somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হক-ই-মোহর

১৮ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বৈবাহিক জীবনে আনুসাঙ্গিক বিষয়াদি রয়্যাল বা রাজকীয় হওয়ার চেয়েও দাম্পত্য সম্পর্কটি রাজষিক হওয়া বেশি জরুরী। যারা বিয়ে করার কথা ভাবছেন তারা অনেকেই মোহরানা নিয়ে যথেষ্ট সময় নিয়ে ভাবেন খুব কম। দেখা যায় বিয়ের আসরে দুই পক্ষের অভিভাবকরাই নির্ধারণ করে দেন কত মোহরানায় নিকাহ সম্পন্ন হবে। এক্ষেত্রে টাকার অংকে সংখ্যা লিখে ভরিয়ে তোলা হয় মোহরানার ঘর। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না মোহরানা কত হতে পারে। ইচ্ছে থাকলেও আমাদের হাতের কাছে যথেষ্ট রেফারেন্স না থাকার কারণে অনেককেই পরে আফসোস করতে দেখেছি ‘ইশ, আগে জানলে আরেকটু ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম!’

মোহরানা নারীকে দেন তার স্বামী। এখন অনেকেই জানতে চান, মোহরানা নারীর প্রাপ্য কেন? দেনমোহর স্ত্রীর ভরণপোষন নয়, এটি বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত কোনো উপহারও নয়। বরং বিয়ের সময় কবিননামায় স্বামী কর্তৃক প্রতিশ্রুত অর্থ। যেটা স্বামী কোনো ভাবেই উপেক্ষা কিংবা অস্বীকার করতে পারেন না। দেনমোহর মূলত স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উপায় হিসেবে স্বামীর উপর আরোপিত একটি অবশ্য পালনীয় দায়িত্বমাত্র। মূলত দুটি কারণে মোহরানা পরিশোধ করা হয়, যার মধ্যে একটি হচ্ছে ধর্মীয় অধিকার লাভ এবং অন্যটি হচ্ছে স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য পালন। বস্তুত মোহরানা প্রদানের রীতি রয়েছে শুধু ইসলাম ধর্মে। এটি কোনো ভাবেই কণ্যাপন নয়। বরং নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং বৈবাহিক চুক্তি যখন তখন ভেঙ্গে না যাওয়ার জন্য এ নিয়ম চালু করা হয়। মোহরানা পাওয়ার অধিকার নারীর নিরস্কুশ এবং একছত্র। বৈবাহিক চুক্তির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো মোহরানা।

মুসলিম বিয়েতে মোহরানাকে বলা হয় স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া স্ত্রীর একটি বিশেষ অধিকার। দেনমোহর হলো কিছু অর্থ বা অন্য কোন সম্পত্তি যা স্বামীর নিকট থেকে বিয়ের মূল্য স্বরূপ স্ত্রী পেয়ে থাকেন। একজন স্ত্রী স্বামীর আর্থিক ও বাস্তব অবস্থা বুঝে ইচ্ছে করলে মোহরানার উপর তার দাবী পরিত্যাগ করতে পারেন। তবে, এক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে যে, মোহরানা যদি লিখিত আকারে নির্ধারিত হয়ে যায় তবে তা অবশ্যই স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে। কোরআন শরীফে মোহরানা কে সাদাক বা আরুজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেটা বাধ্যতামূলকও বটে। আইনবিদ স্যার ডি এফ মুল্লা মোহরানা সম্পর্কে বলেন, মোহরানা বলতে বোঝায় বিশেষ অর্থ বা সম্পদ যা একজন মুসলমান নারী বিবাহ সম্পাদনের উদ্দেশ্যেই তার স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্তির অধিকার অর্জন করেন। মোহরানা না পাওয়ার কারনে স্বামীকে তার অধিকার বঞ্চিত করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে। কারণ মোহরানা দাবি করা স্ত্রীর অধিকার। যে কোনোভাবেই স্ত্রী তা চাইতে পারেন।

মোহরানার পরিমান কত হবে তা কখনোই নির্ধারণ করা হয়নি। স্বামীর অর্থনৈতিক যোগত্যা এবং স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা ও অবস্থান ভেদে তা নির্ধারিন করার কথা বলা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (স.) তার স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে চার হাজার দিরহাম মোহর দিয়েছিলেন। হযরত আলী (রা.) যখন মুহাম্মদ (স.) কন্যা ফাতিমাকে (রা.)কে বিয়ে করেন তখন মোহরানা দেয়ার মতো আলীর কোনো নগদ অর্থ সম্পদ ছিলো না। বিয়ের সময় তার মালিকানায় ছিল কেবল উট, তরবারি আর বর্ম। উট এবং তরবারি তার জীবন যাপনের জন্য অতি আবশ্যক ও জরুরী ছিল বলে নবীজী আলীকে বিয়েতে মোহরানা হিসেবে বর্ম দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। পরামর্শ যথারীতি পালন করেন আলী (রা.)। নবী মূসা(আ.) যখন মিশর থেকে মদিনায় এসে সাফুরাকে বিয়ে করেন তখন তার মোহর দেওয়ার মতো কোনো সামর্থ্য ছিলো না। সেসময় সাফুরার পিতাকে তিনি কোনো প্রকার মজুরি ছাড়াই দশ বছর গবাদিপশু পালন ও চারণ করে প্রতিদান হিসেবে তার ‘শ্রম’ উপহার দেন।
‘ফতোয়ায়ে আলমগীরী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি মূল্যবান বস্তুই দেনমোহর বা মোহরানা হতে পারে। এমনকি কোনো কিছু দিয়ে উপকার করা বা কোনো বিষয়ে সুবিধা দানও মোহরানা হতে পারে। একসময় আরব দেশে অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের পাশাপাশি গোলাপফুলও মোহরানার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকত। দিরহাম, গ্রীক সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে উদ্ভুত। এটি হলো এমন রৌপ্য মুদ্রা যার ওজন ২.৯৭ গ্রাম। “মোহর ই ফাতিমা”- চারশ মিতকাল নির্ধারণ করা হতো মোহরানার পরিমাণ। নবী মুহাম্মদের সময় আটির চর্চা ছিল আরবে। মিতকাল ছিল স্বর্ণ্মুদ্রা। যার ওজন ছিল ৪.৫ মাশা। এক মাশা ছিল ৮ রতি’র সমান।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, সাধারণ আয়োজনের বিয়েই সর্বোত্তম বরকতময়। তবে তার মানে এই নয় যে এতো সামান্য পরিমান মোহর ধরা হলো, যা স্ত্রীর সম্মান ও সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী নয়। কিংবা এতো বেশি পরিমানেও নয় যা স্বামীর সাধ্যসীমার বাইরে। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)এর মতে, দেনমোহরের সর্বনিন্ম পরিমান ন্যূনতম দশ দিরহাম বা ৩০ গ্রাম রূপার সমমূল্য। রাসূল (সা.) নিজের মেয়ে এবং স্ত্রীদের বেলায়ও যে মোহরানা নির্ধারণ করেছিলেন তার পরিমান পাঁচশ দিরহাম বা ১৩১ তোলা ৩ মাশা রূপার সমমূল্য। তবে উম্মে হাবিবা (রা.) এর বেলায় এর পরিমান ছিল চার হাজার দিরহাম।

মোহরানা বিয়ের সময় নির্ধারণ না করা হলে, বিয়ের পরেও তা নির্ধারণ করা যায়। সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যদের মোহরানার পরিমান বিবেচনায় ধরাকে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে কণের ফুপুর মোহরানাও উদাহরণ হিসেবে গন্য হতে পারে। মূলত বিয়ের কাবিন নামার তের নম্বর ঘরে লেখা হয় “মোহরানা”র পরিমান কত নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে তাৎক্ষনিক এবং বিলম্বিত দুই ভাবে মোহরানা পরিশোধ করা যায়। তবে বিলম্ববে হলেও দেনমোহর পরিশোধ করা স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। স্ত্রী মোহরানা দাবী করলে স্বামী তা পরিশোধ না করলে স্ত্রী চাইলে স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকতে পারে বা পৃথক বসবাস করতে পারেন।

মোহরানা নিয়ে আমাদের দেশে একটা ভ্রান্ত ধারনা আছে যে, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় সেক্ষেত্রে স্বামীকে আর মোহরানা শোধ করতে হয় না। এটা একটা ভুল ধারনা। বিবাহ বিচ্ছেদের অবেদন যিনিই করুন না কেন, স্বামীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ১০ ধারায় মোহরানা পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কাবিন নামায় মোহরানা পরিশোধ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলে স্ত্রী তলবমাত্র সম্পূর্ণ মোহরানা স্বামীকে পরিশোধ করতে হবে। ইসলামী আইনশাস্ত্র অনুযায়ী, মোহরানা ঋণের সমতুল্য এবং এটা একটা অরক্ষিত ঋণ। স্বামীর মৃত্যু ঘটলে অন্যান্য পাওনাদারদের মতো স্বামীর ভূমি কিংবা অপরাপর সম্পত্তি থেকে স্ত্রী তা আদায় করে নিতে পারেন।

নৃতত্ত্বে এবং সমাজতত্ত্বে এই রকম তথ্য আছে যে, কৃ্ষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পর বিয়েতে কন্যাপণ প্রথা চালু হয়েছিল। আদিম যুগে নারীর প্রাধান্যি ছিল রীতিসম্মত। প্রাচীন আর্য সমাজে বিয়ের সময় কন্যার পিতাকে নানা রকম উপহার দেয়ার কথা জানা যায়। এছাড়া হামবুরাবী কোড থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রীসে, মেসোপটেমিয়া, ও ইহুদীদের মধ্যেও মোহরানা প্রচলিত ছিল। তবে তার রূপ ছিলো অন্যরকমের।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০৮
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×