প্রতিটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ মানুষকে জানিয়ে দেয় যে বর্বররা এখনও সভ্যতাকে দখল করে আছে - হুমায়ুন আজাদ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার নারী বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কিছুদিন পর রাজু আলাউদ্দিন ও ব্রাত্য রাইসু হুমায়ুন আজাদের একটি সাক্ষাৎকার নেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা মুক্তচিন্তার এই দুঃসময়েও সমান মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ব্লগের সাম্প্রতিক প্রবণতার সঙ্গেও এর সাযূজ্য রয়েছে। অসাধারণ এই লেখকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমি বলি: প্রতিটি নিষিদ্ধ পোস্ট বা লেখা মানুষকে জানিয়ে দেয় যে বর্বররা এখন ওয়েবজগতকে দখল করে আছে
নিচে ব্লগের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ পাঠকসমীপে পেশ করা হল-
ব্রাত্য রাইসু: আপনার নারী নিষিদ্ধ হয়েছে। এই মুহূর্তে আপনি কী ভাবছেন?
হুমায়ুন আজাদ: হ্যাঁ, বেশ অদ্ভুত হচ্ছে। তবে আমি বইটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এটি মনে করছি না, বা মনেও হচ্ছে না।
রাইসু: প্রসিদ্ধ হলো বরং?
হুমায়ুন: প্রসিদ্ধ এটি আগেই ছিলো। আমার মনে হচ্ছে যে এই বই আছে এবং থাকবে, বরং যারা নিষিদ্ধ করেছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, বাতিল হয়ে যাবে, নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এ-বইকে কারো পক্ষে নিষিদ্ধ করে রাখা সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো বইকে নিষিদ্ধ করে রাখা যায় নি। আর আমি তো বারবার বলেছি যে প্রতিটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ, প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়। কাজেই বলা যাক, বইটি এখন নতুন আলো দিচ্ছে। আমার ভালোই লাগছে বলা যায়। যদিও আমি এই সরকারি সিদ্ধান্তকে বিনা প্রতিবাদে বাস্তবায়িত হতে দেবো না।
রাজু: এই সরকার তো এর আগেও বেশ কিছু বই নিষিদ্ধ করেছে, আপনারটিই সর্বশেষ। সরকার কেন বই নিষিদ্ধ করে, আপনার কী মনে হয়?
হুমায়ুন: সরকার ঠিক কেন নিষিদ্ধ করে ভেতরের সংবাদ তো আমার জানা নেই। তবে আমি লক্ষ করছি এরা যখন একটি বইকে নিষিদ্ধ করছে তখনই এই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা বারবার বলছে। ধর্ম এদের একটি পুঁজিতে পরিণত হয়ে গেছে। ফলে তারা যখনই রাজনৈতিকভাবে অস্বস্তির মধ্যে থাকে তখনই দেশে ধর্মীয় ভাব জাগিয়ে তোলার একটি গোপন বা স্পষ্ট উদ্দেশ্য তাদের থাকে। এখন দেশ রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিযে যাচ্ছে। এই সময় একটু ধর্মীয় ভাবাবেগ যদি জাগিযে তোলা যায় এবং যদি তারা প্রমাণ করতে পারে বা দেখাতে পারে যে ইসলামের তারা এক বড় রকমের রক্ষক, তাহলে হয়তো নির্বাচনে এটা তাদের জন্য উপকারী হবে। ইসলামকে এখন তারা তাদের বাহ্যিক পোশাকে পরিণত করেছে। এটাকে তারা একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এই সরকারের সময় বেশ কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়েছে। ঐ বইগুলো সম্ভবত এই নারীর মত গুরুত্বপূর্ণ বই নয়। ঐ লেখকেরাও অতোটা গুরুত্বপূর্ণ নন। এবং ঐ বইগুলো সম্পর্কে, একটি ছাড়া, সাধারণ পাঠক অবহিতও ছিল না।
রাইসু: ফলে ওই বই নিষিদ্ধ করা ঠিক-ই ছিলো?
হুমায়ুন: আমি অবশ্য কোনো বই-ই নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতি নই। আমি মনে করি বই চিন্তার প্রকাশ। মানুষ বিভিন্ন রকম চিন্তার প্রকাশ ঘটাবে। যদি ঐ চিন্তা মূল্যবান হয় তাহলে গৃহীত হবে আর যদি মূল্যবান চিন্তা না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবে অনুপস্থিত হয়ে যায়।
রাজু: কিন্তু যদি খুব ক্ষতিকর-চিন্তাসম্পন্ন কোনো বই হয় সে ব্যাপারে কি কোনো নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন পড়বে?
রাইসু: যেমন ধরা যাক, খুন করার পদ্ধতি বিষয়ে একটা বই বের হলো — ?
রাজু: বা আত্মহত্যার পদ্ধতি সম্পর্কে একটা বই? আপনি নিজেকে কীভাবে ধ্বংস করবেন এ-ব্যাপারে একটা বই?
হুমায়ুন: আমি মনে করি, কোনোরকম চিন্তাই নিষিদ্ধ করা উচিত নয়। যদি এমনকি এ-ধরনের বইও বের হয় আত্মহত্যার সহজ কৌশল, বা —
রাইসু: ধর্ষণ করবার সহজ কৌশল, স্যার?
হুমায়ুন: ধর্ষণ করা নিয়েও যদি হয় আমি ঐ বই দেখে হাসবো। যে, একটি মানুষ এই ধরনের বইও লিখতে পারে। আমি ঐ বইয়ের জন্য কোনো আগ্রহ বোধ করবো না। তবে অনেকে আগ্রহ বোধ করবে। কিন্তু এটি কিন্তু সত্য নয়। আত্মহত্যার সহজ পদ্ধতি সম্পর্কে যদি কোনো বই লেখা হয় এবং অনেকেই পড়ে তাহলেই যে সে ঐ পদ্ধতি প্রয়োগ করবে এমন নয়। পৃথিবীতে বহু বই লেখা হয়েছে, বহু বই আমরা পড়েছি। বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওগুলো আমরা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করতে যাই না।
রাইসু: আর, আত্মহত্যার কোনো পদ্ধতিই সহজ না, ফলে ‘আত্মহত্যার সহজ কৌশল’ এরকম হতে পারে না?
হুমায়ুন: আমি কিন্তু আত্মহত্যার সহজ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রবন্ধ পড়েছি। ইংরেজি ভাষায় লেখা। তারা এগুলো লিখেছে। বলেছে, আত্মহত্যার সবচে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে গ্যাসের চুলোর ওপর মাথা চেপে রাখা। যেমন সিলভিয়া প্লাথ এ-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজিতে কিন্তু এ-বিষয়ে বিচিত্র লেখা হয়েছে। এটি মনে রাখতে হবে যে, কোনো একটি বিষয়ে বই লেখা হলো এবং পাঠক পড়লো এবং পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে তা বাস্তবায়িত করা শুরু করে না।
রাজু: আচ্ছা স্যার, এই সরকারের আমলে তো আপনি বোধহয় বাকস্বাধীনতার পঞ্চম শিকার।
হুমায়ুন: শিকার বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কারণ আমি মনে করি না যে এই সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করে রাখতে পারবে। আমি এই বইকে নিষিদ্ধ বলেই গণ্য করছি না। আর আমার এক বন্ধু খুব মজা করে বলেছে যে, এই সরকার চলে যাচ্ছে, সঙ্গে তোমার বইটিও নিয়ে যাচ্ছে।
রাইসু: তো, এই যে নিষিদ্ধ করলো, এই নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে একটা প্রবচন বলেন।
হুমায়ুন: … “প্রতিটি নিষিদ্ধ গ্রন্থ মানুষকে জানিয়ে দেয় যে বর্বররা এখনও সভ্যতাকে দখল করে আছে।”
রাজু: যে সরকার বই নিষিদ্ধ করতে পারে তাদের কাছে বাকস্বাধীনতা চাওয়ার কোনো ব্যাপারই থাকে না। সেক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানেরও স্বাধীনতা থাকার কথা না। এখন আমরা জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি কীভাবে?
হুমায়ুন: বিষয়টি বেশ বড়। প্রথম হচ্ছে যে স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না। স্বাধীনতা অর্জন করে নিতে হয়। এমন নয় যে আমাকে সমস্ত স্বাধীনতা লেখায় দিয়ে দেয়া হবে। এবং আমি আনন্দের সঙ্গে লিখতে থাকবো। স্বাধীনতা প্রতিটি লেখক সৃষ্টি করে নেয় নিজের জন্য। অনেক সময় দণ্ডিত হয়, অনেক সময় দণ্ডিত হয় না।...
মূল সাক্ষাৎকারটি পাবেন বিডিনিউজ আর্টস পাতায়
ছবি সৌজন্য : বিডিনিউজ আর্টস
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।
পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।
জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সমস্যা মিয়ার সমস্যা
সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।
তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
হামাস বিজয় উৎসব শুরু করেছে, ইসরায়েল বলছে, "না"
গতকাল অবধি হামাস যুদ্ধবিরতী মেনে নেয়নি; আজ সকালে রাফাতে কয়েকটা বোমা পড়েছে ও মানুষ উত্তর পশ্চিম দিকে পালাচ্ছে। আজকে , জেরুসালেম সময় সন্ধ্যা ৮:০০টার দিকে হামাস ঘোষণা করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে
আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।
প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।
ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন