আজ বেশ তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরেছেন আব্দুল হালিম। অন্যদিন বিকেল চারটা-পাঁচটা বেজে যায়। আজ যখন কলিংবেল চাপলেন তখন জোহরের আযান হচ্ছে। দরজা খুলে দিয়েই সূচনা জানতে চাইল—‘কি ব্যাপার, এত তাড়তাড়ি যে?’ তার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা।
‘কোনো ক্লাস ছিল না। ঈদের ছুটি সবে শেষ হলো। ছেলে-মেয়েরাও সব ফিরেনি। টুকটাক কাজ সারার পর অফিসরুমে একা একা ভাল লাগছিল না। বিরক্ত হওয়ার চেয়ে ভাবলাম বাসায় চলে যাই। চেয়ারম্যানকে বলতেই অনুমতি মিলে গেল।’—জামা-কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বললেন হালিম।
হেমন্ত পড়ে গেছে। বাতাসে শীতের আমেজ। ‘শরীর-টরীর খারাপ করেনি তো’—বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন সূচনা। মাথা নাড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করলেন হালিম।
একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান হালিম। সূচনাও শিক্ষক, কলেজের। ঈদের পর এখনো ওর কলেজ খুলেনি। আড়াই বছরের সংসার। বাচ্চা-কাচ্চা নেই। ঝাড়া হাত-পা। দুজনেই সকালে একসঙ্গে বেরিয়ে যান। সূচনা ফিরেন আড়াইটা-তিনটা নাগাদ। ছুটির দিন ছাড়া দুপুরের খাবারটা বলতে গেলে একসঙ্গে খাওয়াই হয় না। আজ অপ্রত্যাশিতভাবে সেই সুযোগটা পাওয়া গেল।
গোসল শেষে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেলেন হালিম। সূচনাও ততক্ষণে খাবার সাজিয়ে প্রস্তুত। খেতে খেতে নানা বিষয়ে কথা হচ্ছিল দুজনের। ‘ক্যাম্পাসে খুব বেশি লোক নেই। অনেকেই বাড়তি ছুটি নিয়েছে। কিন্তু যে কয়জন আছে দেখলাম সবাই একটা বিষয় নিয়েই কথা বলছে।’—ভাত মুখে তুলতে তুলতে বললেন হালিম।
—কি?
: গত রাতে বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রকাশিত দুই নেত্রীর ফোনালাপের অডিও।
— এমন একটা বিষয় নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
: মানুষ আলোচনা করবে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দুই শীর্ষ ব্যক্তির মধ্যে ফোনালাপ এভাবে প্রকাশ করাটা ঠিক হলো কিনা? এতে তো বিভেদ আরো বাড়বে।
—প্রকাশ না করলে কি বিভেদ কমতো? দুই পক্ষের বিরোধ যে পর্যায়ে পৌছেঁছে সেখানে এই ফোনালাপ প্রকাশ করা কিংবা না করায় কিছু যায় আসে না। প্রকাশ না করলে বরং নানা অপপ্রচারের জন্ম হতো। তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো।
: কিন্তু সব কিছুর তো একটা সিস্টেম আছে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রীকে ফোন করবেন, সরকার আগাম এ খবরটা জানিয়েছিল বটে, কিন্তু ফোনালাপ রেকর্ড করা হবে কিংবা তা মিডিয়ায় প্রকাশ করা হবে এরকম কিছু তো জানায়নি।
—সরকার তো এখনো বলছে যে তারা রেকর্ড করেনি। গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্যও দেয়নি।
: সরকার বলছে বটে, কিন্তু সেটা কয়জনে বিশ্বাস করছে? অনেকেই বরং মনে করছে, সরকারপক্ষ ইচ্ছা করেই কাজটা করেছে। সবকিছুই আগাম পরিকল্পনামাফিক হয়েছে। টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাব-বিরুদ্ধ ভাবে শান্ত থেকেছেন। কারণ জানতেন, এটা রের্কড হবে। পরে সেটা প্রচারও হবে। খালেদা জিয়া কিছুই জানতেন না। তাই তিনি স্বরূপেই থেকেছেন। আবার যখন প্রকাশ করা হয়েছে তখন সরকারপক্ষ তার বিরোধীতা করছে না। বলছে এই ফোনালাপ রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। জনগণের ভাগ্য নিয়ে দুই নেত্রীর মধ্যে কথা হয়েছে। জনগণের তা জানার অধিকার আছে।
কয়েকদিন আগেই কঠোর আইসিটি আইন পাস হয়েছে। সেখানে বলা আছে দুই ব্যক্তির মধ্যে টেলিফোনে কথোপকথন ফাস করা যাবে না। টেলিভিশনগুলোতে অডিওটা প্রচারের আগে তথ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দুই নেত্রীর আলাপ জনগণকে জানানো হবে। তারপরেই টেলিভিশনগুলো সেটা প্রচার করেছে। মানে টেলিভিশনগুলো সরকরপক্ষের সবুজ সঙ্কেত পেয়েই সেটা প্রচার করেছে। আবার প্রধানমন্ত্রী অনুমতি না দিলে তথ্যমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে ওই ঘোষণা দিতে পারতেন না। তারমানে সরকারের তরফে এট প্রকাশে কোনো বাধ ছিল না।
কিন্তু কথা তো হয়েছে দুই পক্ষে। বিএনপি এটা প্রকাশ করতে চায় কিনা সেটা তো জানা দরকার ছিল। প্রচারের আগে টেলিভিশনগুলো তাদের অনুমিত নেয়নি। যেটা সাংবাদিকতার নীতি মালায় পড়ে না। টেলিভিশনগুলো হঠাৎ কেন এমন আচরণ করবে। জেনে-বুঝে আইসিটি আইন লঙ্ঘনের দায় কেন নেবে তারা?
—যাই বলো না কেন, বিরোধী দলীয় নেত্রীর অমন আচরণ ঠিক হয়নি। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। আরেকজন প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করেছেন। ফোন যে করবেন এটাও আগে জানানো হয়েছে। তবে কেন দুপুরে ফোন ধরতে পারেননি। বললেন ফোন ডেড ছিল। কিন্তু উনি তো খবরটা জেনেছেন যে প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করছিলেন। তাহলে উনি ব্যাক করতে পারতেন। করেননি। তারপর সন্ধ্যায় যখন কথা হলো তখনো তিনি সংযত আচরণ করেননি। আক্রমণাত্মক ছিলেন। এভাবে কথা না বললেও পারতেন। যে রাজনীতি চলছে তাতে তার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
ফোনালাপ রেকর্ড হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা পরের কথা। প্রধানমন্ত্রীর শান্ত আচরণের জবাবে উনি কেন উত্তেজিত হবেন? উনার বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছেন। তারপর তাকে অনুরোধ করলেন হরতাল প্রত্যাহার করতে। কিন্তু উনি একগুয়েভাবে বলেই গেলেন হরতাল তোলা সম্ভব না। কারণ ১৮ দলের নেতাদের এক জায়গায় করা যাবে না। পুলিশের ভয়ে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার বললেন তত্ত্বাবধয়াক নিয়ে আলোচনায় রাজি থাকলে হরতাল প্রত্যাহার করবেন।স্ববিরোধী কথাবার্তা।
: বিরোধী দলীয় নেত্রী তো কর্মসূচি দেওয়ার সময়ই বলেছিলেন, সংলাপ, আন্দোলন একসঙ্গে চলবে।
—পুরো দেশবাসী দু্ই পক্ষের সমঝোতার অপেক্ষায় দিন গুনছে। প্রধানমন্ত্রী আগ বাড়িয়ে ফোনও করলেন, তাও আবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই। এতকিছুর চেয়ে হরতালটাই বড় হলো?
: ভোটের রাজনীতিতে হরতাল দিয়ে প্রত্যাহার করলে রাজনীতি থাকে না। তাছাড়া বিরোধী দলীয় নেত্রী তো সংলাপের রাস্তা বন্ধ করে দেননি। বলেছেন হরতাল শেষে যেতে কোনো আপত্তি নেই। তিনি তো নমনীয়তাও দেখিয়েছেন, বললেন নির্দলীয় সরকার নিয়ে আলোচনা হলে তিনি হরতাল প্রত্যাহারে রাজি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। শেষে তো ফোনটাই কেটে দিলেন।
—ফোনালাপ প্রকাশ না হলে এত কথা জানতে পারতে?
: জেনেই কী এমন দেশ-জাতি উদ্ধার হলো। ফোন ডেড ছিল কিনা, তা নিয়েই প্রায় অর্ধেকটা সময় কথা কাটাকাটি। অতীত ইতিহাস নিয়ে টানাহেচড়া চললো আরো কিছুক্ষণ। জনগণ যে আশায় বসে ছিল সেই সমঝোতার বিষয়ে কথা হলো ছিটে-ফোটা। এবং সেখানেও দুজনের অবস্থান দুই মেরুতেই। ছাড় দেওয়ার তো কোনা মানসিকতা দেখলাম না। তো এটা জনগণকে জানানোর এমন কি দরকার ছিল। দুই পক্ষ ছাড় দিয়ে কথা বললে, সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি হলে না হয় বলা যেত প্রকাশ করে ভাল হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপ-আমেরিকায় এখন হৈচৈ চলছে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে। সেখানে কিনা সরকার ফোনোলাপ প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকে সমর্থন করছে। এতে ভবিষ্যতে সংবাদমাধ্যমগুলো অন্যের ফোনালাপ ফাঁসে কি আরো উদ্বুদ্ধ হবে না? তবে যাই বলো, বিরোধী দলীয় নেত্রীর অনেক প্রশ্নের জবাব কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দিতে পারেননি।
জবাব না দিয়ে সূচনা হাত ধুতে চলে গেল। ফিরে এসে এটো বাসন-কোসন কিচেনে নিয়ে গেল। হালিমও হাত ধুয়ে ড্রইংরুমের দিকে পা বাড়ালেন। টিভি ছেড়ে পত্রিকাতে মন দিলেন।
সূচনাও সবকিছু গুছিয়ে খানিক পর ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। রিমোটটা নিয়ে চ্যানেল পাল্টাতে থাকলেন।কোনো চ্যানেলেই দেখার মতো তেমন কিছু খুজে পোলেন না।
—এখন কি হবে? সরকারপক্ষ তো বলছে এখন সংলাপের উদ্যোগ বিরোধী দলকেই নিতে হবে। পাল্টা ফোন এখন তাদরেকেই করতে হবে। টিভির পর্দায় চোখ রেখেই জানতে চাইল সূচনা। এতগুলো লাশ পড়লো, সেটা কি ভালো কিছু হলো?
: বিএনপি তো বলছে তারা ফোন করবে না। সরকারেই উদ্যেগ নিতে হবে। সংঘাতের রাজনীতি চলছে। লাশ তো পড়বেই।
—তোমার কি মনে হয়, বিএনপি ফোন করবে?
: এখনই বলা যাচ্ছে না। এখানকার রাজনীতির ধরন সাধারণ মানুষর পক্ষে আচ করা কঠিন। তবে পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা মাথায় রেখে শেষ পর্যন্ত বিএনপি ফোন করতেও পারে। আবার একই কারণে সরকারপক্ষও ফের ফোন করতে পারে।
—তার মানে সংলাপ হচ্ছে।
: হচ্ছেই বলা যাবে না। সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ধরো লোক দেখানোর জন্য হলেও দুই পক্ষই সংলাপে বসল। তাতে লাভ হবে কি? কেউ চুল পরিমাণ ছাড় দিবে না। খালি বসাটাই সার হবে। লাভের লাভ কিছুই হবে না। সংলাপে বসলেও কোনা সুরাহা হবে না। তাছাড়া সিটি করপোরেশন নিবার্চন, সর্বদলীয় সরকার, তারপর সরকারের তরফে ফোন—এগুলোকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার টোপ হিসেবে দেখছে অনেকেই।
—তাহলে নির্বাচন।
: সরকার তো বলছে বিএনপি না আসলেও তারা নির্বাচন করবে। সেক্ষেত্রে হয়তো মহাজোট ভেঙ্গে দিয়ে শরিকদের বিরোধী দল বানিয়ে নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ।
—কিন্তু সেটা কি টিকবে? তাছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখে ধারণা করা যায় যে বিএনপির পক্ষে যথেষ্ট জনমত আছে। নির্বাচনে না গেলে তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না?
: এক তরফা নির্বাচন হলে সেটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে বলে মনে হয় না। আর এরকম নির্বাচন হলে বিএনপি-জামাত আরো কঠোর কর্মসূচি দিবে। জ্বালাও-পোড়া করবে। লাশ পড়বে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। আবার আরেক হিসাবে এ মহূর্তে নির্বাচনে না গেলেই বরং বিএনপির লাভ বেশি।
—কিভাবে?
: ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন করে জিতলে বিপাকে পড়বে বিএনপি। তখন জামাত তাদের ব্যাপক প্রেসারে রাখবে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য। বিরোধী দলীয় নেত্রী যে সমাবেশে সেই রকম ইঙ্গিত দিয়েছেন সেটা জামাতের চাপে পড়েই। যে কারণে তারা গণজাগরণ মঞ্চেও যায়নি। ক্ষমতায় গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক ও দণ্ডপ্রাপ্তদের ছেড়ে দিলে এদেশে বিএনপির রাজনীতির কবর হয়ে যাবে। আবার না ছাড়লে জামাত নানা ফ্যাকড়া খাড়া করবে। এ মূহূর্তে বিএনপি নির্বাচনে না গেলে আওয়ামী লীগ যদি এক তরফা নির্বাচন করে তবে সেটা টেকার সম্ভাবনা নাই। সেক্ষেত্রে অনির্বাচিত তৃতীয় কোনো পক্ষ আসতে পারে। তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না তাদের। আর তারা আসলে তাদেরও কিছু মিশন থাকবে। সেই মিশন সারতে সারতে দণ্ডিত অপরাধীদের রায়ও কার্যকর হয়ে যাবে। বিএনপি হয়তো এটাই চাইছে। তারপর যখন নির্বাচন হবে তখন আর তাদের সামনে কোনো দায়ভার থাকবে না।
—কিন্তু আওয়ামী লীগ তা মানবে কেন?
: আওয়ামী লীগ মানবে সে কথা কে বললো। আসলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যে আওয়ামী লীগের কিছু বলারই থাকবে না।
আচ্ছা তর্কের খাতিরে ধরে নাও সংলাপ হলো। দুই পক্ষ মিলে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করে সে অনুযায়ী নির্বাচন করলো। জয়ী পক্ষ সরকার গঠন করলো। পরাজিতরা হার মেনে নিলো। কিন্তু তাতে জনগণের লাভ কি হবে বলতে পারো? কোনো কিছুর কি কোনো বদল হবে?
সূচনা কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না। আনমনে রিমোটের বোতামগুলো চাপলেন কিছুক্ষণ। তারপর একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডরুমের দিকে পা বাড়ালেন। খানিকক্ষণ পত্রিকার পাতার উল্টেপাল্টে হালিমও তাকে অনুসরণ করলেন।