আলমারি সব ইট দিয়ে দিয়ে উঁচু করে রেখেছে। নৌকাও নিয়ে এসেছে। বারান্দার খুঁটির সাথে নৌকা বাঁধা। পানি উঠে গেলে স্ত্রী, মা, বোন নিয়ে নৌকায় উঠে যেতে হবে। সব ব্যাবস্থা নিয়ে ফেলেছে হামিদ। কড়িতকর্মা ছেলে। বাহিরে উঠান, পুকুর, রাস্তা ঘাট কিংবা ছড়া- হাওড় কোনো কিছুর আর সীমারেখা বোঝার উপায় নেই। সব ঘোলাটে, ময়লা পানির সমুদ্র।
খাবার পানির টিউবওয়েলও ডুবি ডুবি করছে। পরিষ্কার পানি আসছে না। বাথরুমেও পানি উঠে এসেছে। প্রাকৃতিক কাজ কর্ম সারার ব্যবস্থাও খুবই খারাপ পুরো গ্রামের জন্য। বাহিরে চুলা ডুবে গেছে। হামিদ বাজারে নৌকা নিয়ে গিয়ে স্টোভ আর কেরোসিন তেল কিনে এনেছিল। রান্না বান্না বারান্দায় করতে হচ্ছে।
বৃষ্টি থামার নাম নেই।
ফারজানাদের বাড়ির আশেপাশে এই কয়েক দিনে জমে থাকা পানির মাঝে প্রায়ই একটা দুটো বসন্তবৌরি পাখি মরে ভাসতে দেখা যায়। বাড়ির সবাই দেখেও না দেখার ভান করে। ফারজানা দেখে ফেলার আগেই বাঁশ দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেন সুফিয়া বেগম অথবা হামিদ। তাও হঠাৎ হঠাৎ ফারজানা দেখে ফেলে। কিন্তু আগের মতো এখন আর কেন জানি ভয় পায় না। কিংবা ভেতরে কি হচ্ছে বুঝতে দেয় না স্বামী বা শাশুড়িকে। আয়েশাকে তো অবশ্যই না।
পেটের ঘাঁয়ের জন্য দাওয়াই দিয়ে গিয়েছিলেন সুনির্মল দত্ত। সেগুলো খেয়েছে, পেটে লাগিয়েছেও। কিন্তু দগ দগে ঘাঁগুলো আশ্চর্যভাবে প্রতিরাতে তাজা হয়ে উঠতে থাকে আগের দিনের চাইতেও বেশি করে। ফারজানা বুঝতে দেয় না কাউকে। আচঁল দিয়ে ঢেকে রাখে। অসহ্য ব্যাথায় চোখ ফেটে কান্না আসলেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। কিন্তু পাশে ঘুমিয়ে থাকা হামিদকে জানতেও দেয় না।
হামিদ অবশ্য প্রতিরাতে ঘুমাবার আগে কিংবা ঘুম থেকে উঠে ভোরে ফারজানাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার শরীর ঠিক আছে তো? ব্যথা কমেছে?” অথবা নৌকা নিয়ে বাজারে গেলে আলাদা ভাবে পাঞ্জাবির পকেটে লুকিয়ে সন্দেশ নিয়ে আসে।
ফারজানার এই ক্ষুদ্র মমতা বড় ভাল লাগে। তাই হামিদকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে ইচ্ছে হয় না।
সুফিয়া বেগমকেও আর বলা হয় না প্রায় রাতে ঘুমের ভেতর ভয় পাবার কথাগুলো।
সেই জমাট অন্ধকার ছায়ামানব ফারজানার দুঃস্বপ্নে বহুদূর থেকে ডাকে কদিন পর পর। যতবার ডাকে, পেটের ঘাঁ গুলো তাজা হয়ে ওঠে। রক্ত বের হতে থাকে। ঘুম ভেঙ্গে গেলে মুখে হাত চেপে কাঁদতে থাকে আকূল হয়ে। টের পায় না কেউ।
সুনির্মল দত্তের সেই অসহায় চেহারা মনে গেঁথে আছে ফারজানার। এই কৃষ্ণপক্ষির কোনো সমাধান জানা নেই কারো...
এভাবেই এক রাতে হামিদের পাশে ঘুমানোর সময় নাভির চারপাশ জুড়ে ব্যথা জেগে ওঠে ফারজানার। অন্ধকার ঘরের ভেতর মশারীর মাঝে শুয়ে চাপা স্বরে কোঁকাতে থাকে। হামিদের ঘুম গাঢ়। টের পায় না সেই শব্দ। তন্দ্রার মাঝে ফারজানার কানে বহুদূর হতে ভেসে আসতে থাকে, “ম-মা-আ-আ-আ... ম-মা-আ-আ-আ...” নাকে ভেজা ভেজা সেই শ্যাওলা, কাদামাখা উৎকট গন্ধ।
ছট ফট করতে থাকে ফারজানা ঘুমের ভেতর। কিন্তু ঠিক ঘুম নয়। সে স্পষ্ট টের পাচ্ছে একটানা বৃষ্টির কারণে বারান্দা উপচে পানি ঢোকা শুরু করেছে ঘরের ভেতর। দরজার চৌকাঠের নিচ দিয়ে পানি আসছে ধীরে ধীরে। বাহিরে বারান্দায় খুঁটিতে বাঁধা নৌকাটা দুলছে, ছলাত ছলাত শব্দে পানির মাঝে আলোড়ন... যেন কিছু একটা সেই নৌকার কাছেও চলে এসেছে... ছোট্ট কোনো পাখির ওড়া উড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কি আশ্চর্য! এই বৃষ্টির মাঝে পাখি আসবে কেন?
নাভির কাছটায় অকস্মাৎ ভয়াবহ শক্তিতে খামচে ধরল কিছু একটা, ফারজানা অস্ফুট চিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে। টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে সেই চিৎকার ঢাকা পড়ে যায়। হামিদ কিংবা পাশের ঘর থেকে সুফিয়া বেগম, আয়েশা টের পার না। সলতে নামিয়ে রাখা হারিকেনের মিটমিটে নীলাভ আলোয় মশারীর বাহিরে চোখ যায় ফারজানার। আসলেই ঘরের ভেতর পানি ঢুকেছে। ইট দিয়ে উঁচু করে রাখায় খাট না ছুঁলেও এক ইট অবধি ডুবে গেছে।
ফারজানা নিজের অজান্তেই ডান হাতটা দিয়ে পেটে ধরল। রক্ত বের হচ্ছে, বেশ ভালমতোই বের হচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। বহুদূর থেকে এখন বেশ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে ডাকটা, “ম-আ-আ-মা-আ-আ-আ”
ফারজানার চোখ ফেটে জল আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। নিয়তির অমোঘ কোনো এক শৃঙ্খলে আটকা পড়েছে সে। মুক্তি নেই সেই দ্বায় থেকে।
পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা হামিদের দিকে তাকায়। সারাদিন এই বাড়ি ঐ বাড়ি গিয়ে মানুষজনের বাজার সদাই করে দিয়ে এসেছে, মাদ্রাসা বন্ধ, টিউশনি বন্ধ। আয় উপার্জন নেই। নৌকায় করে লোকজনের কাজ করে দিয়ে ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহে শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে গেছে। বেঁচে থাকাটা কষ্টের অনেক। বাঁচিয়ে রাখাটাও। ফারজানা জীবিকার জন্য এই প্রথম আপন কাউকে কষ্ট করতে দেখছে। ধীরে ধীরে কেন জানি মায়া পড়তে শুরু করেছে হ্যাঙলা, দুবলা, বৈশিষ্ট্যহীন এই মানুষটার জন্য।
ধীরে ধীরে মশারি তুলে পানির মাঝে পা দেয় ফারজানা। সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস নেয়ার কষ্টটা চলে যায়। যেন তাজা অক্সিজেন পেলো ফুসফুস। পেটের ব্যথাটাও কমে আসে দ্রুত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে। শব্দ না করে দরজার কাছে চলে যায় হারিকেনটা হাতে নিয়ে। খুব সাবধানে দরজার ছিটকিনি খুলে দরজার পাল্লা ফাঁক করে। বাহিরের ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস সাথে সাথে এসে গালে, চুলে ছুঁয়ে যায়। কাউকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত বারান্দায় বেরিয়ে এসে দরজার পাল্লা টেনে দেয় ফারজানা।
এক নাগাড়ে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। বারান্দায় একটা বসন্তবৌরি ডানা ঝাপটে একবার এদিক একবার ওদিকে ছোটা ছুটি করছে। অন্ধকারে না দেখেও পাখিটা যে বসন্তবৌরি- ফারজানা বলে দিতে পারে। পানি ভেঙ্গে নৌকাটার কাছে যায় সে। দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে হামিদ। শক্ত বাঁধন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেই গিঁট খুলে বৈঠা নিয়ে উঠে পড়ে ফারজানা। আগে কোনোদিন নৌকা বায়নি সে। কিন্তু এখন কেন যেন সেটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা হচ্ছে না। কারণ অদৃশ্য কিছু একটা নৌকাটাকে ঠেলতে শুরু করেছে পানির নিচ দিয়ে। বৈঠা না ফেলেও ফারজানা নৌকা নিয়ে রওনা হয় হাওড়ের উদ্দেশ্যে ভিজতে ভিজতে। ছইয়ের ভেতর আর ঢুকতে ইচ্ছে হয় না তার।
দেখতে দেখতে উঠান পেরিয়ে পুকুরের ওপরে চলে আসে নৌকাটা, তারপর ছড়া, স্কুলের মাঠ, ডুবে থাকা গোরস্থান, অবশেষে বাঁধের মতো রাস্তার ওপর দিয়ে হাওড়ে প্রবেশ করে। আলাদা কোনো সীমানা নেই, গাছ, বেড়া কিংবা পুলের রেলিং দেখে এইসব জায়গাকে চিনতে পারলো আলাদা আলাদা ভাবে ফারজানা। শ্বশুরবাড়িতে এসে এই প্রথম গ্রামে বের হওয়া তার। অথচ এভাবে বের হতে হবে- কখনো ভাবেনি।
যতই এগুচ্ছে ফারজানার কানে মা মা ডাকটা বাড়ছে। ঠিক কানের মধ্যে নয়, শব্দগুলো মগজের ভেতর হচ্ছে। বজ্রপাতের আলোয় থেকে থেকে দিনের মতো সাদা হয়ে যাচ্ছে চারদিকের পৃথিবী। ফারজানা পেটের ভোঁতা যন্ত্রণা উপেক্ষা করে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবী দেখতে থাকে। এভাবে কখনো পৃথিবী দেখেনি সে। বিচিত্র একটা মমতা জাগে। মেঘের আকৃতিগুলো স্পষ্ট করে দিয়ে আলো হচ্ছে। যত দূর চোখ যায় উথাল পাথাল পানি। সমুদ্র যেন। কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও বৃষ্টি বন্ধ। বজ্রপাতের আলোয় এই বিষয়টা অদ্ভুত ভাবে বোঝা যায়। বহুদূরের জেগে থাকা দ্বীপের মতো বাঁশঝাড় দেখে রহস্যময় লাগে।
ফারজানা পেছনে ফিরে নিজের শ্বশুরবাড়ির গ্রামটা দেখার চেষ্টা করে। দেখা যায় না আর। হারিয়ে গেছে দিগন্ত থেকে। ছইয়ের ওপর বৃষ্টিতে ভিজছে একটা বসন্তবৌরি পাখি। ফারজানা জানে না এটা তার খাঁচার পাখিগুলোর একটা কিনা? গত বিশ দিনে অন্তত আরো পাঁচটা বসন্তবৌরি পাখি মরে থাকতে দেখেছে সে বাড়ির আশেপাশে। তার স্বামী বা শাশুড়ি যদিও ভেবেছে সে দেখেনি, সরিয়ে নিয়েছে আগে থেকে। কিন্তু সে প্রতিটাই দেখেছিল। কে জানে, এটাই অবশিষ্ট আট নাম্বার পাখিটা কিনা। নড়ছে না পাখিটা। ভীত, জড়সড় হয়ে বসে আছে।
ফারজানা বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে বলে ওঠে, “বইসা আছস ক্যান? চইলা যা। মরিস না। আমি মরবার যাইতেছি।” কিন্তু উত্তর দেয় না পাখিটা। নির্বিকার।
মগজের ভেতর মা মা ডাকটা বাড়তেই আছে। মগজ চিড়ে ফেলবে যেন। ফারজানার মুখ তবু শক্ত। কান্না আর বৃষ্টির পানি মিশে গেছে। কাঁদছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না আর। হাওড়ের ঠিক কোথায় ভেসে যাচ্ছে, জানে না। পেটের ব্যথাটা আবার বাড়ছে। নিঃশ্বাস নিতে না পারার কষ্টটা ফিরে এসেছে। যতই এগুচ্ছে, বাড়ছে সব। ডাকগুলো, ব্যথা, দম নিতে না পারার কষ্ট।
এক সময় নৌকাটা স্থির হয়ে গেল অন্ধকারের মাঝে। ফারজানা চারদিকে তাকালো। দূর্বল হয়ে আসছে ক্রমশ। প্রবল শ্বাস কষ্টে ঝুঁকে এসেছে মাথা। তাও যতদূর চোখ যাচ্ছে, পানির মাঝে গলা তুলে ভাসছে বিশ পঁচিশজন মানুষের মতো কিছু। থেকে থেকে মেঘ গর্জে উঠলে আলোয় কিছুই বোঝা যায় না। জমাট অন্ধকার অবয়ব। নৌকাটার একদম কিনার ঘেষেও চলে এসেছে কয়েকটা... নিঃশব্দে মাছের মতো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে কোনো রকম ঢেউ না তুলে...
ফারজানার চোখের সামনে লালচে কালো একটা পর্দা নেমে আসতে চাইছে। নিঃশ্বাসের জন্য বুকটা আকুলি বিকুলি শুরু করেছে। ঝুঁকে ডান হাতটা নৌকার বাহিরে পানিতে রাখামাত্র বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারল। প্রায় একই সাথে পানির নিচ থেকে অন্ধকার কিছু একটা ওর হাতটা চেপে ধরল... বরফ ঠাণ্ডা একটা হাত। পিচ্ছিল।
ফারজানার বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। ভয় পাচ্ছে না আর। শান্ত মুখে তাকিয়ে আছে পানির নিচে তার হাতটা ধরে থাকা জিনিসটার দিকে। ধীরে ধীরে উঠে আসছে পানির নিচ থেকে সেটা। মাথা তুললো পানির ওপরে। লম্বা লম্বা চুল... নারী অবয়ব। এই প্রথম এত কাছ থেকে ভাল করে দেখার সুযোগ পেলো ফারজানা। গুমোট মেঘের আলোয় বুক পানিতে ভেসে ওঠা জিনিসটা ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে মানুষের আদল দিতে শুরু করে... ফারজানার কাঁধের কাছটায় শিরশির করে ওঠে। ওর হাতটা ধরেই রেখেছে জিনিসটা। ক্রমশ খুবই পরিচিত একটা চেহারায় বদলে যেতে থাকে অন্ধকার জিনিসটার মুখ। ধীরে ধীরে নাক, মুখ চোখ ফুটে উঠতে থাকে...
আয়নার সামনে বহুবার এই আদল দেখেছে ফারজানা... অবিকল তার রূপ নিয়েছে জিনিসটা... নৌকার পাটাতনে আধশোয়া হয়ে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে পানি থেকে সোজা হয়ে ভাসতে থাকা নিজেরই প্রতিরূপের হাত ধরে আছে ফারজানা! কোনো ভয় নেই, উৎকণ্ঠা নেই। বিস্ময় নেই। সমস্ত অনুভূতির সীমারেখা পার হয়ে গেছে বহু আগেই।
পানিতে ভাসতে থাকা নারী সৌষ্ঠবের মানুষটা; আদৌ কি মানুষ?- বলে উঠল অদ্ভুত একই স্বরে, “মা- আমি একদম তোমার মতো হইছি না?” ভীষণ করুণ, আহুতি মেশান কষ্টের সুর সেই কথায়।
ফারজানার হঠাৎ চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু নিজেও জানতে পারে না বৃষ্টির কারণে। পেটে, নাভির কাছটায় আগুণের ফুলকির মতো ব্যথা ছুটেছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে যে কোনো মুহূর্তে। সেই মেয়েটার অপর একটা হাত নৌকায় শোয়া ফারজানার পেটের কাছে চলে গেছে...
“আমি বহুকাল তোমার লাইগা এইখানে অপেক্ষায় আছি... আমারে নিবা না?” মেয়েটা আবার বলে ওঠে। আকূল কণ্ঠ।
ফারজানা কিছু বলে ওঠার চেষ্টা করে, কিন্তু শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে না।
“আমি তোমার সাথে যামু মা... আমারে নিবা না?”
ফারজানার পেটে রীতিমত ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে...
ছইয়ের ওপর বসা পাখিটাকে আচমকা তীব্র বেগে ছুটে এসে পানির সেই মেয়েটার মুখের ওপর ঠকর মারতে দেখে ফারজানা। জ্ঞান হারাচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণায়। পানির ভেতর থাকা মেয়েটা পাখিটার ঠকরে হঠাৎ হাত ছেড়ে দেয় ফারজানার, নারী কণ্ঠে চিৎকার দেয়ার বদলে অন্যকোনো জগতের ভয়ংকর বীভৎস প্রাণির গলায় গর্জন করে ওঠে।
সঙ্গে সঙ্গে নৌকার চারপাশে ভেসে ওঠা মূর্তিগুলো ঝড়ের মতো সৃষ্টি করে হাওড়ের বুকে! কোথা হতে আচমকা ঝাঁকে ঝাঁকে ছোট্ট ছোট্ট পাখি উড়ে এসে সেই মূর্তিগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে পাগলের মতো! মানুষ শোনেনি এমন শব্দে রাতের আকাশ খান খান হতে যেতে থাকে অন্ধকার প্রাণিগুলোর চিৎকারে...
ফারজানা জ্ঞান হারায়।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

“ফারজানা? অ বৌ? তুমি এইখানে কী করতেছো?” বিস্মিত গলা শোনা যায় হামিদের।
চোখ মেলে বহু কষ্টে তাকায় ফারজানা। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে হামিদ। চোখে মুখে ভয়। দিনের আলো ফুটছে মাত্র। ভোর। কোথায় সে?
অবাক মুখে উঠে বসে, চারপাশে তাকিয়ে দেখে বাড়ির বারান্দায় বেঁধে রাখা নৌকাটার পাটাতনে শুয়ে আছে। পানি নেমে গেছে, ভেজা উঠান বেরিয়ে এসেছে বহুদিন পর! এমনকি পুকুরের ঘাট অবধি জেগে উঠেছে।
হামিদ অবাক মুখে আবার বলল, “তুমি ঘরে না ঘুমাইয়া এইখানে কি করতেছো? কখন আসছো এইখানে?”
ফারজানা নিজের অজান্তেই ডান হাতে পেটে আঙ্গুল ছোঁয়ায় খুব সাবধানে। সাথে সাথে জমে যায়! ঝট করে সোজা হয়ে আঁচল সরিয়ে ভাল করে তাকায় পেটে। হামিদ নিজেও ওর কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক।
পেটে কোনো দাগ নেই। কোনো কালে ছিলো না! ফারজানা হামিদের দিকে বিমূঢ়ের মতো তাকায়। হামিদ অস্ফুট গলায় বলে, “কবিরাজের দাওয়াই এতই কাজ করেছে যে দাগ চলে গেল একদম?”
ফারজানা পেটের কাপড় টেনে দিল আবার। নিজে অবাক হলেও হামিদকে কিছু বলল না আর। নৌকা থেকে সাবধানে খালি পায়ে নেমে এলো ভেজা উঠানে। সমস্ত শরীরে অদ্ভুত একটা শক্তি অনুভব করছে। পাখি ডাকছে গাছে। ভোর হচ্ছে।
কাপড় শুকাতে দেয়া বাঁশের খুঁটির দড়িতে একটা বসন্তবৌরি বসে রয়েছে। সবুজ। ফারজানা তাকানো মাত্র ডাক দিয়ে উড়াল দিল ভোর হতে থাকা আকাশের দিকে।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:০০
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×