somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘নারীর মতামতের গুরুত্ব: বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে ইসলামী দৃষ্টিকোণ'

২৫ শে জুলাই, ২০১০ রাত ২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অধ্যাপক রানা হোসেন একজন শিল্পপতি। বিয়ে করেছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান নিলাকে। নিলা দর্শনে মাস্টার্স শেষ করেছে ২০০০ সালে। বর্তমানে তিন সন্তানের জননী। সারাদিন সংসারের নানা কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। ইদানিং মানসিক টেনশনে মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। কাজ করার সময় প্রায়ই ওলট-পালট করে ফেলে। যেমন: চা তৈরি করার সময় ভুলে চা-পাতির বদলে কালো জিরাই ঢেলে দেয়। মনটা প্রায়ই খারাপ থাকে। তার স্বামী সেই যে, সকালে যায়, আসে রাত ১০টায়। সে কোন বিষয় তার সাথে শেয়ার করে না। বিয়ের পর থেকে নিলার মনের এই কষ্ট কাউকে বলতেও পারছে না, কোন কাজেই সে স্বস্তি পায় না। মাঝে একদিন সে বলেই ফেলেছিল রাগ করে, সারাক্ষণ তো বিজনেস নিয়েই থাক, আমার কোন কিছু নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার আছে?
ওদিকে নিলার এই কথা কি শুনেছে রানা হোসেন? সে তো কাল বিদেশী পার্টনারের সাথে কি আলাপ করবে সে বিষয়ে চিন্তা করছে...। তার স্ত্রী যে রাগ করে তার কোন কথার সাড়া না পেয়ে চলে গেল, সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। একদিন নিলা জিজ্ঞেস করে: এ্যাই, তোমার এখন বেতন কি বেড়েছে? এখন কত তোমার বেতন? উত্তরে রানা হোসেন:
বেতনের কথা তোমার জানার দরকার কি? তোমার কত টাকা দরকার? রাগতঃস্বরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল রানা হোসেন।
ব্যাস্ আর কথা নেই। দু'জনেই চুপ।
এভাবেই প্রায় সময়, দু'জনের মধ্যে মনোমালিন্য, কথা কাটাকাটি নির্ঘুম রাত কাটানো ইত্যাদি লেগেই থাকে।
একটি, দু'টি করে এভাবে অনেক পরিবারেই আজ এ ধরনের ঘটনা চলছে। পারিবারিক ভিত আজ সে সব পরিবারে নড়বড়ে। নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য স্ত্রীর অনুভূতির প্রতি নজর না দেয়া এবং নারীর মতামতকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা একটি সুন্দর সাজানো পরিবারকে মুহূর্তেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। পারস্পরিক সম্প্রীতির পরিবেশে মুহূর্তেই তিক্ততা ছড়িয়ে দিতে পারে।
সুপ্রিয় পাঠক, এবার আসুন, ইসলাম নারীর মতামতের গুরুত্ব সম্পর্কে কি বিধান দিয়েছে সে সম্পর্কে জেনে নিই। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সমষ্টিকে বুঝায়। একটি পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীই হলো মূল চালিকা শক্তি। পরিবারে এই কাঠামোর ওপর গোটা সমাজ দাঁড়িয়ে আছে এবং বিকাশ লাভ করেছে। এজন্য এর গুরুত্ব অনেক বেশি। পরিবারিক অবস্থান মজবুতকরণে স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকাই মুখ্য। সুতরাং ইসলাম যে পারিবারিক প্রথা চালু করেছে যাতে পবিরবারের সদ্যদের কোন স্বার্থপরতা থাকবে না এবং থাকবে না কোন জবরদস্তি ও কঠোরতা। স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, স্ত্রী তোমার অংশ বিশেষ। আর নারীকে বলা হয়েছে, তুমি পুরুষ থেকে পৃথক হয়েছো, অথচ সে তোমার মূল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, ‘‘তিনিই তোমাদেরকে একই সত্তা থেকে সৃষ্টি করেছেন; আর তার থেকে তৈরি করেছেন জোড়া, যাতে তার কাছে শান্তি ও স্বস্তি লাভ করতে পারে।’’ (সূরা আরাফ : ১৮৯)
পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া আল্লাহ উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, ‘এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।' (সূরা রূম : ২১)
পারিবারিক সুখ সৌহার্দ ভালবাসা অটুট রাখার পেছনে উভয়কেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হয়। যেহেতু পরিবারে অর্থ উপার্জনে আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারে প্রধান ব্যক্তি পুরুষ থাকেন। সেক্ষেত্রে পরিবারের সার্বিক কল্যাণ সাধনে পুরুষকে অবশ্যই নারীর মতামত, নারীর ইচ্ছা বা পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।
ইসলামে নারীর মতামতকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মতপ্রকাশের সঠিক স্বাধীনতা দিয়েছে। বর্ণিত আছে, ‘খানসা বিনতে খাদ্দাম আনসারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করলেন, তার বাবা তাকে তার মতের বিপরীত একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ বিয়ে বাতিল করে দেন।’’ (বোখারী, মুসলিম)
আরেকজন অবিবাহিতা মেয়েকে তার অনুমতি ব্যতীতই বিয়ে দেয়া হয়। মেয়েটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করলে তিনি সে বিয়েও বাতিল করে দেন। (নাসাঈ) একজন মেয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ করলো, ‘‘পিতা আমাকে আমার চাচাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে। যার সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছে সে খুবই নীচু প্রকৃতির মানুষ, আমাকে বিয়ে করে সে তার নীচুতা দূর করতে ইচ্ছুক।’’ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেয়েটিকে উক্ত বিয়ে বহাল রাখা বা না রাখার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন।
কিন্তু মেয়েটি জানালো, ‘আমার পিতার দেয়া বিয়েতেই আমি রাজি হয়েছি। জানতে চাওয়া হলো, ‘তাহলে অভিযোগ নিয়ে আসা হয়েছে কেনো?' মেয়েটি বললো, ‘আমি এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে এসেছি, নারীরা ভালভাবে জেনে নিক যে, বিয়ের ব্যাপারে তাদের পিতার কিছুই করণীয় নেই অর্থাৎ বিয়ের ব্যাপারে মেয়ের মতামতের গুরুত্বই সর্বাধিক।' (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ)
উপরে বর্ণিত হাদীসসমূহে আমরা দেখতে পেয়েছি, বিয়ের ক্ষেত্রে একজনের মতামতের ওপর বা অভিভাবকের মতামতের ওপর নির্ভর করেই বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে পাত্রের যেমন অধিকার রয়েছে পাত্রীরও অনুরূপ অধিকার রয়েছে। ইসলামের এই বিশেষ বিধান ইনসাফের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। নারীকে তার মতামত প্রদানের অধিকার ইসলামই প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এই স্বাধীনতা বা সুযোগ বিয়ের পরবর্তী জীবনেও কার্যকর থাকা প্রয়োজন। কেননা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোন আমলকারীর আমল, সে নারী হোক বা পুরুষ, বিনষ্ট করব না-তোমরা একে অপরের জন্য।' (আল ইমরান : ১৯৫)
অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘মুমিন নারী পুরুষগণ একে অপরের বন্ধু, তারা সৎ ও নেক কাজের আদেশ করে ও অশ্লীল ও মন্দ কাজের নিষেধ করে' তারা নামায কায়েম করে, তারা আল্লাহ ও রাসূলকে মান্য করে চলে, এদের প্রতি আল্লাহ শিগগিরই রহমত দান করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞানময়। (সূরা তওবা ৭১-৭২)
সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নারী-পুরুষের মর্যাদা বা অধিকার নিজ নিজ ক্ষেত্রে সমান। যদিও আমরা জানি, পুরুষেরা কর্তব্যপালনে পরিবারের কর্তা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পরিবারের সকলের ওপর নিজের মত প্রয়োগ করে স্বৈরাচারী আচরণ করবে। এটা যুক্তি ও আইনের বিপরীত। বরং পারিবারিক পরিবেশকে যৌথ পরামর্শ ও আলোচনার ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে হবে। সেই সাথে ভালবাসা ও দয়ার আড়ালে মতামত বিনিময় অব্যাহত রাখতে হবে। এভাবে যদি সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীর পরামর্শ, মতামত গ্রহণ করা হয় অথবা পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা হয় তাহলেই পরিবার, পরিবেশ তথা সমাজ উন্নত হয়ে ওঠবে। প্রশান্তিতে ভরে ওঠবে নারীর মন এবং নিজেকে সে ধন্য ও গৌরবান্বিত মনে করতে পারবে।
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ব স্ব পশু যা সাথে নিয়ে আসা হয়েছিল তা সেখানেই কোরবানী করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে একথা জানিয়ে দেন, কিন্তু সন্ধির শর্তাবলীর কারণে সাহাবায়ে কেরামের মন এত খারাপ ছিল যে, কেউ রাসূলের নির্দেশ সত্ত্বেও কোরবানী করতে এগিয়ে গেলেন না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে যে স্ত্রী ছিলেন, তার কাছে গেলেন এবং একথা জানালেন। তার স্ত্রী পরামর্শ দিলেন, আপনি নিজে আপনার কোরবানী করে দিন, সাহাবায়ে কেরামও দেখবেন কোরবানী করতে এগিয়ে আসবে। ঠিকই রাসূলুল্লাহ কোরবানী করতে শুরু করলে সকল সাহাবায়ে কেরাম কোরবানী করে দিলেন। এতে প্রমাণিত হলো যে, পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বামী-স্ত্রী এমনকি সন্তানাদিসহ পরামর্শকের কাজ করা পরিবারের জন্যই কল্যাণকর হয়ে থাকে।
উপরে বর্ণিত ঘটনায় তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ জন্য পারিবারিক ঐক্য ও পরিবেশকে উন্নত করার ক্ষেত্রে পরামর্শভিত্তিক কাজ খুবই ফলদায়ক হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সচেতন পুরুষ এবং নারী উভয়কেই সঠিক এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাই আসুন, নারী-পুরুষের উভয়ের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলি প্রতিটি পরিবার। ভিত রচনা করি সুন্দর একটি সমাজের।

(সংকলিত)
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×