আজ ৯ই আগষ্ট'২০২০ ইং ২৬তম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। । এ বছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের ঘোষণা হচ্ছে COVID-19 and indigenous peoples resilience. যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কোভিড-১৯ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধ’। কিন্তু জাতিসংঘ ঘোষণা দিলেও বিভিন্ন দেশ তাদের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের বিচেনায় মূল বক্তব্যকে সমুন্নত রেখে নিজেদের মতো করে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের স্লোগান বা ঘোষণা নির্ধারণ করে। সেভাবেই বাংলাদেশে ২০২০ সালের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘করোনা ভাইরাসের মহামারি ও আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম’। আদিবাসী, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং উপজাতি বলতে সাধারণত এমন সামাজিক গোষ্ঠীকে বোঝায়, যাদের নিজেদের মধ্যে কিছু চরিত্রগত মিল থাকে। তারা সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ উপ-কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের প্রথম সভায় আদিবাসী দিবস পালনের জন্য ৯ আগস্টকে বেছে নেয়। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। জাতিসঙ্ঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ, ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস ও ১৯৯৫-২০০৪ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি ১৯৯৩ সাল থেকে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও এবছর বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও অন্যান্য সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আজ রোববার বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের উদ্যোগে বিশিষ্টজনদের শুভেচ্ছাবার্তা প্রচার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ওয়েবিনার আলোচনা সভা ও প্রদীপ প্রজ্বলনের আয়োজন করা হবে। এ ছাড়াও রাত ৮টায় বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারিতে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের স্মরণে এবং ধরিত্রীর সুস্থতার জন্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রদীপ প্রজ্বলন ও এক মিনিট মৌনব্রত পালন করা হবে।
বাংলাদেশে ৪৫টির মতো আদিবাসী আছে। এদের বেশির ভাগ পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে থাকে। এই ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ৩০ লাখ লোক, যারা নিজ নিজ ৪০টি ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে। তাদের সামাজিক রীতিনীতি, বিয়ে, জন্ম-মৃত্যু, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সামাজিকতায় দেশের অন্যান্য অংশের জনগণ থেকে ভিন্ন ধরনের। আদিবাসীরা তাদের নৃ-তাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভূমি ও সম্পদের ব্যবস্থাপনাসহ সর্বক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট।উপজাতি বা আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্য যে, এরা প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জীবন, জীবিকা, আচার-আচরণ ও বিশ্বাসে এরা প্রকৃতিনির্ভর। বাংলাদেশের আদিবাসীেদের ২৪ ভাগ হিন্দু, ৪৪ ভাগ বৌদ্ধ, ১৩ ভাগ খ্রিষ্টান এবং ১৯ ভাগ অন্য ধর্মাবলম্বী। আদিবাসীদের চেহারার মধ্যে চীনাদের মতো মঙ্গোলিয়ান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ বছর সারাবিশ্বের ৯০টি দেশের প্রায় ৪০ কোটিরও অধিক আদিবাসী জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ সারা দেশের ৩০ লাখ আদিবাসী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করবে। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে আদিবাসীদের জীবনধারা, তাদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, আদিবাসী জাতিসমূহের ভাষা ও সংস্কৃতি তথা আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, আদিবাসী জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন করে তোলা এবং আদিবাসী মানুষের অধিকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করা।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত সংস্থাগুলো, আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক আইন আদিবাসী শনাক্ত করার জন্য নিম্নোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য ঠিক করেছে। যথাঃ
১। আদিবাসীরা সাধারণত তাদের পূর্বপুরুষদের বাসভূমি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বংশানুক্রমে বসবাস করে।
২। তারা তাদের এলাকাগুলোতে সুস্পষ্টভাবে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধারণ করে ও মেনে চলে।
৩। তাদের একটি বিশেষ চরিত্র হলো, তারা নিজেদের ভৌগোলিক ও প্রতিষ্ঠানগত সংস্কৃতিক রক্ষা করে চলে এবং বিদ্যমান বৃহত্তর সমাজগোষ্ঠীর সাথে মিশে যেতে চায় না। এবং
৪। তারা নিজেদের আদিবাসী অথবা উপজাতি হিসেবে পরিচয় দেয়।
এছাড়াও আইএলও কনভেনশনের ১০৭ ধারার ১১ অনুচ্ছেদে আদিবাসীদের ভূমির ওপর ব্যক্তিগত ও যৌথ মালিকানা স্বীকার করা হয়েছে। জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র ২০০৭ এর ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসীদের জোর করে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ এ কনভেনশন ও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও একের পর এক আদিবাসীদের ভূমি দখল করে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নতুন পদ্ধতিতে আদিবাসী ভূমি দখল চলছে। আদিবাসীদের না জানিয়ে তাদের ভূমিতে উদ্যান, ইকোপার্ক, অবকাশকেন্দ্র নির্মাণ, সামাজিক বনায়ন, বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ, আদিবাসী ভূমিকে খাস জমি ঘোষণা, হয়রানি, সরকারি ভূমি অফিসের দুর্নীতির মাধ্যমে আদিবাসীদের ভূমি দখল হচ্ছে।
আদিবাসী সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশে একটি জটিল আকার ধারণ করেছে। সরকার বলছে আদিবাসী নেই। বাংলাদেশ সরকার তার রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থার কারণে আদিবাসী নেই বলে বিভিন্ন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে আদিবাসীদের উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠি হিসেবে আখ্যায়িত করে প্রশাসনকে অবহিত করেছেন। একথা অনস্বীকার্য আর্ন্তজাতিকভাবে আদিবাসীদের অধিকার বিষয়ক একটি সনদ আছে সেটা সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে। আদিবাসী দিবস আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃতি ও ঘোষিত দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রতিবছর আর্ন্তজাতিক ঘোষিত দিবস হিসেবে বাংলাদেশেও আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে। তা হলে আর্ন্তজাতিক আইন যদি সরকার মানেন তা হলে জাতিসংঘের ঘোষিত আর্ন্তজাতিক আইনও সরকারকে মানতে হবে। কারণ আদিবাসী দিবস আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দিবস। সুতরাং সরকার যে আদিবাসী নেই বলছে তা ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশ সরকারও জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত রাষ্ট্র। যেহেতু দাবি-দাওয়া দেয়ার অধিকার সবার আছে, সেহেতু এ দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করার অধিকার আদিবাসীদেরও আছে। সে বিবেচনায় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের ৩০ লাখ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ১৪ দফা দাবি পেশ করেছে। আমরা সাধারণ নাগরিক হিসেবে আশা করব, রাষ্ট্র এসব দাবি সক্রিয় বিবেচনায় নেবে এবং স্বল্প-মেয়াদে, মধ্য-মেয়াদে এবং দীর্ঘ-মেয়াদে এসব দাবি বাস্তবায়নে আন্তরিক হবে। কেননা আদিবাসী জনগোষ্ঠী একই রাষ্ট্রের সীমানায় বাস করা জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাতাতত্ত্বিক সংখ্যালঘু। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনায়ও প্রান্তিক। সুতরাং তাদের প্রতি যত্নবান হওয়া এবং তাদের চাওয়া-চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সংখ্যাগুরু হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই আদিবাসী ও জাতীয়তার পরিচয়ের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে পাহাড়ীর জনগোষ্ঠির দাবীগুলো বিবেচনা করে পুরো বাংলাদেশে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান আবশ্যক।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:৫৭