কিছু কিছু পেশা থাকে, যেসব পেশায় প্রাপ্তির চেয়ে দানটাই মুখ্য। দান মুখ্য বলেই সেসব পেশাকে মহান পেশা বলা হয়। সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে আসীন করা হয়। শিক্ষকতা, চিকিৎসাসেবা- এগুলো তেমন পেশা।
দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই এসব পেশায় নাম লেখাতে হয়। শিক্ষকতা পেশায় যিনি আসবেন, তাঁকে ধরেই নিতে হবে, এ পেশায় অর্থযোগ কম। সম্মান ও পুণ্যযোগ বেশি। তাই বলে শিক্ষকরা কী উপোস থাকবেন? তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়া কি তাঁরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরবেননা? অবশ্যই ধরবেন। তবে তাঁদের সেই দাবিদাওয়া তুলে ধরার পদ্ধতি কোনোভাবেই পরিবহন শ্রমিক কিংবা গার্মেন্টস কর্মীদের মত হবেনা। হবে শিক্ষকসূলভ। এখানেই অশিক্ষিত কিংবা অল্পশিক্ষিত গার্মেন্টস কর্মী এবং একজন শিক্ষিত শিক্ষকের মধ্যে তফাৎ।
ডাক্তারদের বেলায়ও এই কথাগুলো প্রযোজ্য। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একাংশ যখন অনেক প্রতিযোগিতা পেরিয়ে মেডিকেলে পড়তে যান, তাঁদের নিশ্চয়ই জানা থাকে এ দেশে কয়েক হাজার রোগীর জন্যে একজন মাত্র ডাক্তার নিয়োজিত থাকেন। রোগীদের উপকার করাটা ডাক্তারের কাজ। ভুল চিকিৎসায় কিংবা বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা গেলে সমস্ত দায়দায়িত্ব ডাক্তারদের ঘাড়েই বর্তাবে। পক্ষান্তরে একজন সুস্থ হয়ে ওঠা রোগী এবং তাঁর পরিবারের সমস্ত শুভকামনাও কিন্তু একজন ডাক্তারই পান।
যাক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। যে কথাগুলো বলতে চাইছি-
১. ডাক্তারী পড়ার জন্যে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে খরচ হয় আনুমানিক ২০ লাখ টাকা। সরকারি মেডিকেল কলেজে লাগে সর্বসাকুল্যে ২ লাখ টাকারও কম (টাকার অংকে কিছুটা ভুল থাকলেও থাকতে পারে)।
যদি ধরে নিই- বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের মুনাফা ৫০%।
তাহলেও একজন ছাত্র ডাক্তার হয়ে বেরুতে গেলে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়। এটাই প্রকৃত খরচ। সেক্ষেত্রে সরকারি মেডিকেল কলেজে যিনি পড়ছেন তাঁর পেছনেও খরচ ১০ লাখ। কিন্তু তিনি দিচ্ছেন ২ লাখ। বাকি ৮ লাখ টাকা কোথা থেকে আসছে? এটা নিশ্চয়ই ভর্তুকির টাকা অর্থাৎ জনগণের টাকা। যেই জনগণের চিকিৎসা করার জন্যে প্রতিটি ছাত্র ৮ লাখ টাকা অগ্রিম উদরস্থ করে পাস করে বেরুচ্ছেন, সেই জনগণের কাছে ওই ডাক্তারের আজীবন দায়বদ্ধতা থেকে যায়।
২. ঢাকা মেডিকেল কলেজে কিছু ইন্টার্নী ডাক্তারের সাম্প্রতিক আচরণে সাধারণ মানুষ মনে করতেই পারে, এরা নিজেদের অতি উচ্চশ্রেণীর মানুষ ভাবেন। তাঁদের তারুণ্যের প্রাণচাঞ্চল্য প্রায়ই সন্ত্রাসে পরিণত হচ্ছে। এক ব্লগে এক ডাক্তার লিখেছেন, ১ বছর তাঁরা নাকি নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তাঁরা আসলে কি চিকিৎসা দেন নাকি অন্যের মাথার চুল কেটে নাপতালি শেখেন এ প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। ল্যাবরেটরিতে মৃত মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে শিক্ষালাভ করে তাঁদের ডাক্তারী জ্ঞান পূর্ণতা পায়না বলেই সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া জীবিত দরিদ্র মানুষের ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালানোর সুযোগ পান তাঁরা। এখানেও জনগণের ওই রুগ্ন শরীরগুলোর কাছে তাঁদের চিরঋণী হয়ে থাকা উচিত।
৩. পুলিশ, সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের মত মানুষের জীবন মরণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কিছু পেশায় যতই বঞ্চনা থাকুক- দাবি আদায়ে কাজ বন্ধ করে দেবার মত ঘৃণ্য পদ্ধতি ডাক্তার ছাড়া আর কেউ অবলম্বন করেননা। আমরা কি একবার ভাবতে পারি, বেতন-ভাতা বাড়ানো কিংবা অন্য দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে দেশের পুলিশ সদস্যরা ধর্মঘট ডেকেছে! সেনাবাহিনীর সদস্যরা কর্মবিরতি পালন করছে! ভাবতে পারিনা। এমন কখনোই হয়নি। কিন্তু এই কাজটি ডাক্তাররা হরহামেশাই করে চলেছেন।
বাস্তবতা বিবেচনায় এই দেশে কোনো সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঘন্টায় ৩০ জন অথবা তারও বেশি রোগী দেখতে হবে। সব দাবিদাওয়া পূরণ না হলেও বছরের সমস্ত কর্মদিবসে রোগী দেখার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মানুষের জীবনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে এই পেশায় সবচেয়ে বেশি জবাবদিহিতার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে। তথ্য স্বাধীনতার এই যুগে চিকিৎসা বিভাগের মত জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোতে শুধু মিডিয়া কর্মীই নয়, সব ধরণের মানুষের জন্যে তথ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। তৈরি থাকতে হবে মানুষের যে কোনো জিজ্ঞাসার জবাব দেবার জন্যে।
অন্যথায় দেশের মানুষের ৮ লাখ টাকা করে উদরস্থ করা বন্ধ করুন। সাদা এ্যাপ্রনের ভেতর একেকটা পশু পুষে রেখে আপনারা ডাক্তার না-ই বা হলেন। মানুষ কোনো না কোনো বিকল্প খুঁজে নেবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




