বাংলা সংগীত জগতের উজ্জল নক্ষত্র সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সংগীত ও গজল শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সতীনাথ সংগীতানুরাগী ছিলেন ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা শেখেন। তার ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন ও বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে কেউ পেশাদারি ছিলেন না। কলকাতায় এসে পড়া বাদ দিয়ে সতীনাথ চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করেন। “আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখোনা আমার নাম” না, আমরা পাষানের বুকে তোমার নাম লিখিনি প্রিয় সতীনাথ মুখোপাধ্যায়- ওই নাম হৃদয়েই লিখা যে। তার যোগ্য সহধর্মিনী উৎপলা সেন এর সঙ্গে তার অনেক গানের অপূর্ব যুগলবন্দী কালজয়ী এক উপাখ্যান। উৎপলা, সতীনাথ একত্রে গান গেয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে – বেতারে, নানা জলসায়। দিল্লি, লখনৌ, পাটনা, এলাহাবাদ, জলন্ধর, কটক, শিলঙ, গৌহাটি, প্রভৃতি বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন দুজনেই। এলাহাবাদে একত্রে গান গেয়ে স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন সতীনাথ-উৎপলা। অনেক জনপ্রিয় গানের এই মহান শিল্পী ১৯৯২ সালে ১৩ ডিসেম্বর ধরাধাম ত্যাগ করেন ! আজ কিংদন্তি সঙ্গীত শিল্পী ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯২ সালের আজকের দিনে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। খ্যাতিমান বাঙালি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ১৯২৫ সালে (জন্মতারিখ অজ্ঞাত) ভারতের লক্ষ্ণৌতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তারকচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পিতার চাকরিসূত্রে লক্ষ্ণৌতে জন্ম হলেও ছোটবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। এখানেই তার বেড়ে ওঠা ও বিএ পর্যন্ত লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। এরপর এমএ পড়ার জন্য কলকাতা আসেন। পড়া শেষে কর্মজীবনে যোগদান করেন কলকাতার অ্যাকাউন্টেন্স জেনারেল (এজি বেঙ্গল) এ। আধুনিক বাংলা গান, নজরুল সংগীত ও গজল শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তার বিখ্যাত গান সমুহঃ ১। আকাশ এত মেঘলা, ২। জীবনে যদি দ্বীপ, ৩। মরমীয়া তুমি, ৪। পাষানের বুকে, ৫। ও আকাশ প্রদীপ, ৬। জানি একদিন, ৭। তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, ৮। কত না হাজার ফুল, ৯। হায় বরষা, ১০। এখনো আকাশ, ১১। বন্ধু হয় অনেকে ইত্যাদি।
আকাশ এত মেঘলা গানের লিরিক্স
আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার ।।
গল্প করার এইতো দিন
মেঘ কালো হোক মন রঙিন ।।
সময় দিয়ে হৃদয়টাকে বাঁধবো নাকো আর
আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার ।
আঁধারো ছায়াতে চেয়েছি হারাতে
দু’বাহু বাড়াতে তোমারি কাছে ।।
যাক না এমন এইতো বেশ
হয় যদি হোক গল্প শেষ ।।
পূর্ন হৃদয় ভুলবে সেদিন সময় শূন্যতার ।
আকাশ এতো মেঘলা যেও নাকো একলা
এখনি নামবে অন্ধকার
ঝড়ের জল-তরঙ্গে নাচবে নটি রঙ্গে
ভয় আছে পথ হারাবার
ব্যাক্তিগত জীবনে সতীনাথ সংগীত শিল্পী উৎপলা সেন এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬৮ সালে। সম্পর্ক তো এক-আধ বছরের নয়, উৎপলা যখন বেণু সেনের ঘরণি, তখন থেকে। তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনও যে টাল খায়নি একটি বারের জন্যও। ১৯৬৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেন উৎপলাকে। তার পর জীবন চলেছে নানা বাঁক পেরিয়ে। উৎপলার সঙ্গে সতীনাথের যখন বিয়ে হয়, খুব ইচ্ছে ছিল যদি একটা মেয়ে হত! আপত্তি ছিল না উৎপলারও। কিন্তু প্রথম পক্ষের ছেলে বাবুন যে তখন সদ্য যুবক। তাকে সতীনাথ পুত্রস্নেহে কোলে পিঠে আদরে আহ্লাদে বড় করছেন। তার যদি মনে লাগে! তাই নিজের ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে ছিলেন। তাই কাপড়ের গার্গীই ছিল সতীনাথের মেয়ে। দিনের বেলা সে থাকত আলমারিতে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে মেয়েকে বের করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে, চুল আঁচড়ে, কাপড়-জামা সাফসুতরো করে ফিরিয়ে দিতেন তার আলমারি-বিছানায়। আদুরে, অভিমানী উৎপলার এক বার সহ্য হয়নি।— ‘‘তুমি কেবলই তো গার্গীকে নিয়ে আছ! আমার দিকে ফিরেও তাকাও না।’’ ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দোতলার বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তাকে। কষ্ট পেয়েছিলেন সতীনাথ, বিড় বিড় করে শুধু বলেছিলেন, ‘‘তুমি আমার গার্গীকে ছিঁড়ে ফেললে!’’ তার বাইরে কিছুই না।
১৯৯২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সতীনাথ মুখোপাধ্যায় কলকাতায় পিজি হাসপাতালে বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেন। ২০০০ সালে কোলন ক্যানসার হল উৎপলার। আবার অপারেশন। বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু দিনে দিনে বন্দি হয়ে পড়লেন বিছানায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫-এ হাসপাতালে কোমার মধ্যেই চলে গেলেন উৎপলা সেন। কী অদ্ভুত, বেণু সেন আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার দিনটির মতো সে দিনও ছিল ১৩ তারিখ! কিংদন্তি সঙ্গীত শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের আজ ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৩