পরকীয়ায় হত্যাকান্ডের দুইটা ঘটনা বলি। প্রথম ঘটনাটার সময়কাল ১৯৮৯ সাল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত খুনের মামলা। ১৯৮৯ সালে বিয়ের মাত্র তিন মাস পর ৯ এপ্রিল পুলিশ নরসিংদীর কাছাকাছি মিজিমিজি গ্রাম থেকে উদ্ধার করে রীমার লাশ। স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে খুন হন শারমিন রীমা। ৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে রওনা হয়ে যাওয়ার দুদিন পরে ফেরার পথে স্বামী মনির হোসেন তাকে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি গ্রামের কাছে ফেলে রেখে আসে। বাড়ি থেকে এত দূরে কোনো মেয়ের লাশ পাওয়া গেলে যে কেউই সবার আগে ধরে নেয় হয় স্বামী নিজেও খুন হয়েছে বা নিজেই খুন করেছে। পুলিশও শুরু করে মনিরের খোঁজ। তাকে চরসসহ এক হোটেলে পাওয়া যায়, সেখানে সে পাগল পাগল অবস্থায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছিল। খুব সহসাই পুলিশ বুঝতে পারে যে আসলে পাগলামির অভিনয় করছে পুলিশকে ধোঁকা দিতে এবং আত্দহত্যারও তার আদৌ কোনো পরিকল্পনা ছিল না। একটু খোঁজখবর নিয়েই পুলিশ পুরো ঘটনা বের করে ফেলে। নিহত রীমা ছিলেন শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদের (১৯৭১-এ ইত্তেফাকে কর্মরত) মেয়ে। অন্যদিকে খ্যাতনামা ডাক্তার বাবা-মায়ের ব্যবসায়ী ছেলে ছিলেন মনির হোসেন।বিয়ের পরও মনির রীমাকে কোনো দিনই মন থেকে মেনে নেননি। বরং তিনি সম্পর্ক রেখেছেন খুকুর সঙ্গে। খুকু-মুনীরের এ অবাধ সম্পর্কের মধ্যে রীমাকে উটকো ঝামেলা হিসেবে বিবেচনা করে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ এপ্রিল স্ত্রী শারমিন রীমাকে হত্যা করেন মনির হোসেন। ঘটনার পরদিন তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৯০ সালের ২১ মে ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি এই মামলায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হোসনে আরা বেগম খুকু পরে হাইকোর্ট থেকে খালাস পেলেও মনিরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে অনুমোদন দেন উচ্চ আদালত। এরপর দীর্ঘদিন মামলা চলার পরে নিম্ন আদালতে অপরাধী মুনির হোসেন এবং হত্যাকাণ্ডে প্ররোচনাদানকারী তার প্রেমিকা হোসনে আরা খুকু দুজনেরই ফাঁসির রায় হলেও উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের রায়ে খুকুকে খালাস দেওয়া হয়। ১৯৯৩ সালের ২০ জুন আপিল বিভাগ ওই দণ্ড বহাল রাখে।
দ্বিতীয় ঘটনার সময়কাল ২০১৬ । ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। খুনিরা গুলি করার পাশাপাশি ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। ঘটনার সময় বাবুল আক্তার ঢাকায় ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার নিজে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। এ ঘটনায় বুধবার ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয় পিবিআই। প্রতিবেদনে পিবিআই বলছে, মিতু হত্যা ছিল কন্ট্রাক্ট কিলিং। বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় এটি সংঘটিত হয়। মিতুকে হত্যার জন্য তিন লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে তার জানান। মামলায় মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করেছেন, গায়েত্রী নামে জনৈক ভারতীয় এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে দাম্পত্য কলহ থেকে বাবুল নিজেই তার স্ত্রীকে খুনের পরিকল্পনা করেন ও নির্দেশ দেন। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের কর্মকান্ডে রীতিমতো হতাশ হয়েছি। তার তিন লক্ষ টাকার কিলিং মিশন প্রায় সফলই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষমেষ তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে নানা অপ্রিয় সত্য।
পরকীয়া-দাম্পত্য কলহ- হত্যা এ যেন এক চক্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক কলহের চেয়েও হত্যাকান্ডের মূলে রয়েছে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক বা পরকীয়া। দাম্পত্যে পরকীয়া কখন জায়গা করে নেয়, যখন দাম্পত্য যখন আস্থা হারায়। কেউ একজন বা উভয়-ই অসুখি বা অখুশি। তো যখন বৈবাহিক চুক্তি ঠিকভাবে পূরণ করা হচ্ছে না তখন নিশ্চয় স্বামী বা স্ত্রী উভয় মিলে উদীয়মান সমস্যা সমাধানের পথে এগোনো। সেটা না করে কিলিং মিশন বেছে নিতে দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যম জুড়ে।
বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক একটা সময় ছিলো সমাজের টিউমার সদৃশ। এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার । সবাই মুখে মুখে পরকীয়াকে ঘৃণা করা, আর মনে মনে … । কিলিং মিশনের চেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ কি যথেষ্ট সম্মানজনক এবং নিরাপদ নয়? প্রশ্ন করতে পারেন কেন ছেড়ে দিবো/ছেড়ে আসবো। বেঁচে থাকার স্বার্থে কিংবা বাঁচিয়ে রাখার আন্তরিকতায়। চোখের উপর দেখতেই পাচ্ছেন ‘প্রেম আজ কেবল শারীরিক সংঘর্ষ। বিবাহ এক সুবিধাজনক সাময়িক চুক্তি’ যদিও নিজের পরিচিত সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া কঠিন। তবু সংসার তো সংসার তো সিংহাসন নয় যে ঢিট হয়ে বসে থাকতে হবে। শারীরিক অসুস্থতা সারাতে যদি ওষুধ বদলাতে পারেন, তবে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্যকলহ বয়ে না বেড়িয়ে চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনে দেখতে পারেন।
বিবাহবিচ্ছেদকে অনেক সময়ই আমাদের কাছে খারাপ মনে হয়। অথচ কখনো কখনো বিবাহবিচ্ছেদ না করাটাই বরং খারাপ। বিবাহবিচ্ছেদ না করে অবদমনের নামে এদেশে দ্বিচারিতাকে বেছে নেয়া হয়। সামাজিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে হবে এমন বোধ নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। অথচ দাম্পত্য সম্পর্কে কিভাবে সামলাতে হবে বা কখন আমাদের থামতে হবে এমন কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয় না। শুধু মেনে নিতে গিয়ে কিংবা মানিয়ে নিতে গিয়ে আমরা নাকাল হয়ে যাই।
অবশ্যই দাম্পত্য সম্পর্ককে সজীব রাখতে হবে, দূষণমূক্ত রাখতে হবে। তবে যে সম্পর্কে একধরণের মানসিক কারাগার হয়ে ওঠে তা থেকে বের হওয়ার কৌশলও রপ্ত করতে হবে। মিররিং বা মনের আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে সমীকরণটা মেলাতে হবে। আমি ভালো আছি তো? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা জানা গেলে, সমাধানটাও আপনা থেকেই বের হয়ে আসবে। যে সম্পর্ক সবসময় নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আপনাকে পাপেট বানিয়ে ফেলে সেই দাম্পত্যে আর যা কিছুই থাকুক না কেন, পারস্পারিকতা নাই। জীবনের লম্বা পথে কখনো বাঁক পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে তা করাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ।
জীবন দক্ষতার শিক্ষা নিয়ে উন্নত বিশ্বে নানা আলাপ আছে। জীবনে না বলা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা, ভুল শুধরে নেয়ার কৌশল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিৎ সেটা নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা। জীবন দক্ষতার শিক্ষা জীবনের ভোগান্তি কমায়। ‘দেখি না কি হয়’ কিংবা ‘আরেকটু সময়’ নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে বলে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সপে দেয়ার স্বাধীনতা আপনার অবশ্যই আছে, এতে করে শেষ পর্যন্ত যা হয়; জীবনের সময় চলে যায়।
পঙ্গু দাম্পত্যকে কেউ কেউ বয়ে বেড়ায়, কেউ কেউ থামিয়ে দেয়। যারা বয়ে বেড়ায় তাদের মধ্য অধিকাংশ তাদের জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটান। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাতে ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় কেবল। যাকে ভালোবাসতে পারেন না এক বিছানা শেয়ার করা মানে, নিজেকে ঠকানো। পঙ্গু দাম্পত্য জীবনের নানা দরজা- জানালা বন্ধ করে রাখে। যে সম্পর্ক বিরামহীন ভাবে স্ট্রেসে রাখে তার সমাপ্তি প্রয়োজন। এতে করে ব্যক্তি নিজেকে ভালো রাখতে পারে। নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার সময় পায়।
অনেকে সন্তানের দোহায় দিয়ে নিজেকে বোকা বানান। এই অসুস্থ দম্পতির সন্তাররা প্রতিনিয়ত হতাশার মধ্যে থাকে। বাবা-মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন বাচ্চারা দ্রুত বুঝে ফেলে কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারে না। কিন্তু নিজের ভেতরে ভেতরে একটা অসুন্দর শৈশব বয়ে বেড়ায়। কোন কিছু মচকে থাকার চেয়ে ভেঙ্গে গেলে তাতে যন্ত্রণা কিছুটা কম হয় বৈকি। অন্তত সন্তানরা একটা সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে শেখে। অন্তহীন মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে সমাপ্তি হোক সমাপ্ত।
বৈবাহিক সম্পর্কে ইতি টানার আগে যে বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া জরুরি সেটা হলো, আপনি আপনার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটা করেছেন কিনা। মনে রাখবেন, একজীবনে আপনার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য আছে। পৃথিবীতে যে কোনো বিষয়ের সারাংশ বা সারমর্ম হলো ‘মহাবিশ্ব কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যেই আবর্তিত’। আমরা সবাই হয়তো সবকিছু পারি না, কিন্তু নিজের জন্য নিজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ করতে পারাটাই হচ্ছে - থিওরি অফ এভরিথিং।
বিচ্ছেদও একটা সমাধান, কখনো কখনো ভালো সমাধান…
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২১ দুপুর ১২:৪৮