করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট বাড়ার আশঙ্কার মধ্যে গৃহনির্যাতন, বিশেষ করে নারীদের প্রতি সহিংসতা মারাত্মাক মাত্রায় বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ প্রধান বলেন, “মহিলা এবং মেয়েদের উপর হুমকির পরিমাণ বাড়তে থাকলে তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ঘরে থাকাই বাঞ্চনীয়। এছাড়াও, মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসা বৃদ্ধির এক ভয়াবহ চিত্র সামনে এনে তা মোকাবিলার বিভিন্ন উপায়ের পরামর্শও দেন এবং সমস্ত সরকারকে সেই সুপারিশ অনুসরণ করার আহ্বানও জানান। বিশ্ব আতঙ্কিত করোনার দাপটে, বিভিন্ন দেশে লকডাউনের আবহেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরে ঘরে হিংসাও। তিনি বলেন, “কোভিড -১৯ দমনের জন্য লকডাউন এবং কোয়ারেন্টাইন অপরিহার্য। তবে এর ফলে মহিলাদের উপর অত্যাচারও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সপ্তাহ থেকে অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে হিংসার ঘটনা। কিছু দেশে মহিলাদের সুরক্ষার জন্য ফোন কলের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।” এই মর্মে এবার সব দেশের রাষ্ট্রনেতাদের কাছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আর্জি জানালেন রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাস। সোমবার তিনি জানান যে এই লকডাউনের বিশ্বে “মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গার্হস্থ্য হিংসা”। তাই অবিলম্বে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে অনুরোধ জানিয়েছেন সব সরকারকে।
এর আগে ভারতের জাতীয় নির্যাতন কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা একই অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেন করোনাভাইরাসের ভয়াল সংক্রমণ রুখতে গৃহবন্দি হয়েছে গোটা দেশ। এদিকে ঘরে ঘরে বৃদ্ধি পেয়েছে হিংসার ঘটনা। পাশাপাশি বেড়েছে মহিলাদের উপর হিংসা এবং নির্যাতনের অভিযোগও। যেখানে মার্চের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ জমা পড়েছিল ১১৬টি। সেখানে ২৩ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনে অভিযোগ জমা পড়েছে ২৫৭টি। বেশিরভাগ অভিযোগ তাঁদের কাছে জমা পড়ছে ইমেলের মাধ্যমে। আর প্রতিদিন বেড়েই চলেছে ইমেলের সংখ্যা। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, “আমি এই লকডাউন পিরিয়ডের সময় বিভিন্ন ধরণের অভিযোগ দেখছি। মহিলারা চাইলেই পুলিশের কাছ অবধি পৌঁছতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা পুলিশের কাছে যেতে চান না কারণ স্বামী যদি কয়েকদিন মুক্তি তখন অত্যাচার আরও বাড়তে পারে এই আশঙ্কা রয়েছে তাঁদের।” রেখা শর্মা এও বলেন যে আগে কোনও ধরণের সমস্যা হলে তাঁরা তাঁদের মা-বাবার কাছে যেতে পারতেন। কিন্তু লকডাউনে সেই উপায়ও নেই। যদিও অভিযোগকারীনিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে কমিশন এমনটাই জানান হয়েছে। করোনা ভাইরাস বিস্তার রোধে ভারতে করফিউ জারির প্রথম সপ্তাহে দেশজুড়ে লিঙ্গভিত্তিক নৃশংসতার ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে৷
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, করোনা ভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে গৃহনিপীড়ন প্রতিরোধে কাজ করা অনলাইন সার্ভিসগুলোতে ফোন অনেক বেড়ে গেছে। তুরস্কে গত ১১ মার্চ থেকে জনগণকে ঘরে অবস্থানের নির্দেশ জারি করা হয়৷ তারপর সেখানে গৃহনির্যাতন এবং নারীদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার হার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে৷তুরস্কের সক্রিয়বাদীরা ঘরে আবদ্ধ মহিলাদের মৃত্যুর পর তাদের বৃহত্তর সুরক্ষার দাবি জানান। দক্ষিণ আফ্রিকায় লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার প্রায় ৯০ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে৷অস্ট্রেলিয়ায় অনলাইনে গৃহনির্যাতনের বিরুদ্ধে সহায়তা দান করা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ আগের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে খোদ দেশটির সরকার৷ফ্রান্সের এক মন্ত্রী জানান, দেশটিতে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে দেশজুড়ে গৃহনির্যাতন ৩২ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ রাজধানী প্যারিসে এই হার আরো বেশি, প্রায় ৩৬ শতাংশ৷ একশন এইড বাংলাদেশ-এর এক গবেষণায় জানা যায়, দেশের তিনজনের মধ্যে দুজন নারী অর্থাৎ দেশের মোট নারীর ৬৬ শতাংশই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। এর মধ্যে ৭২.৭ শতাংশই তাদের এই অভিজ্ঞতা কারও কাছে তুলে ধরেন না। অধিকাংশ নারীই দিনকে দিন গালাগাল, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য বাংলােদেশে লকডাউনের পর নারী নির্যাতন ও গৃহনিপীড়ন কি পরিমাণ বেড়েছে তার পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। আশঙ্কাজনক এই পরিস্থিতিতে গুতেরেস বলেন, ‘‘যেভাবে আমরা একজোট হয়ে করোনা ভাইরাসকে হারাতে লড়াই করছি৷ ঠিক একই ভাবে একসঙ্গে কাজ করে আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মানুষের বাড়ি, সব জায়গায় নৃশংসতাকে প্রতিরোধ করতে পারবো, আমাদের পারতেই হবে৷'' লকডাউনের দিনগুলোতে নারী পুরুষ সবাই সবার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করুন। গৃহকে শান্তির আবাস হিসেবে গড়ে তুলুন। পরিবারই হোক সকলের জন্য শান্তির নীড়।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:০৬