সৌদি আরবে অবস্থানরত ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না দিলে সেখানে কর্মরত ২২ লাখ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে। ৩০-৪০ বছর আগে সৌদি বাদশাহ মানবিক কারণ দেখিয়ে ৮০/৯০ সালের দিকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়। বাংলাদেশি ভুয়া পাসপোর্ট নিয়েও অনেক রোহিঙ্গা দেশটিতে যায়। এখন সে দেশে আশ্রয়রত ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব। সৌদি আরব একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে এই প্রস্তাব দিতে পারে না। রোহিঙ্গা ইস্যুটি বার বার গলার কাঁটা হয়ে উঠছে বাংলাদেশের জন্য। আগে থেকে অবস্থানরত ৩ লাখসহ প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস এখন বাংলাদেশে। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে সৌদি আরবের চাপ। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে যেসব রোহিঙ্গা সৌদি আরবে গেছেনম তাদের একটি অংশ গেছেন সরসরি মিয়ানমার থেকে৷ আরেকটি অংশ বাংলাদেশ থেকে গেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়৷ তারা ১৯৭৭ সাল পরবর্তী সময়ে গিয়েছেন৷ সৌদি আরব গত এক বছর ধরে এ নিয়ে কথা বলছে এবং তালিকা পাঠাচ্ছে৷ তবে এবার একবারে ৫৪ হাজারের তালিকা পাঠিয়েছে সৌদি আরব। তবে তারা বলেছে, পাসপোর্ট ইস্যুর অর্থ এই নয় যে, তাদের আমরা বিতাড়িত করব।৷ যেহেতু আমরা কোনো স্টেটলেস লোক আমাদের দেশে রাখি না, সেইজন্য তাদের পাসপোর্ট দরকার৷এই পাসপোর্ট দেয়ার সঙ্গে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশের ২২ লাখ প্রবাসীর বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে৷ এ নিয়ে আলোচনায় সৌদি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট না দেয়া হলে ওই ২২ লাখের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে৷
অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘‘এটা তাদের একটা অন্যায় আবদার৷ তারা (রোহিঙ্গা) তো বিদেশি নাগরিক৷ তাদের পাসপোর্ট দিতে বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে৷ বাংলাদেশের উচিত তীব্র প্রতিবাদ জানানো এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া’’ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যুর সাথে সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত যুক্ত করাকে আরেকটি অন্যায় চাপ বলে মনে করেন তিনি৷ এক্ষেত্রেও তিনি মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের শক্ত কূটনেতিক তৎপরতা চালানো উচিত৷’মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, এখন না বললেও যদি পাসপোর্ট দেয়া হয়, তাহলে এরপরই সৌদি আরব ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা তুলবে৷ তাই বাংলাদেশকে সতর্ক হয়ে আলোচনা করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘বিদেশে আমাদের দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিয়েছে৷ এটা আমি লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত থাকার সময়ও দেখেছি৷ সেখানেও রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট৷ আমি সৌদি আরবে গিয়েও একই পরিস্থিতি দেখেছি৷’’ তার মতে, বাংলাদেশকে এখন ‘টেকনিক্যাল’ হতে হবে৷ পাসপোর্টের পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে যদি সতর্ক এবং স্বচ্ছ অবস্থান নেয়া যায় তাহলে ওই রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই নতুন করে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা নয়৷ কারণ, তারা বাংলাদেশে তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা এবং এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে পারবে না৷তিনি মনে করেন, সৌদি এই তৎপরতার পিছনে কোনো বাংলাদেশি থাকতে পারে৷ আবার যেসব রোহিঙ্গা নারী সৌদি নাগরিকদের বিয়ে করেছেন, তারাও প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷
বর্তমানে বাংলাদেশের অনেকের সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ভিসা ও ইকামা রয়েছে। কিন্তু যেতে পারছেন না। তারা যদি এখন না যেতে পারে তবে তাদের ভিসা বাতিল হয়ে যাবে।এই টানাপড়েনের মধ্যে ফেরত আসা কর্মীরা সৌদি ফেরত যেতে বিক্ষোভ শুরু করল গেল মার্চ মাস থেকে যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সৌদি আরবের ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফেরত যেতে হবে। এজন্য সৌদি এয়ারলাইন্সের মাত্র দুটি ফ্লাইট চালু হয়েছে প্রতি সপ্তাহে । প্রায় ৬০০০০ হাজার কর্মী কিভাবে ফেরত যাবে কাজে । তারা অনেকেই ঢাকা এসে এয়ারলাইন্স অফিসে ধর্না দিল , বিদেশ মন্ত্রনালয়ে এবং প্রবাসী কল্যান মন্ত্রনালয়ে ভিড় করল । কোন উপায় না পেয়ে তারা বিক্ষোভ শুরু করল। তবে এই বিক্ষোভ তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে। কেননা ‘সৌদি সরকার আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে অত্যন্ত কড়া। যদি আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কাজ বা জটলা দেখানো হয় তবে এটি তারা বরদাস্ত করে না।’তারা যদি দেখে আন্দোলনকারীরা জটলা করছে, তবে হয়তো তাদের ভিসা বাতিল করে দেবে কিংবা কাজ বাতিল করে দেবে। এ বিষয়ে তারা খুব শক্ত। তারা যদি বাতিল করে তবে আমাদের কিছু করার নাই। প্রবাসীরাই তখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আগেও এ ধরনের ঘটনা হয়েছে। ’মঙ্গলবার কাওরান বাজারে বিক্ষোভ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান সৌদি প্রবসীরা। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মবর্তারা তাদের আশ্বাস দেন ভিসার মেয়াদ বাড়াতে সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা হবে। যাদের ভিসা মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি বেশি জরুরি। একইসঙ্গে ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু সৌদি আরব ও বাংলাদেশ অনুমতি না দিলে এয়ারলাইন্সের পক্ষে ফ্লাইট বাড়ানো সম্ভব না।’ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর প্রায় ২৫২ জন প্রবাসীকে নিয়ে সৌদি আরবের রিয়াদের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের প্রথম ফ্লাইট। ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ৫৭ মিনিটের দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে ফ্লাইটটি। সফল কুটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে সৌদি আরব বাংলাদেশের মাঝের এই টানাপোড়ন সেই প্রত্যাশা আমাদের সবার।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:৩০