কথিত আছে (ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক আছে) একদা এক দরিদ্র মাতা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর নিকট এওক আর্জি নিয়ে হাজির হলেন। দরিদ্র সেই মহিলার ছেলে মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতো এবং প্রতিদিনই তার মায়ের কাছ বায়না করত মিষ্টি খাবার জন্য। অভাবের সংসারে দরিদ্র মাতার পক্ষে প্রতিদিন মিষ্টি যোগার করা ছিল অসম্বভ। এই সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি নবীজির কাছে গেলেন যাতে তিঁনি তার ছেলেকে মিষ্টি খেতে বারণ করেন। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) গরীর মাতার কাছে বিস্তারিত শুনে তাকে পরের দিন আসতে বললেন। মহিলা পরের দিন নবীজির কাছে আসলে তিনি তাকে আবরো পরের দিন আসতে বললেন। এই ভাবে পর পর কয়েক দিন আসার পরে নবীজি দরিদ্র মাতার ছেলেটিকে বললেন, তুমি আর তোমার মায়ের কাছে প্রতিদিন মিষ্টি খাবার বায়না করো না। ছেলেটি নবীজির কথায় সায় দিলো এবং মিষ্টি খাওয়া কমিয়ে দিলো। দরিদ্র মাতা তার ছেলের মিষ্টি খাবার বায়না থেকে রেহাই পেলেও একটি কথা তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। নবীজি কেন তাকে এই সামান্য কথাটি বলার জন্য বারে বারে আসতে বললেন। একদিন তিনি আবার নবীজির দরবারে হাজির হয়ে তার মনের মাঝে উদয় হওয়া প্রশ্নটি করলেন। "নবীজি আপনি আমার ছেলেকে মিষ্টি খেতে বারণ করায় সে এখন আর মিষ্টি খাবার জন্য বায়না ধরেণা। তবে এই কথাটি বলতে আপনি কেন এত দিন সময় নিলেন?" নবীজি কি উত্তর দিয়েছিলেন তা আপনাদের সবার জনা। তবে দুঃখ হয় আমরা আমাদের প্রিয় নবীর উম্মত হয়েও তার শিক্ষা ও উপদেশ আমাদের জীবনে গ্রহণ করতে পরিনাই। আমারাও যদি এই কাহিনীর অন্তর্নিহিত উপদেশের সাথে আমাদের বিবেক ও দায়িত্বশীলতাকে জাগ্রত করতে পারতাম তা হলে অনেক সমস্যা ও বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারতাম।
আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রবণতা হল—অন্যকে পরামর্শ প্রদান। সবাই কেবল অন্যের সংশোধন চাই; কিন্তু নিজের দিকে ফিরে তাকাবার তাহার সময় নাই বললেই চলে। নিজের যে গাফিলতি তার দিকে প্রথমে দৃষ্টিপাত না করে অন্যের দুর্বলতা আবিষ্কারে অনেকে আনন্দ খুঁজিয়া পান। ইহা যেমন সাধারণ মানুষের আচরণে প্রকাশ পায়, তেমনি প্রকাশ পায় তেথাকথিত শিক্ষিত সমাজেও। আমরা সম্পূর্ণরূপে নিজের অবস্থান ভুলিয়া অপরের দোষত্রুটি উন্মোচন করতে তৎপর হই। আমরা কেহই উপলব্ধি করিনা যে, কোথায় আমার গাফিলতি আছে। তাই সংশোধনের পথও উন্মুক্ত হয় না। এতে একটি অচলায়তনের সৃষ্টি হয়; অসংশোধনের অমোঘনীয় চক্রে আটকা পড়ি আমরা সবাই। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই দুষ্ট ক্ষত হতে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। এই অচলাবস্থা হতে মুক্তির পথ হতে পারে আমাদের সমাজেই চালু থাকা একটি পুরাতন প্রবচনের অনুসরণ, তাহা হল :‘আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও’। অর্থাৎ অপরকে এটা কর ওটা কর না উপদেশ দেয়ার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখা উচিত। যে কাজ আমি করি না তা অপরকে করার পরামর্শ দেয়া বা যে কাজ আমি করি তা অপরকে না করার জন্যে বলাটা এক ধরনের হিপোক্রাসি বৈ কিছু নয়। তাই আগে নিজে সংশোধিত হয়ে নিঃশব্দে অন্যের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তার পর অন্যকে সংশোধিত হবার আহ্বান জানাতে হবে। এটাই সর্বোৎৃকৃষ্ট পন্থা। এই প্রবচনের মর্ম ও তাত্পর্য সকলে উপলব্ধি করিবেন। কারণ কথারম চেয়েস সরাসরি কর্ম বেশি অনুপ্রেরণাদায়ক। আমরা সকলে আগে নিজে সংশোধিত হয়ে নিঃশব্দে অন্যের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবো। এর অনুশীলন বৃদ্ধি পেলে সাধারন ব্যক্তি পর্যায় হতে শুরু করে উচ্চ শ্রেণির সবার ক্ষেতে তা ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা যা না তাই প্রচার করতে বেশি ভালবাসি। আমাদের সমাজেই আরেকটি বহুল প্রচারিত প্রবাদ আছে - “চোরের মায়ের বড় গলা।” যা আমাদের সমাজে অহরহ উচ্চারণ হয়। আমাদের কর্মকাণ্ডে রয়েছে নানা অনিয়ম ও অবহেলা। যার কারনে বিভিন্ন জট পাকাচ্ছে। ফলে আমাদের যা বলা উচিত, তা বলতে পারিনা, যা করা দরকার তা করতে পারিনা। তাই সময় এসেছে নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নেবার। অতএব, একে অপরের খুঁত অন্বেষণ না করে আমাদের প্রত্যেকের আত্ম-উন্নয়নে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আগে নিজের সংশোধন দরকার। আমরা যদি সবাই স্ব স্ব দায়িত্ব- কর্তব্য পালনে আরো সচেষ্ট হই। তাই আসুন আমরা আলোকিত হই জোনাকির মতো আপন আলোয়।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৮