বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অকুতোভয় সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ নাজমুল হক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসেও হামলা চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে অনেক সাংবাদিক সরাসরি যোগ দেন। অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্স প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দ নাজমুল হক অন্যতম। রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় সমান পারদর্শিতা থাকায় সৈয়দ নাজমুল হক পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পুরো প্রসিডিংয়ের রিপোর্ট তখন তিনিই করতেন। 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে যখন ইউরোপ ও লন্ডন সফরে যান, তখন তার একান্ত সচিব হিসেবে কেবল সৈয়দ নাজমুল হককে নিয়ে যান। শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন সফরে যাওয়ার সময় তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন কেবল বিশ্বস্ত সাংবাদিক হিসেবে নয় বরং বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে। কেননা, নাজমুল বিদেশে সবসময় ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর সাথি ছিলেন। হোটেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একঘরে থাকতেন, খাবার এলে নিজে খেয়ে পরীক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে খেতে দিতেন। তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্নেহের নিদর্শনস্বরূপ বঙ্গবন্ধু নাজমুলকে একটি পাইপও উপহার দিয়েছিলেন।১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকা রেসকোর্স মাঠে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার আগে তা যথাযথ রিপোর্ট করার জন্য নাজমুলকে ৫ মার্চ দুপুরে ডেকে নেন এবং নাজমুল হক বিভিন্ন পত্রিকায় তা সঠিকভাবে পরিবেশন করে ৭ মার্চ রাতে বাসায় ফেরেন। এ সময় থেকেই তিনি পাকিস্তান সরকারের নজরে পড়ে যান। যুদ্ধ চলাকালীন নাজমুল হক তাঁর লেখনীর মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দেন এবং দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর মর্মন্তুদ অত্যাচারের কাহিনী তাঁর লেখনীর মাধম্যেই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বিদেশি সংবাদপত্রের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে থাকেন। সৈয়দ নাজমুল হক পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের চীফ রিপোর্টার ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস এবং হংকং-এর এশিয়ান নিউজ এজেন্সির ঢাকা সংবাদদাতা ছিলেন নাজমুল হক। তিনি ঢাকা টাইমসের সিটি এডিটর হিসাবেও কাজ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি নিয়মিতভাবে অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে ‘ডন’ (Dawn), ‘পাকিস্তান অবজারভার (Pakistan Observer), ‘ঢাকা টাইমস’ (The Dacca Times), ‘ওয়েভ’ (The Wave), ‘ইউনিটি’ (Unity) ইত্যাদি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন । ফলে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়েন তিনি। অকুতোভয় সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ নাজমুল হকের ৭৯তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৪১ সালের আজকের দিনে তিনি খুলনাতে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
সৈয়দ নাজমুল হক ১৯৪১ সালের ৫ জুলাই খুলানায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ এমাদুল হক। শৈশবে তিনি বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়ায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ঢাকা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে বি.এ (অনার্স), রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ১৯৬৪ সালে একই বিষয়ে এম.এ পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ব্যাচে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে সাংবাদিকতায় আবার এম.এ ডিগ্রি নেন। ১৯৭০ সালে তিনি এ বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার আগে এ বিভাগেই সাংবাদিকতায় মেধা ক্রমানুসারে তৃতীয় স্থান পেয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছিলেন। এর আগে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্স প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৈয়দ নাজমুল হক অন্যতম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতি, খেলাধুলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার পারদর্শিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সৈয়দ নাজমুল হক নিয়মিতভাবে ঢাকা বেতার, টেলিভিশনে নাটক, কথিকা ও একাঙ্কিকায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহচর। তারা দু'জনেই তখন ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) আবাসিক শিক্ষার্থী। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক আইনবিরোধী ও সেপ্টেম্বরের শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলনে নাজমুল হক সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। এ সময় তিনি পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনালের চিফ রিপোর্টার, কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস ও হংকংয়ের এশিয়ান নিউজ এজেন্সির ঢাকাস্থ সংবাদদাতা এবং ঢাকা টাইমসের সিটি এডিটর হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের পত্রিকা 'ভিস্তা' সম্পাদনা করেন এবং নিয়মিতভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে ডন, পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা টাইমস, ওয়েভ, ইউনিটি ইত্যাদি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতেন। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম, যারা ১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ কার্জন হল প্রাঙ্গণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনায়েম খানকে অপমান করেছিলেন। এই ঘটনার মামলায় অন্যতম আসামি হওয়ায় তিনি সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের (সিএসএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তথ্য ক্যাডারে নির্বাচিত হলেও চূড়ান্ত নিয়োগ পাননি।
বিভিন্ন অভিযোগে পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ৬ আগস্ট তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে প্রেরণ করে এবং ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রেখে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তার ওপর ভয়ানক অত্যাচার চালায়। তিনি বলতেন, দেশ স্বাধীন হবেই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারব না, স্বাধীন বাংলায় আমি আমার ছেলেমেয়ের কাছে দালাল, বিশ্বাসঘাতক পিতা বলে পরিচিত হতে পারব না। পরবর্তীকালে ২০ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং ১৯ অক্টোবর শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পুনরায় গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মৃত্যুভয় নাজমুলকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম যে দু'জন কূটনীতিবিদ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন, তাদের একজন ছিলেন আমজাদুল হক, যিনি নাজমুল হকের ভাই। ফলে তার প্রতি অত্যাচারের মাত্রা ছিল আরও বেশি। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বরে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৬ দিন আগে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের নেতৃত্বে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী তাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে অপেক্ষমাণ একটি জিপে চোখ বেঁধে ওঠায়। তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেও মেলেনি তার মৃতদেহের সন্ধান। ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান কে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সৈয়দ নাজমুল হক সহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। অতি সম্প্রতি মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তার স্মৃতিবিজড়িত বিভাগ অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরির নামকরণ করা হয়েছে 'শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হক স্মৃতি পাঠাগার'।আজ অকুতোভয় সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ নাজমুল হকের জন্মবার্ষিকী। শহীদ সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হকের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]