অনার্স পড়াকালীন সময়ে ডাকসুর সামনের হাফওয়ালটা ছিলো আমাদের ক্রাইম স্পট। যেদিন আমাদের মন ফুরফুরা থাকতো চার বান্ধবী মিলে ছেলেদের বিব্রত করতাম। জেনে বুঝে প্ল্যান করে যেকোনো একজন ছেলের দিকে চার বান্ধবী গভীর মনোনিবেশ করে তাকিয়ে থাকতাম। যেসব ছেলেরা ডাকসুর সামনের রাস্তা ধরে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দিকে যেত অথবা সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে কলাভবনের দিকে যেত তারা ছিল আমাদের টার্গেট। নীল শার্ট- লাল শার্ট এভাবে শার্টের কালার বলে দিয়ে আমরা একই সাথে ড্যাবড্যাব করে একটাই ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বেশিরভাগ টার্গেটই পরপর চারজনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়ে একবারের জন্য পেছন ফিরে তাকিয়ে আরও বিব্রত হতো; কেননা তখনও আমরা তার দিকেই তাকিয়ে আছি। আর যেদিন আমাদের মন উদাস থাকতো, ডাকসুর দোতলার সিড়িতে বসে পেয়ারা মাখা খেতে খেতে ভাবতাম এতো পড়ে আর কিই হবে, একদিন আমাদের সবারই ভালো বিয়ে হয়ে যাবে! আমাদের দ্বিতীয় ক্রাইম স্পট ছিলো হাকিম চত্বর আর ভাষা ইন্সটিটিউট এর মাঝে হাফওয়াল। এখানে বসেও আমরা ওই সাইটটিজিং করতাম। শ্যাডোতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বেশিরভাগ করেছি কূটকর্ম। বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে নানা মেজাজের মন্তব্য। আইবিএ'র ক্যান্টিনে দুপুরে খেতে যেতাম। সেখানে আসলে আমরা হ্যান্ডসাম ছেলেদের দেখতে যেতাম। আদিবাসী এক ছেলে ছিল আমাদের কমন ক্রাশ। তাকে একনজর দেখবো এতে তখন কত্ত সুখ! একবার বন্ধু রাজীবকে দিয়ে এক ছেলেকে প্রস্তাব পাঠানো হলো, সে ছেলেটার আশেপাশে ঘুরে ফিরে চলে আসলো। কী বিষয়? রাজীবের মতে আজ মঙ্গলবার দোস্ত। মঙ্গলবার কোনোধরনের প্রেমের পবিত্র প্রস্তাব দেয়া ঠিক না।
প্রশংসা এবং শাড়ি এই দুইটা বিষয়ে আমার কোনো না নাই। শাড়ি গোছাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবির একটা এ্যালবাম পেলাম। সেই এ্যালবাম থেকেই বেরিয়ে এলো কিছু খুচরো স্মৃতি! একটা ছবি আমাদের পহেলা বৈশাখের। সে এক বৈশাখ বটে! চার বান্ধবী মিলে শাড়ি পরে সেজেগুজে ঘুরতে গেলাম কার্জন হল। সেদিন ক্যাম্পাস ছিলো লোকে লোকারণ্য। গরমও ভীষণ। শহীদুল্লাহ হলের পুকুরপাড়ে কোনো জায়গা খালি নাই। আমি এতটাই ক্লান্ত যে ঘোষণা দিলাম আমাকে এক্ষণ-এক্ষণ আইসক্রিম না খাওয়ালে আমি রাস্তার ওপর ঢলে পড়বো। সাকি আর যুথি গেল আইসক্রিমের খোঁজে। আমি আর নাজরানা অনেক খুঁজেপেতে একটা স্লাপের উপর বসলাম। আমরা রাস্তার দিকে মুখ করে বসলাম আর পুকুরের দিকে মুখ করে একটা জুটি সেখানে আগে থেকেই বসেছিল। আইসক্রিমও চলে আসলো, অর্ধেক আইসক্রিম খেয়েই আমি সতেজ হয়ে গেলাম। আমাদের অবান্তর আলাপে বিরক্ত হয়েই সম্ভবত জুটিটি উঠে গেল। কিন্তু বিপত্তিটা হলো একটা শব্দ! কাপড় ছেড়ার শব্দ। আমি ছেলেটার পাঞ্জাবির ওপর বসে পড়েছিলাম। অসাবধানে উঠতে গিয়ে পাঞ্জাবির পেছনের পার্টটা ঠাস করে ছিড়ে গেল। নতুন পাঞ্জাবি। মেয়েটা একবার পাঞ্জাবির দিকে তাকালো আর একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হনহন করে হাঁটা ধরলো। ছেলেটা একবার পাঞ্জাবির দিকে তাকালো, আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে দ্রুত মেয়েটার দিকে এগোতে থাকলো। আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় পুরা হা।
সাকি বললো এইটা কোন কাম করলি!
আমার এক্সপ্রেশন ছিল, দোস্ত আই এম সরি।
সাকির মন্তব্য: সরি কইলে হইবো?
আমি: তাইলে ডাইকা আন পাঞ্জাবি কিনে দিই।
সাকি: তোর যে বুদ্ধি, তুই যা করছোস এই প্রেম আর টিকবো!
আমি: তাইলে আর কি পোলারে ডাইকা লইয়ায় আমি তার লগে প্রেম কইরা ক্ষতি-পূরণ করি...
মাস্টার্সে পড়ার সময় আমাদের পঞ্চম বান্ধবী শাহনাজের বিয়ে হয় আমাদেরই সহপাঠী রনির সাথে। প্রেমের পরিনতি। আকদ হবে। আয়োজন ছোট পরিসরে ছিলো। রনির বোন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন বলে অনেকটা তাড়াহুড়ো করে আয়োজন। সকাল সকাল আমরা চার বান্ধবী পৌঁছে গেলাম শাহনাজের বাসায়। আমাদের উপর দায়িত্ব পড়লো ওদের বাসর শয্যা সাজিয়ে দেয়ার। এ আরেক ইতিহাস! যা হোক প্রথমেই শুরু হলো মন্তব্যদের বান, তওবা তওবা বিয়ে করলেই একসাথে থাকতে হবে! শাওহনাজ তো লজ্জ্বায় শেষ। বাসর শয্যা সাজানো শেষ হলে সাকি বললো আমাদের একটা ডেমো দেয়া উচিত। কী বলিস তোরা? আমরাও একমত। তো সাকি সাজলো রনি, আমি সাজলাম শাহনাজ। প্রকৃত শাহনাজ এবং শাকেরা সোফায় বসা। সাকি দরজার বাইরে চলে গেল। আমি ঘোমটা দিয়ে খাটে বসলাম। এবার রনিরূপি সাকির আগমন। কেমন আছো শাহনাজ। নাহ নামটা ডাকার জন্য একটু বড় হয়ে যাচ্ছে, তোমাকে আমি নাজ বলেই ডাকবো। যাহোক তোমার অবশ্য ভালো থাকারই কথা। হোম গ্রাউন্ডের এডভান্টেজ আজ তোমার। মাঠ তোমার - পিচ তোমার- এমনকি গ্যালারিভর্তি দর্শকও তোমার। ভাবছিলাম তুমি কদমবুচি সেরে ফেললে মাঠে নামবো কিন্তু তোমার তো সে বিষয়ে কোনো আগ্রহই লক্ষ্য করছিনা। বাকি সংলাপ সেন্সরবোর্ড পক্ষ থেকে আটকে দিলাম.... কারণ সাকি এবং আমি সমান পারদর্শীতায় এত্ত বাজেকথা বলতাম পারতাম যে এ বিষয়ে বান্ধবী যুথির স্টেটমেন্ট ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত বাজে কথার জন্য তোদের পদক দেয়া এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া।
আমাদের অনার্স শেষ হয় মঈনউদ্দীন-ফকরুদ্দীনের আমলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের আয়োজন বন্ধ। তো আমরা ক্লাসফেলোরা মিলে ছোট আয়োজন করি। প্রথমেই শপথ বাক্য পাঠ হলো, আজকের আনন্দ সবার জন্য। কোনো না বলবো না। সে যা হোক নানা ধরনের অংশগ্রহণমূলক গেমস আর উদ্ভট স্মৃতিচারণ। আমাকে স্টেজে ডাকা হলো এবং আমার ভাগ্যে পড়লো নাচ। সারাজীবন আমি ক্লাসফেলোদের এতই বিব্রত করেছি যে সব সুদে আসলে আমাকে সেটা শোধ দিতে হলো। আমি ফতোয়া দিলাম একা তো নাচা যায় না, আমার পার্টনার লাগবে। কে হবে আমার নাচের পার্টনার। অডিয়েন্স হাসি হাসি মুখে তা আছে আর আমার চোখে রয়্যাল লুক। সামনের সারিতে বসা বুলবুল নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কোনো ভাবেই আমার চোখে চোখ না পড়ে। আমি বললাম আমি বুলবুলের সাথে নাচবো। বুলবুল ফর্সা ছেলে ওর কানটান পুরা লাল হয়ে গেল। দরজা বন্ধ না থাকলে ও সম্ভবত দৌড় দিত। বুলবুল হচ্ছে সেই ছেলে অনার্স-মাস্টার্স পুরো পাঁচবছর ডানসারির দ্বিতীয় বেঞ্চের কোনায় এসির ঠিক নিচে একটা নির্দিষ্ট সিটে বসেছে। মেয়েদের তো দূর কি বাত ক্লাসফেলো সব ছেলেদের সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিলো না। তাকে নাচানো হচ্ছে। গান ছিলো 'তুমি আমার মনের মাঝি, আমার পরান পাখি, আমার বাড়ি যায়ও দিমু ভালোবাসা'।
অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট হলো। কর্মস্থলে আমি আর বুলবুল সহকর্মী। অফিসে তখন আমার দুইটা কাজ একটা অফিসের কাজ অন্যটা ছিলো বুলবুলকে পঁচানো। রোজ ৪/৫টা সেলফি তুলতাম। কারণ প্রতিবার সেলফি তোলার আগে বুলবুল ব্যাগ থেকে পারফিউম বের করে ব্যবহার করতো। আমি এখনো ভেবে পাইনা ছবির সাথে ঘ্রাণের কি সম্পর্ক! বলতাম তোর উচিৎ কোনো প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করা, দেশে আসার সময় লাগেজভর্তি পারফিউম নিয়ে আসবে। যা হোক, মাসছয়েক আগে আমি মাসুম নামের এক ব্যক্তির প্রেমে পড়ে যাই। প্রেম না আমি আসলে তাকে বিয়ের কথাই ভাবছি। খোঁজ নিয়ে জানলাম মাসুম সাহেব এবং বুলবুলের বর্তমান কর্মস্থল একই প্রতিষ্ঠান। বুলবুলকে কল দিলাম, এ্যায় বুলবুল তুমি কি মাসুম সাহেককে চিনো? দুইএকটা এডিশনাল ইনফরমেশন দেয়ার পর চিনলো তবে মাসুম সাহেব অন্য বিভাগে কাজ করেন। বললাম, আমি মাসুম সাহেবকে বিয়ে করতে চাই। তুমি তাকে গিয়ে বলবা তোমার বান্ধবী ইজ ইন লাভ উইথ মাসুম সাহেব। বলবা, আমি সুহাসিনী এবং মৃদুভাষিণী নই তবে মাসুম সাহেবকে সারাজীবন সবকিছুতে বেশি প্রাওরিটি দেয়া হবে।
সপ্তাহখানেক বাদে আবার কল দিলাম বুলবুলকে, এ্যায় বুলবুল আমার স্বামী কেমন আছে?
বুলবুল-- তোমার স্বামী কে?
আমি-- কেন মাসুম সাহেব!
গতকাল কল দিয়ে বললাম, বুলবুলি তোমার জীবনের দুইটা কলংকের গল্প শোনাও তো।
বুলবুল- আমার কোনো কলংক নাই
আমি-- কলংক ছাড়া পুরুষ মানুষ আমার কিসের পুরুষ মানুষ।
বুলবুল-- আমার জীবনের একমাত্র কলংক তোমার মতো বান্ধবী (আমার সাথে মিশতে মিশতে কথা শিখে গেছে আরকি)!
নানা আলাপ পেরিয়ে অর্থনীতি উঠে এলো। বললাম আমাকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা ধার দাও তো। বুলবুল জানালো দেয়ার মতো টাকা তার আছে তবে, করোনার ভয়ে ব্যাংকে যাবে না। এবার অবধারিত টপিক! বললাম তাইলে মাসুম সাহেবকে দিতে বলো, বলবা তোমার বান্ধবীকে সে প্রেম না দিক অন্তত কিছু টাকা তো ধার দিক। টাকা লেনদেনের মধ্য দিয়ে একদিন আমরা সংসারের কথাও আলাপ করে নিবো। বুলবুলের সেই বিখ্যাত উক্তি- তুমি পুরাই মাথা নষ্ট ওম্যান!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৮