somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি থেকে যেসব আজো ভাবায় আমায়(৪)★

০২ রা জুন, ২০২২ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি তখন ক্লাস অষ্টম থেকে নবমে উঠলাম, ক্লাসের ফার্স্ট বয় সবাই ভাবলো আমি বিজ্ঞান শাখায় যাবো। কিন্তু আমি চলে গেলাম বাণিজ্যিক শাখায়। আমাদের গ্রামের স্কুল গুলোতে বিজ্ঞান শাখায় যাওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত। বিজ্ঞানের স্যাররাই বলতো বিজ্ঞানে এসে লাভ নেই আর্টসে, কমার্সে যা! তারপরেও কিছু ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান শাখায় যেত। তখন আমাদের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক ছিলেন নাম সামাদ স্যার, উনি আমাদের গণিতও পড়াতেন। আমরা প্রায় সবাই উনার কাছে গণিত প্রাইভেট পড়তাম।
সামাদ স্যার বউ নিয়ে স্কুলের পাশে এক বাড়িতে থাকতো। উনার বাড়ি অন্য জেলায়। আমরা যেবার নাইনে উঠি সেবারই উনি উনার বউকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সকাল বেলায় প্রাইভেট পড়তে গেলে প্রায় সময় বউয়ের সাথে উনার ঝগড়া শুনতাম তবে ঝগড়ার বিষয়বস্তু আন্দাজ করতে পারতাম না।
আমাদের সাথে একটা মেয়ে পড়তো নাম সায়মা। সে বলতে গেলে পিছনের ব্যাঞ্চের ছাত্রী কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে। সায়মা সামাদ স্যারের কাছে বিজ্ঞান বিষয়ের দুই সাবজেক্ট ও সাধারণ গণিত প্রাইভেট পড়তো। প্রায়দিন দেখতাম আমরা প্রাইভেট পড়ে চলে যাওয়ার পরেও সায়মাকে স্যার ধরে রাখতেন। মেয়েটি খুবই চনমনে স্বভাবের ছিল। ক্লাস সিক্স থেকে সে সবসময়ই গণিত আর ইংরেজি ফেল করে পরের ক্লাসে উঠতো তারপরেও তাকে কখনো মনখারাপ অবস্থায় দেখতাম না। মনে হতো সে ফেল করাকে স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই নিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু ক্লাস নাইন থেকে টেন পর্যন্ত পরীক্ষা গুলোতে সে সাধারণ গণিত ও বিজ্ঞানের সকাল সাবজেক্ট পাস করতো খুব ভালো ভাবেই! আমাদের প্রিটেস্ট পরীক্ষায় সাধারণ গণিতে আমি আর সায়মা ছাড়া সবাই ফেল করলো। আমি পেয়েছিলাম ৩৪! কিন্তু সায়মা ফেলো ৬৪মার্ক! সায়মার এমন রেজাল্টে আমরা অবাক হতাম। কিন্তু দিনদিন সায়মার চনমনে ভাব উদাও হয়ে যেতে লাগলো। এসএসসি পরীক্ষার আগে দিয়ে সে চরম আকারে ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগলো।
পরীক্ষার কয়েকদিন আগে সে আমার কাছে এসে বললো আমি পরীক্ষা দিবো না। আমি মশকরা করে বললাম স্কুলের সেরা গণিতবিদ বলছে সে পরীক্ষা দিবে না। আমার হাঁসি না থামতেই সে বললো সামাদ স্যার একটা বেয়াদব, বদমাইশ আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। উনাকে আমি জীবনেও ক্ষমা করবো না। এই কথা তুই জীবনেও কাউকে বলবি না বলছি। আমি অনেকক্ষন ভেবে সেদিন কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ আমি চোখ বন্ধ করে পরিষ্কার বুঝতে পারছি সায়মার সাথে সে সময় কি হয়েছিল!

আমার নানী খুবই শক্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিলেন। নানার বাড়িতে গেলে দেখতাম নানী সারাদিনই এই কাজ সেই কাজ করতেন। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই তখন আমার নানা মারা যায়। অবশ্য নানা মারা যাওয়ার আগেই আমার মামারা সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সে জন্য নানীর তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তারপরেও নানী ছেলেদের সাথে থাকতেন না, নিজের স্বামীর ভিটেই থাকতেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে আমার আম্মাই সবার ছোট। আমার কাছে মনে হতো নানী বাকি সব মামাতো, খালাতো ভাইবোনদের চেয়ে আমাদের আদর করতেন বেশি। যদিও নানীর মৃত্যুর দিন সবার স্মৃতিচারণে দেখা গেলো সবাই আমাদের মতোই ভাবতো তাদেরকে নানী বেশি আদর করতো! অবাক করা ব্যাপার নানীর ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাও এমন ভাবতো। এই নারী কিভাবে সবার মাঝে এমন ধারণা জন্ম দিয়েছেন আজো সেটা আমার কাছে রহস্য মনে হয়।
যাক ঘটনা হলো আমার ক্লাস থ্রি'র বার্ষিক পরীক্ষার পর নানী বাড়ি বেড়াতে গেলাম, সাথে আমার বড় বোন। কয়েকদিন বেড়ানোর পর যেদিন বাড়ি আসবো সেদিন সকালে নাস্তা খেয়ে রওয়ানা দিবো এমন সময় এসে নানী বললো আয় তোরে গোসল করিয়ে দিই। এই বলে আমাকে পুকুরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দিলো। গোসল শেষে উনার রুমে এনে জামা কাপড় পড়িয়ে মাথায় সরিষার তেল মেখে দিলেন। নানী বাড়ি থেকে কিছুদূর আসার পর দেখলাম মাথা থেকে তেল গড়িয়ে গাল হয়ে ঠোঁটে এসে লাগলো। জিহবায় লাগার পর ওয়াক, ওয়াক করতে লাগলাম! আপা বললো কিরে কি হয়েছে? বললাম নানী মাথায় কাশের সিরাপ লাগিয়ে দিয়েছে! সারা রাস্তায় আপা হাঁসতে হাঁসতে বাড়িতে এসেছে। আর আমি রাগে গজগজ করতে করতে এসেছি।

মেয়েটির নাম স্বপ্না আমাদের বাড়ির মেয়ে। কোনো অভিজাত বা উচ্চ বংশে জন্ম নিলে নায়িকা, বা মডেল হতে পারতো। স্বপ্নার দুর্ভাগ্য সে দিন মুজুর আর মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করা মা-বাবার ঘরে জন্ম নিয়েছে। শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল, পড়ালেখা একেবারেই করা হয়নি। মায়ের সাথে এই বাড়ি ঐ বাড়ি যেতে যেতে কখন বড় হয়ে গিয়েছে বুজাই যায়নি। বড় বলতে তখনকার সময়ের জন্য আর গরিব ঘরের মেয়ে বলে বড়ই বলছি। ১২ বছর তখন তার, মা বাবা বিয়ে দেয় ময়মনসিংহের এক বয়স্ক ছেলের কাছে। ছেলেটি আমাদের গ্রামে এসে কামলা খাটতো, আর তাদের দূরসম্পর্কের কেমন একটা আত্মীয় হতো।
যাক বিয়ে করে আমাদের বাড়িতেই কয়েক মাস থাকলো। এরপর একদিন হঠাৎ করে স্বপ্নাকে ছেলেটি ময়মনসিংহ নিয়ে যায়। সেই সময় টেলিফোন, মোবাইল এত ছড়াছড়ি ছিলনা। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার পর বলতে গেলে স্বপ্নার বাবা-মা কোন যোগাযোগই করতে পারিনি। যাক এইভাবে তিন চার মাস কেটে গেলো। একদিন ভোরবেলা স্বপ্না বাড়িতে এসে হাজির, সকালবেলা তার মায়ের আহাজারি শুনে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। যে ছেলেটির সাথে স্বপ্নার বিয়ে দিয়েছে ছেলেটির নাকি ময়মনসিংহে আরেকটি সংসার ছিল। স্বপ্না যাওয়ার পর সে সংসারে সমস্যা সৃষ্টি হয়, তারপরও মেয়েটি সব কিছু মুখ বুজে সেখানে সংসার করতে লাগলো। কিন্তু সে গর্ভবতী হওয়ার কারণে সেখানে আর কষ্ট সহ্য করতে পারেনি। এক পর্যায়ে কাউকে কিছু না বলে সেই সুদূর ময়মনসিংহ থেকে আমাদের লক্ষ্মীপুর চলে আসে। শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে নিজের বাবার ঘরেই তার প্রথম সন্তান জন্ম দেয়। সন্তানের যখন ১ মাস বয়স, তখন আরেক দিন সকাল বেলা স্বপ্না আর তার মায়ের চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। গিয়ে দেখলাম তার ছেলেটি মরা পড়ে আছে!
কিভাবে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, বাচ্চা ছেলেটির শরীরে খাজুড়ে গুটি(চামড়ার উপরে এক ধরনের চুলকানো গুটি) হয়েছিল। তখন এই রোগের জন্য টেট্রাসল নামের একটা লিকুইড ওষুধ দেওয়া হতো। গরম পানির সাথে হালকা মিশিয়ে দুই তিনদিন গোসল করলে সেরে যেতো। অশিক্ষিত স্বপ্না তার ছেলের সারা শরীরে পানি দিয়ে না মিশিয়ে সরাসরি বাচ্চাটির শরীরে মেখে দিয়েছে রাতে। আর সকালে উঠে দেখে বাচ্চাটি আর নড়াচড়া করছে না! গাঁ থেকে বিকট আকারে টেট্রাসলের গন্ধ বের হচ্ছে!
স্মৃতি থেকে যেসব আজো ভাবায় আমায়(৩)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:১৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×