somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিরন্তর : ১ম - ৫ম পর্ব (অখন্ড পোস্ট - ১)

২৫ শে জুন, ২০০৮ রাত ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

**পাঠকের সুবিধার কথা ভেবে নিরন্তর-এর প্রথম আট পর্ব এখানে এক সাথে দেয়া চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এত বড় পোস্ট এ্যালাওড না। অতএব প্রথম পাঁচ পর্ব এখানে দেয়া হলো।**

এক

“আমাকে সব সময় এভাবে ভালোবাসবেতো?”

শুয়েশুয়েই মনিকা জিজ্ঞেস করলো আকাশকে। জিন্সের বোতাম লাগাতে লাগাতে আকাশ তাকালো মনিকার দিকে। উঁপুড় হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। পাতলা চাদরে পুরো শরীর ঢাকা। ফর্সা কাঁধ দেখা যাচ্ছে। যেন কোন দেবীর প্রতিমূর্তি।

আকাশ হেসে বলল, “কেন, সন্দেহ আছে নাকি?”
মনিকা বাচ্চাদের মত হেসে বলল, “নাহ। তা নেই। আমি জানি তুমি শুধু আমার।”

ঘড়িতে তখন রাত প্রায় দশটা। মনিকার বাবা-মা সিঙ্গাপুর গিয়েছেন। সেই সুযোগের সদ্বব্যবহারে আজকের এই অভিসার। আকাশ মনিকার কপালে নাক ঘষে দিয়ে বলল, “আমি এখন আসি। তোমাকে উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো। আর মনে করে রাতে কিছু খেয়ে নিও। এত ডায়েট কন্ট্রোল করতে হবে না। এমনিতেই যতটুকু সেক্সি আছো, তাতেই আমার চলবে।” শেষের কথাটা বলতে বলতে আকাশ হাসছিল। মনিকা বেড়ালের মত উঠে এসে ওকে একটা হাগ দিয়ে দিল।

রাস্তায় বের হয়ে মোবাইলটা অন করলো আকাশ। একটার পর একটা মেসেজ আসা শুরু হয়েছে। খুলে যে পড়বে সে সময়টাও পেলো না, তার মাঝেই ফোন। চোখে-মুখে বিরক্তি আর গলায় ভালোবাসা নিয়ে আকাশ ফোনটা ধরলো, “হাই হানি।”
মধুতে কাজ হলো বলে মনে হলো না। অন্য প্রান্তে তখন রিমির চিৎকার শোনা যাচ্ছে। “কোথায় ছিলে তুমি? আমি গত চার ঘন্টা মোবাইলে কল করার চেষ্টা করছি তোমাকে? ফোন বন্ধ ছিল কেন?”
“সজিবের বাসায় ছিলাম। আড্ডা দিচ্ছিলাম। মোবাইল যে চাপ লেগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দেখিনি।” এক নিঃশ্বাসে আকাশ বলে ফেললো।
“ওহ, আচ্ছা।” রিমির গলা একটু শান্ত শোনালো। “আমি দুঃশ্চিন্তা করছিলাম। প্লিজ, এভাবে মোবাইল বন্ধ করে রাখবা না। আমার অস্থির লাগে খুব।”
আকাশ গলায় আবেগের সমুদ্র এনে বলল, “আই এ্যাম পারফেক্টলি অলরাইট হানি। এভাবে চিন্তা করতে হয় না। আজ না হয় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অন্য কোন দিন হয়তো নেটওয়ার্ক থাকবে না। তাতে এভাবে দুঃশ্চিন্তা করে কেউ? পাগলী!”
রিমি হাসছিল। অবিকল মানিকার মত। তার পর বলল, “তুমি আমায় সব সময় ভালোবাসবেতো আকাশ?”
“কেন, সন্দেহ আছে নাকি?”
“নাহ। তা নেই। আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।” তার পর ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রিমির আদর করার শব্দ আসতে লাগলো। খুব শীগ্রই আকাশও যোগ দিল ভালোবাসা বিনিময়ের এই নব্য পদ্ধতিতে।

নিরব রাতে এক অভিসার থেকে বের হয়ে, ফোনে আরেক অভিসারিনীকে চুম্বনে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আকাশ। কী অদ্ভুত! বঙ্গ দেশে এখন ভালোবাসার মানুষকে যতটা চুম্বন দেয়া হয়, তার থেকে অনেক বেশি দেয়া হয় মোবাইল ফোনকে। কে যে আসল প্রিয়া, মাঝে মাঝে বোঝা কষ্টকর হয়ে দাড়ায়।

দুই

আকাশের বাসায় আসতে আসতে রাত প্রায় বারোটা। মিসেস আশরাফ, অর্থাৎ আকাশের মা তখনও জেগে ছিলেন। কিছু বললেন না। শুধু দেখলেন। দু’বছর আগেও এত রাত করে আকাশ বাসায় ফিরতো না। ছেলেটা বদলে যাচ্ছে। খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নাকি সময়টাই এমন? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন।

নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল আকাশ। সিগারেটের প্যাকেটে মাত্র দুইটা সিগারেট। মেজাজটা প্রায় বিগড়ে এসেছিল, তখনই MSN-এ সজীব নক করলো।

“কি রে? কোথাই ছিলি সারাদিন।”
“কেন? তোর জেনে কি হবে?” বিরক্তিটা কি চ্যাটে প্রকাশ পেল? মনে হয় না।
“নাহ। আমার জানারও দরকার নেই। আমাকে তোর নুতন কালেকশন, ঐ যে কি নাম, শ্রাবনী। ফোন দিয়েছিল। তোর নাকি ফোন বন্ধ ছিল।”
আকাশ বিরাক্তবোধ করতে শুরু করলো। এখন শ্রাবনী যদি ফোন দেয়, তাহলেই হয়েছে। এই মেয়েটা এত কথা যে কেন বলে! তবুও সম্পর্ক রাখতে হয়। ফিগারটা বেশ।

আকাশ লিখলো, “বাদ দে এসব। তুই কি করিস?”
“চ্যাট করি, আর কি করবো? তোর মততো আর মেয়েদের সাথে...”
কথাটা সজীব শেষ করেনি। আকাশের লাগলো খুব। বলল, “অর্ধেক কথা বলবি না। পুরোটা বল। কি করি আমি?”
সজীব হাসছে। স্ক্রিনে অট্টহাসির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আকাশের মেজাজ আরো খারাপ হলো। লিখলো, “যাই করি, সরাসরি করি। তোর মত নপুংসকতো না যে বসে বসে চ্যাটে করবো মেয়েদের সাথে।”
সজীবের হাসি মনে হয় আরো বেড়েছে। আজব ধরনের একটা স্মাইল-সাইন দিয়েছে এখন। তার পর লিখলো, “আচ্ছা, ঝগড়া বন্ধ কর। কনফারেন্স করবি? আমার এক বন্ধু, ফারজানা অনলাইনে আছে। ইংল্যান্ডে পড়ছে। যদিও তোর টাইপ নাহ।”
যত বিষয়েই অরুচী থাকুক, নারী বিষয়ে আকাশের এখন আর অরুচী নেই। কোথাও সুযোগ হলেই হলো। আকাশ, আকাশের মত বৃহৎ হৃদয় নিয়ে হাজির হয়ে যায়।

কনফারেন্সে যোগ দিল আকাশও। সজীব পরিচয় করিয়ে দিল দুজনকে। ফারজানাকে বেশ অড়ষ্ঠ মনে হলো। কথা খুব একটা বলে না। তাতে আকাশের সমস্যা নেই। বোবা মেয়েও আকাশের সাথে দুদিন ঘুরলে তৃতীয় দিন কথা বলে ফেলবে। টুকটাক কথা হচ্ছিল। হঠাৎ সজীব সাইন আউট হয়ে গেল। আকাশ-ফারজানা কেউই বুঝলো না ব্যাপারটা কি হলো। একটু পরই এস.এম.এস আসলো সজীবের। “দোস্ত। ইলেক্ট্রিসিটি গন। তোরা কথা বল। আমি পরে আসবো। দেখিস, উল্টাপাল্টা কিছু বলিস না যেন।”

আকাশ পুরো এস.এম.এসটাই চ্যাটে তুলে দিল। এটা একটা ট্রিক্স। মেয়েটা হয়তো এখন বলবে, “আপনি উল্টাপাল্টা কথাও বলেন নাকি? আমার সাথে সাবধান। আমি কিন্তু একটা সীমার পর আর সহ্য করি না।” আকাশ ভালো করে জানে এটা মেয়েদের একটা আহবান। ঐ সীমাটা যে আসলে কোথায় সেটা জানার জন্য ছেলেটা ব্যাকুল হবে। সে সীমা ছাড়াতে চাইবে। মেয়েটাও বলতে থাকবে এখনও সীমা ছাড়াও নি। চলতে থাকবে এই সীমা ছাড়ানোর খেলা। শেষ পর্যন্ত খেলাটা কোথায় গিয়ে থামে সেটা মনিকার বাসা থেকে ফিরতে ফিরতে প্রমান পেয়েছে আকাশ।

কিন্তু অবাক হলো। এই মেয়েটা সেরকম নয়। আকাশের পাতা প্রতিটা কথার ফাঁদ এড়িয়ে যাচ্ছে সাবধানে। আকাশেরও মজা লাগছিল। সহজে ধরা না দেয়া পায়রা আকাশের বেশি পছন্দ। যেন ক্লান্তিতেই তৃপ্তি।

আকাশ লিখলো, “আপনি কোথায় আছেন এখন?”
“ম্যানচেস্টারে। আপনি?”
“আর কোথায়, প্রিয় নগরী ঢাকায়।”
“প্রিয় নগরী? বাহ। শুনতে বেশ ভালো লাগলো।”
“তাই নাকি? তবে এই প্রিয় নগরীতে প্রিয়ার বড় আকাল। ভাবছি ম্যানচেস্টারের দিকে নজর দিব”
“বেশতো। এখানে অনেক বাঙালী আছে। খুঁজে দেব পরে।”
“আপনি বাঙালী না?”

হাসির চিহ্ন আসলো। কিন্তু তার পরপরই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো মেয়েটা।
“কি পড়ছেন আপনি?”
“টেলিকমিউনিকেশন।”
“ওহ! সবাই পড়ে মনে হয় এখন।”
“কেন? আপনার আরো বন্ধু আছে নাকি যারা টেলিকম পড়ে?”
“নাহ। আমার অত বন্ধু নেই। তবে মানুষের কাছে শুনি। এখন নাকি দেশে সবাই টেলিকম পড়ে। আগে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তো। এখন টেলিকম। এটা নাকি একটা ক্রেজ।”
“ক্রেজ কি না জানি না। তবে সবাই পড়ে তাই আমিও পড়ি। আসলে দেশের তরুন সমাজ এখন এটাই পড়ে।”
“মানে?”
“মানে টেলিকমিউনিকেশন। যে যাই পড়ুক এই বিদ্যাটা সবার জানা আছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়া লাগে না এটা জানতে।”
মেয়েটা মনে হয় হাসছে। অন্তত লেখায় তাই বোঝা গেল। “আপনিতো বেশ মজার মানুষ। মজা করে কথা বলেন।”
“কথা আর কই বললাম? এভাবে লিখে লিখে কি আর কথা বলা যায়। আপনার হেড ফোন আছে?”
“বাহ‍! প্রথম দিনেই হেডফোনে চলে গেলেন। কাল মনে হয় ওয়েবক্যামও অন করতে বলবেন।”
“কাল কেন? থাকলে আজই নয় কেন?”
ওদিক থেকে হাসির চিহ্ন আসছে। ফারজানা লিখলো, “নাহ। হেডফোন বা ক্যাম। কোনটাই নাই। আর থাকলেও দিতাম না।” তার পর একটা ভেংচিকেটে দিল চ্যাট বক্সটা।
আকাশ কি বলবে ভাবছিল, কিন্তু ওদিক থেকে ফারজানার লেখা ভেসে এলো, “আজ আমি উঠছি। মা ডাকছে। পরে আবার দেখা হবে। চাইলে এ্যাড করে রাখতে পারেন।” আকাশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফারজানা সাইন আউট করে ফেললো।

আরো কিছুক্ষন পর MSN-এ এ্যাড করতে করতে আকাশ মেয়েটার আইডিটা দেখছিল – kanna86 ।

তিন

পরদিন আকাশের ঘুম ভাঙলো শ্রাবনীর ফোনে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, “কি খবর জান”।
শ্রাবনী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। স্বরটাকে একটু বাঁকা করে বলল, “কি খবর জান? কাল সারা রাত কোথায় ছিলে?”
আকাশ যেন আকাশ থেকে পড়লো এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলো, “কেন? বাসায়? আর কোথায় থাকবো?”
“আমি তোমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি বহুবার, কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ ছিল।”
“ওহ! আমি বন্ধুদের সাথে ছিলাম। মনে হয় নেটওয়ার্ক ছিল না। আজকাল এত বিটিএস হয়েছে যে ইন্টার-ইন্টারফিয়ারেন্সের মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক আরেকটা নেটওয়ার্কের সিগনাল নষ্ট করে দিচ্ছে।”
শ্রাবনী রীতিমত চিৎকার করে উঠলো। “আমাকে তুমি টেলিকমিউনিকেশনস শেখাও? টেলিকম শুধু তুমি একাই পড়ো না, আমিও পড়ি। তাছাড়া আমি সজীবকেও ফোন দিয়েছিলাম। ওতো বলতে পারলো না তুমি কোথায়। কোন বন্ধুদের সাথে ছিলে?”
আকাশ বুঝে ফেললো এখন একটা চিৎকার দিতে হবে। তার পর একটু আবেগ, দুঃখ-দুঃখ ভাব এবং সব শেষে কাদোঁকাদোঁ গলা। এটা হচ্ছে ওর সর্বশেষ চিকিৎসা। মোক্ষম। কাজ না দিয়ে পারেই না।
শ্রাবনী আরো কি যেন বলতে গিয়েছিল। আকাশ চিৎকার করে বলল, “ইনাফ ইজ ইনাফ শ্রাবনী।” হঠাৎ ধমক খেয়ে শ্রাবনী চুপ হয়ে গেলো। আকাশ বুঝলো ওষুধে কাজ দিচ্ছে। দ্বিতীয় পর্ব এখনই প্রয়োগ করতে হবে না হলে প্রথম পর্বের রি-এ্যকশন নষ্ট হয়ে যাবে। গলায় যতটা পারা যায় আবেগ এনে আকাশ বলল, “তোমার কি মনে হয় আমি যখন দূরে থাকি তখন খুব ভালো থাকি? তোমাকে আমার মনে পড়ে না? ছিলামতো বন্ধুদের সাথে কিন্তু মন পড়েছিল তোমার কাছে।” এর পর কিছু সময় দুজনই চুপ। আকাশ বুঝলো তৃতীয় অর্থাৎ দুঃখ ভরা পর্বের সময় এসেছে। গলায় চরম আদ্রতা এনে বলল, “কখনও কি আমার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখেছো স্ক্রিনে কার ছবি সেট করা আছে? কখনও কি আমার রিংটোনটা শুনে বোঝার চেষ্টা করেছো কেন এই বিশেষ গান আমার রিংটোন? করোনি।ভালোবাসার অর্থ কিন্তু শুধুই পাশে থাকা না। আরো অনেক কিছু। আমার মোবাইলের স্ক্রিনে যখন আমি তোমার ছবিটা দেখি, আমি অনুভব করি তোমাকে আমার মাঝে। তোমার প্রিয় গান যখন আমার রিংটোন হয়ে বাজে, আমার মনে হয় আমি তোমার হয়ে গানটা শুনছি।”

শ্রাবনী পাথরের মত নিরব হয়ে আছে। কোন কথা বলছে না। আকাশ বুঝলো চুড়ান্ত ওষধ প্রয়োগের সময় চলে এসেছে। পারলে কেঁদে ফেলে এভাবে বলল, “কাল রাতে খুব শরীর খারাপ লাগছিল । পেটে গ্যাস হয়েছিল মনে হয়, তাই বুকে ব্যাথা করছিল। ভাবছিলাম যদি তুমি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।”
“ফোন দিলে না কেন?” শ্রাবনীর গলাও ধরে এসেছে। “অন্তত আমি ফোনেতো থাকতে পারতাম তোমার সাথে।”
“ফোন দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু রাত অনেক ছিল বলে দেইনি।” উত্তরটা আকাশের প্রস্তুতই ছিল। শুধু বলার বাকি ছিল।
“নাহ জান। এর পর শরীর খারাপ লাগলে বা আমাকে মনে পড়লে প্লিজ ফোন দিবে। আমি অনেক মিস করেছি কাল রাতে তোমাকে।” তার পর শ্রাবনী একটু খুশি খুশি ভাব নিয়ে বলল, “আজকের প্ল্যান মনে আছেতো?”
আকাশ দেখলো অবস্থা আবার খারাপ হচ্ছে। মনে পড়ছে না শ্রাবনীর সাথে কি প্ল্যান ছিল আজকে। তবুও বলল, “মনে না থাকার কি কোন কারন আছে? আমার সারা দিনের সব কাজ একদিকে থাকে আর তুমি আরেক দিকে থাকো।”
শ্রাবনীকে মোমের মত গলে যেতে শোনা গেল, “তুমি জানো আমি তোমাকে কেন এত ভালোবাসি? তোমার এই কেয়ারিং ভাবটার জন্য। উমমাজজ!” আকাশ তখনও ব্যস্ত প্ল্যানটা জানার জন্য। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
শ্রাবনীই আকাশকে বাঁচালো। বলল, “তুমি কিন্তু সন্ধা ছয়টার মধ্যে আমার এখানে চলে আসবে। আমাকে পিক করে তার পর বারিধারা ডি.ও.এইচ.এস-এর পেছনের রাস্তা দিয়ে রিজেন্সিতে চলে যাব।”
আকাশ যেন প্রানে পানি পেল। আজকে রিজেন্সিতে ডিসকো আছে। দুবাই থেকে নাকি ডিজে এসেছে। বেমালুম ভুলে গিয়েছিল পার্টির কথা। এখন বেশ হালকা বোধ করছে। ফুরফুরে মেজাজে আকাশ বলল, “তুমি কোন চিন্তা করো না। আমি ছয়টার আগেই চলে আসবো। বারিধারা ডি.ও.এইচ.এস দিয়ে না গিয়ে গুলশান দুই দিয়ে যাব। মুভ-এন-পিক-এ একটা নুতন ফ্লেভার এসেছে। তুমি টেস্ট না করলে কি আর অন্যরা খেতে পারে!” শ্রাবনী হাসছে। আইসক্রিম ওর খুব প্রিয়। আকাশ মনে মনে ভাবলো, “মেয়ে তুমি নিজেই একটা আইসক্রিম। কিভাবে গলে গলে যাচ্ছ আমার কথায়। দুঃখ, এখনও টেস্ট করে দেখতে পারলাম না।”

সন্ধায় আকাশ শ্রাবনীর একটা ছবি লাগালো মোবাইলের স্ক্রিনে। তার পর মৌসুমি ভৌমিকের ‘স্বপ্ন দেখবো বলে’ গানটা অনলাইন থেকে ডাউনলোড করে রিংটোন হিসেবে সেট করলো। সব প্রস্তুতি শেষে গেল মায়ের রুমে। মিসেস আশরাফ নামায পড়ে মাত্র উঠেছেন। মায়ের সাথে যোগাযোগের এটা হচ্ছে মোক্ষম সময়। বকা খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।

“কিছু বলবা?” একটু গম্ভির ভাবে জানতে চাইলেন মিসেস আশরাফ।
আকাশ হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমার উপর রাগ?”
“রাগ করার কোন কারন আছে?” যেন কিছুই হয়নি এভাবে বললেন তিনি।
“সরি মা। কাল রাতে ফিরতে দেরী হয়ে গিয়েছে। এমনটা আর হবে না।”
“হুম। এখন কোথায় যাচ্ছ?”
“বন্ধুদের সাথে একটা পার্টিতে। ডিজে এসেছে দুবাই থেকে।”
মিসেস আশরাফ কিছু বললেন না। পরবর্তি কথাটা তিনি অনুমান করে নিলেন। একটু কাচুমাচু করে আকাশ বলল, “মা, এক হাজার টাকা লাগবে। টিকেটের যা দাম।”
মিসেস আশরাফ কিছু না বলে উঠে গিয়ে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে আকাশকে দিলেন। আকাশ আবার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আই লাভ ইউ মা।” তার পর আস্তে করে বলল, “আজ ফিরতে একটু দেরী হবে। আজকেও মাফ করে দিও প্লিজ।”
মিসেস আশরাফ কিছু বললেন না। মনে মনে বললেন, “এ আর নুতন কি”।

আকাশ যখন বের হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি ডেকে বললেন, “অনিন্দিতাদের কোন খোঁজ জানো?”
আকাশ একটু অবাক হয়ে ঘুরে তাকালো। “হঠাৎ ওদের কথা কেন?”
“কে যেন বলছিল সেদিন, অনিন্দিতার বাবা মারা গিয়েছেন।”
আকাশ একটু গম্ভির ভাবে বলল, “ও!” তার পর বললো, “দুবছর আগেতো ওরা অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল। তার পর আর কোন খবর জানি না।”
“এভাবে মানুষ বন্ধুকে ভুলে যায়?” মিসেস আশরাফ আদ্র গলায় বললেন।
“কিছু কিছু মানুষকে ভুলে যাওয়াই ভালো।” রুষ্ঠ গলায় কথাটা বলেই আকাশ বের হয়ে আসলো মায়ের সামনে থেকে।

চার

আকাশ বসে বসে দেখছিল চারপাশের মানুষগুলোকে। রিজেন্সির একটা বিশেষত্ব হলো এখানে যারা আসে কেউ কারো দিকে নজর দেয় না খুব একটা, অথবা ভাব দেখায় দিচ্ছে না। যে যে যার যার মত নাচছে, কেউ কেউ বয়ফ্রেন্ডের কোলে বসে দুষ্টামী করছে, কেউবা আরো একটু বেশি! কিন্তু সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। আকাশকে বসিয়ে রেখে শ্রাবনী গিয়েছে ওর এক বান্ধবীর সাথে কথা বলতে। সেই সামান্য সুযোগেরও সদ্বব্যবহারে ব্যস্ত আকাশ।

“একটা মেয়েও কি সিঙ্গেল নাই নাকি?” মনে মনে ভাবলো সে। “কি আজব দুনিয়া। দেশে এত ছেলে কোথা থেকে আসলো?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো। তার পর ভাবলো সে নিজেইতো এখন আটটা মেয়ের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে এই খেলা। আগে ডাবল-টাইমিং বলে একটা শব্দ ছিল। এখন এ শব্দ আকাশদের দেখে লজ্জা পায়। মোবাইলের যুগে আটটা প্রেম করা খুবই সম্ভব। এখন এক্সপোনেনশিয়াল-টাইমিং এর সময়। স্কয়ার-টাইমিং, কিউবিক-স্কয়ার-টাইমিং ইত্যাদির।

হঠাৎ আকাশের চোখ পড়লো ডান দিকের ছেলেটার দিকে। ছেলে না বলে ‘লোক’ বলাই ভালো। বয়স ত্রিশের উপরে হবে। দেখে মনে হয় ডিফেন্সের অফিসার। অন্তত চুলের ধরন তাই বলে। এই লোককে বিশেষ ভাবে দেখার পেছেনে একটা কারন আছে। একে আকাশ গতকাল মনিকাদের বাসায়ও দেখেছিল। এক ঝলক দেখা, অতঃপর দুজনের চোখাচোখী। কিন্তু তাতেই আকাশ বুঝে নিয়েছিল এই লোক অন্য ধাতুতে গড়া। আকাশকে একা বসে থাকতে দেখে লোকটা বারবার তাকাচ্ছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করেছে কে এসেছে আকাশের সাথে। আকাশ উঠে হলরুমের অন্য প্রান্তে চলে আসলো। লোকটার হাবভাব আকাশের সুবিধার লাগছে না। পরে মনিকাকে গিয়ে বলে দিলে আরেক ঝামেলা।

শ্রাবনীকে খোঁজার চেষ্টা করলো আকাশ। দেখলো পাশের করিডোরে দাড়িয়ে ওর বান্ধবীর সাথে গল্প করছে। আকাশকে বের হয়ে আসতে দেখে শ্রাবনী বলল, “কী, আর অপেক্ষা সয় না।” আকাশ হাসলো। কিছু বললো না। শ্রাবনী আকাশকে পরিচয় করিয়ে দিল রিয়া, অর্থাৎ ওর বান্ধবীর সাথে। কথা সবে শুরু হতে যাচ্ছিল, তখনই রিয়ার মোবাইলে মিস কল আসলো। বোঝা গেল বয়ফ্রেন্ড মিস কল দিচ্ছে। রিয়া ওদেরকে সরি বলে চলে গেল।

আকাশ শ্রাবনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বান্ধবীকে পেয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছ, তাই না?”
শ্রাবনী ওর শরীরের ভার আকাশের উপর ছেড়ে দিয়ে বলল, “তাই মনে হয়? আজ এমন মজা বোঝাবো তোমাকে, সারা জীবন মনে থাকবে।” শ্রাবনীর দুচোখে দুষ্টামী। তার পরপরই বলল, “আমি টাকিলা খাবো।”
আকাশ হাসতে শুরু করলো। বলল, “টাকিলা তোমাদের জন্য না। আমি বিয়ার নিয়ে আসছি।”
“নাহ। আমি টাকিলাই খাবো। আমাকে রিয়া বলেছে দশটা শট যদি মারতে পারি, তাহলে নাকি পৃথিবীটা অন্য রকম লাগে।” শ্রাবনী হাসছে। হাসিতে খানিকটা মাতাল ভাব চলে এসেছে।
“টাকিলার নামেও কি নেশা হয় নাকি?” মনে মনে ভাবলো আকাশ। তার পর বারের দিকে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে ছোট ছোট গ্লাসগুলো দেখছো, ওটার এক শট মারলে তুমি তোমার পায়ে দাড়াতে পারবে না। তখন বাসায় কে নিয়ে যাবে?”
“আমি জানি না। আমি খাব, খাব, খাব।”
“আরে কি বিপদ।” আকাশ এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ঠিক আছে, তবে এক শট।”
শ্রাবনী বাচ্চাদের মত হেসে বলল, “আচ্ছা, এক শট।”
“প্রমিস?”
“প্রমিস।”

বার টেন্ডারকে টাকিলা অর্ডার করে আকাশ যখন ঘুরেছে শ্রাবনীর দিকে, তখন দেখলো সেই লোকটা হলরুম থেকে বের হয়ে এদিকে আসছে। আকাশকে দেখেনি তখনও। পথে একটা লোকের সাথে কথা বলছে। সম্ভবত এখানেই আসবে।

এর মাঝে আকাশদের টাকিলা চলে আসলো। শ্রাবনী সেটা নিয়ে ঢং করেতে শুরু করলো। আকাশের সেদিকে লক্ষ্য নাই। লোকটা আবার এদিকে আসতে শুরু করেছে। এবার আকাশকে দেখেছে। কি করবে দ্রুত চিন্তা করলো আকাশ। তার পর বারটেন্ডারকে বললো আরো আটটা টাকিলা দিতে। শ্রাবনী অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ চোখেমুখে দুষ্টামী এনে বলল, “দেখি তোমার তেজ কত।” শ্রাবনীও হাসছে, বেশ মজা পেয়েছে সে। তবে ঘুনাক্ষরেও বোঝেনি হঠাৎ করে আকাশের এই পরিবর্তন কেন।

লোকটা যখন বারটেন্ডারকে ড্রিংস্ অর্ডার করছে আকাশ তখন শ্রাবনীর হাতে একটার পর একটা টাকিলার গ্লাস ধরিয়ে দিচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে শ্রাবনী নিজের পায়ে দাড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। আকাশ আঁড় চোখে দেখলো লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ শ্রাবনীকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় একটু জোরেই বলতে লাগলো, “তোমার বয়ফ্রেন্ড অথবা আমার গার্লফ্রেন্ড যদি আমাদের এভাবে দেখে, কোন দিনও বিশ্বাস করবে না আমরা শুধুই কাজিন, তোমার জোরাজুরিতে পার্টিতে আসা। ভাববে আমাদের মাঝে চক্কর আছে।” বলাইবাহুল্য আকাশের একটা কথাও শ্রাবনীর কানে যাচ্ছে না তখন। শ্রাবনী হাসছে। উন্মাতাল হাসি।

লোকটার চেহারায় একটা হতাশা লক্ষ্য করলো আকাশ। যেন সে অন্য কিছু আশা করেছিল। ড্রিংস শেষ করে লোকটা যখন চলে যায় তখন আকাশ শ্রাবনীর মোবাইলটা বের করে প্লে-লিস্টটা দেখে। যা আশা করেছিল, ঠিক তাই। রিয়ার নাম্বারটা সেইভ করা হয়েছে। রিয়াকে একটা ফোন দিল আকাশ। রিয়া তখনও পাশেই ছিল। আকাশ দ্রুত রিয়াকে বারে আসতে বলল।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রিয়া বারে আসলো। শ্রাবনীর অবস্থা দেখে রিয়া হা হয়ে গেল। বলল, “কি হয়েছে ওর?”
“কে নাকি ওকে বলেছে দশ শট টাকিলা মারলে পৃথিবী অন্য রকম লাগে। আমি অনেক মানা করলাম। শুনলো না। তোমার বান্ধবী। জিদতো তুমি জানই।”

আকাশ ঘুনাক্ষরেও এটা রিয়াকে বুঝতে দিল না যে সে জানে দশ শট টাকিলার কথাটা রিয়ার থেকেই শুনেছিল শ্রাবনী। রিয়াও কিছু বললো না। তবে ওষুধে কাজ হয়েছে বোঝা গেল। রিয়ার মধ্যে অনুশোচনা হচ্ছে এখন। সে পানির ছিটা দিয়ে শ্রাবনীকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। আকাশ রিয়ার হাতে শ্রাবনীকে ছেড়ে দিয়ে করিডোরে বের হয়ে এলো। তার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে তাকিয়ে রইলো। গাড়ির লাল-সাদা আলোয় শহরটা রঙিন হয়ে আছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তখন নয়টার বেশি বাজে। রিয়ার সাহায্যে শ্রাবনীকে বাসায় পৌছে দিয়ে আকাশের বাসায় যেতে যেতে হয়তো আরো দুই-আড়াই ঘন্টা।

“আজও অনেক রাত হয়ে যাবে ফিরতে ফিরতে।” ক্লান্ত এবং অবসন্ন আকাশ হতাশ ভাবে আধ খাওয়া সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে মনে মনে ভাবলো।

পাঁচ

শ্রাবনীকে রিয়ার সাহায্যে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আকাশ বাসায় এসেছে। রাত তখন অনেক। কিন্তু আকাশ জানে ওর মা এখনও জেগে আছে। কয়েকদিন ধরেই আকাশ মায়ের মাঝে একটা পরির্বতন লক্ষ্য করছে। মা কিছু বলছে না বটে, কিন্তু যেন কোথায় একটা ভিন্নতা। আকাশ ঠিক ধরতে পারছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে ঠিকই।

রাতে সজীব ফোন দিল। “কি রে? আজকে ক্লাসে আসলি না কেন?”
আকাশ একটু গম্ভীর ভাবে বলল, “ইচ্ছে করছিল না।”
“বাহ! সেটা ইচ্ছে করবে কেন? এদিকে যে ফার্স্ট-মিডের খাতা দিয়েছে সেই খবর আছে?”
আগের মতই নির্লিপ্ত ভাবে আকাশ বলল, “কত পেয়েছি?”
“সাড়ে বারো।”
“ও!” যেন এটা কোন ব্যপারই না, এভাবে আকাশ বলল। তার পর যুক্ত করলো, “পরীক্ষা কতর ভেতরে ছিল?”
সজীব হাসতে হাসতে বলল, “সেটাও মনে নাই? আসলেই, তুই যে পরীক্ষা দিয়েছিস এটা স্যারের ভাগ্য। যাইহোক পরীক্ষা ত্রিশে ছিল।”
“আমাদের পাসিং মার্কস কত?” বিজ্ঞের মত আকাশ বলল।
“৬০%। এখন হিসেব করতে যাস না আবার যে তুই কত পেয়েছিস। তাহলে অংকেও ভুল করবি।”
খোঁচাটা মনে হয় না আকাশের গায়ে লাগলো। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করতে করতে বলল, “লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু থাকলে বল। না হলে ফোন রাখ।”
সজীব আবারও হাসতে শুরু করলো। বলল, “ফারজানার কি খবর? কেমন বুঝলি মেয়েটাকে?”
“নট মাই টাইপ।”
সজীব খোঁচা দিয়ে বলল, “একি শুনছি। লাভ-গুরু আকাশ বলে ‘নট মাই টাইপ’? তুই নাকি যে কোন মেয়েকে পটাতে পারিস?”
“সেটা পারি। কিন্তু এই মেয়েকে পটিয়ে লাভটা কি হবে? থাকেতো ইংল্যান্ডে।”
সজীব আরেকটা মোক্ষম খোঁচা দিয়ে বলল, “তাও ঠিক। ফারজানাকেতো আর বেডে আনা যাবে না। আর যাকে বেডে আনা যাবে না, তাকে পটিয়ে কি লাভ? ‘লাভ’ এর সব লাভতো বেডেই উসুল করতে হয়।”
খোঁচাটা আকাশের বেশ ভালই লাগলো। বলল, “আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি রাখলাম।”
ওদিক থেকে সজীব তাড়াতাড়ি বলল, “শোন শোন। যাই করিস, লেখাপড়ার মত গৌন কাজটাকেও একটু মূল্য দিস। মেয়ে পটানো শেষে সময় হলে কাল একবার ক্লাসে আসিস।”
আকাশ হাসতে হাসেতে বলল, “সজীব একটা কথা বলতো, তোর পরিবারের কেউ কি শিক্ষক ছিল কখনও?”
সজীব থতমত খেয়ে বলল, “না। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“তাহলে তোর মধ্যে এই উপদেশ দেয়ার ‘জিন’টা আসলো কোথা থেকে? আমারতো এখন তোর জন্ম নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে।”
সজীবকে কোন উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে আকাশ ফোনটা কেটে দিল। কাটার ঠিক আগ মূহুর্তে সজীবের বলা শেষ কথাটা আংশিক শোনা গেল, “কুত্তা….!”

আকাশের রুমে চাঁদের আলো এসে ছাদটাকে আংশিক আলোকিত করে রেখেছে। আকাশ শুয়ে শুয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল নিজের কথা। কোথায় যেন একটা তাল কেটে যাওয়া অনুভুতি। সবই আছে, তবু কি যেন একটা নেই। কোন মেয়েকে ভালো লাগলে তাকে পটানো আকাশের জন্য দু'দিনের কাজ। তবুও কেন এই অতৃপ্তি? সব পেয়েও বুকের মাঝে কিছু না পাওয়ার হাহাকার?

আকাশের মনে পড়ে অনিন্দিতার কথা। অনিন্দিতার হাসিটা খুব সুন্দর ছিল। প্রথম যেদিন ওদের দেখা, আকাশ মুগ্ধ হয়েছিল ওর হাসি দেখে। নিষ্পাপ মুখে কি অসম্ভব শুভ্রতা এনে দিত সেই হাসি। আজ সব কিছু কেমন দুঃস্বপ্ন। কেন এমন হলো? কেন এমন করলে অনিন্দিতা? নিজের মনেই আকাশ প্রশ্ন করে চলে। আকাশ অনুভব করে ওর পেশীগুলো শক্ত হয়ে আসছে। রক্তপ্রবাহে আবার ঘৃনা বইতে শুরু করেছে। এক জীবনে বুঝি এ ঘৃনার শেষ নেই, এত ঘৃনা।

আকাশ উঠে বসলো। সাইড-টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেল। খুব অস্থির লাগছে আজ। ইয়াবার নেশাটা আবার মাথায় উঠছে মনে হয়। এমন নয় যে আকাশ বাজে ভাবে এ্যাডিকটেড। মাঝে মাঝে মজা করে নিত। কিন্তু তাতেই মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে নেশাটা ওকে দখল করে নিচ্ছে। সরকার যে কি শুরু করলো। দেশ থেকে তারা ইয়াবা তাড়াবে। “এত কাজ থাকতে তারা ইয়াবার পেছনে পড়লো কেন?” মনে মনে ভাবলো আকাশ। যখন আকাশের খুব হতাশ লাগে, তখন এই একটা জিনিসই ওকে একটু শান্তি দেয়।

আকাশ শুনেছে কোন এক উপদেষ্টার মেয়ে নাকি ইয়াবা নিত। তাই সেই উপদেষ্টা দেশ থেকে ইয়াবা তাড়ানোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। “নিজের মেয়েকে সামলাতে পারে না, এখন আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছে।” মনে মনে ভাবলো আকাশ। ফেইসবুকে একটা গ্রুপ আছে, “তুই ইয়াবা খাবি খা, তাতে চিল্লায় কেন আমার মা।” আকশের ইচ্ছে করেছিল আরেকটা গ্রুপ খুলেবে, “আমি ইয়াবা খাইয়া করি পাপ, তাতে চিল্লায় কেন তোর বাপ।”

আকাশ বুঝলো ওর অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। মাথা কাজ করছে না। পৃথিবীর সবাইকে এখন ওর গালি দিতে ইচ্ছে করছে। অস্থির ভাবে নিজের মাথার দুপাশের শিরায় চেপে ধরে রইলো কিছু সময়। তার পর একটু স্বাভাবিক হয়ে আসার পর ভাবলো কিছু একটা করা দরকার। ইয়াবা থেকে মনটা সরাতে হবে। এই ইয়াবাই একদিন আকাশকে শেষ করে ফেলবে, আকাশ বুঝতে পারে, কিন্তু কিছু করতে পারে না। নেশার ইচ্ছাটা যখন প্রবল ভাবে আসতে থাকে তখন সব কিছু অসহ্য মনে হয়। কিন্তু কিছু একটা করা দরকার। ফোন দিবে কাউকে? কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। মেসেঞ্জারেও কেউ নেই। কি করা যায়? ভাবতে লাগলো আকাশ। তার পর চিন্তা করে দেখলো সপ্তাহখানেক ফেইসবুকে ঢোকা হয় না। দেখা দরকার বন্ধুরা কি করছে।

ফেইসবুকে ঢুকেই আকাশ দেখলো ‘হোম’-এ একটা নিউজ। Faria Khan went from being "in a relationship" to "single." আকাশ মনে মনে হাসলো। এরকম মেয়েদের পটানো সহজ হয়। সদ্য ‘ব্রেক-আপ’ হয়েছে। হৃদয় এখনও ভাঙ্গা। ভাঙ্গা হৃদয়ের ফাক গলে ভেতরে ঢোকা সহজ। তবে এই মেয়েটা যে কে, আকাশ মনে করতে পারলো না। এখন ফেইসবুকে একেকজনের হাজার খানেক বন্ধু। যে যাকে যেখানে পাচ্ছে, এ্যাড করছে। নিজেরাও জানে না আসলে সে কাকে এ্যাড করছে। ফারিয়াকে আকাশ কবে এ্যাড করেছে নিজেরই মনে নাই। কথাও মনে হয় হয়নি আগে। তবুও একবার নিজের ভাগ্যটাকে পরীক্ষা করার জন্য আকাশ চেষ্টা করলো। ফেইসবুকের নুতন সংযোজন ‘ফেইসবুক চ্যাট’ মেয়ে পটানোর কাজটা আরো সহজ করে দিয়েছে। আকাশ দেখলো ওর ভাগ্য আজ ভালই মনে হচ্ছে। ফারিয়া নামক এই সদ্য হৃদয় ভাঙ্গা মেয়েটা এখনও অনলাইনে আছে। আকাশ দেরী না করে নক করলো,

“হাই।”
প্রথমে কোন উত্তর নেই। আকাশ যখন হতাশ হয়ে আশা ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন ওদিক থেকে লেখা আসলো।“হাই। হুজ দিস!”
“আকাশ। সম্ভবত এটাই আমাদের প্রথম চ্যাট, তাই না?”
“তাই নাকি?”
“হুম।”
ওদিক থেকে কোন লেখা আসছে না। আকাশ নিশ্চিত এখন মেয়েটা কি করছে। সে আকাশের প্রোফাইল দেখছে। একটু পরেই সে অতি উৎসাহী হয়ে উত্তর দিবে। এই খেলায় আকাশের অন্যতম বড় অস্ত্র ওর চেহারা। এটা আকাশ খুব ভালো করে জানে।

একটু পরেই মেয়েটা আবার লিখলো।“ওহহহ! তুমি। হুম। আমরা অনেকদিন ধরে বন্ধু কিন্তু কোন দিন কথা হয় নাই। কেমন চলছে?”
“এই, কেটে যায় বসন্তের দিন।”
“আরেব্বাবা, কবি নাকি? চেহারা দেখেতো মনে হয় না।”
“তাই? চেহারা দেখে কি মনে হয়?”
“বলা যাবে না, অন্য কোন দিন বলবো।”
মেয়ে রহস্য করা শুরু করেছে। পটবে তাড়াতাড়ি, বুঝে নিল আকাশ।

এই কথা, সেই কথার মধ্য দিয়ে চ্যাট চলছিল। এর মাঝে ফারিয়ার ফেইসবুকের চ্যাটটা সমস্যা করছিল। লাইন স্লো মনে হয়। আকাশ বললো, যদি লুজার না ভাবো, তাহলে ফোন নাম্বার দিতে পারো।
“আরেব্বাবা, তুমিতো দেখি অনেক এ্যাডভান্স। প্রথম দিনেই ফোন নাম্বার চাচ্ছ। আর কয়জন থেকে এভাবে ফোন নাম্বার নিয়েছো?”
“ওহ, সরি।” যেন আকাশ যরপরনাই দূঃখিত! তার পর লিখলো, “আমি এভাবে ফোন নাম্বার চাই না। তবুও তোমার কাছে চাইলাম কারন চ্যাট করে ভালো লাগছিল। তোমার নেট স্লো হবার কারনে এখন সেটাতেও সমস্যা করছে। আই এ্যাম রিয়েলী সরি। এখানেই কথা বলো।”
“আরে ধুর। আমিতো মজা করলাম। নাম্বার দিচ্ছি। কল করো। 0161….”

************************************************
পরবর্তি তিন পর্ব - অখন্ড পোস্ট ২ (Click This Link)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০০৮ রাত ৯:২৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৬

হাদি কি লড়াকু সৎ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা ?

জুলাই আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতা ছিলেন না , তাকে কেউ চিনতো না কয়েক মাস আগে ও ।

জুলাই জংগীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩২

আগুন যখন প্রশ্নকে পোড়াতে আসে[

স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, মব-রাজনীতি ও এক ভয়ংকর নীরবতার ইতিহাস
চরম স্বৈরশাসন বা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেও সাধারণত সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার সাহস কেউ করে না। কারণ ক্ষমতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ৩০ দেশের দুষ্ট আমেরিকান রাষ্ট্রদুত বদলায়ে দিচ্ছে!

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২৩



আইয়ুব পাকিস্তানকে ধ্বংস করার পর, বাংগালীদের লাথি খেয়ে সরেছে; জিয়া, কর্নেল তাহের ও জাসদের গণ বাহিনী আমাদের দেশকে নরক (১৯৭৫ সাল ) বানিয়ে নিজেরা নরকে গেছে। আমাদেরকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×